আফতাব চৌধুরী | রবিবার, ২১ জুন ২০২০
আমি কী করব বা করব না সেটা কোনো বিচার্য বিষয় নয়, আমি স্বাধীন দেশের নাগরিক, আমার যা ইচ্ছে হবে তাই করব, এতে সমাজ জাহান্নামে গেলে যাক, আমার কী আসে-যায় এমন মনোবৃত্তিতে গড়ে উঠছে সমাজের অধিকাংশ তরুণ-তরুণী। গড়ে উঠছে বললে ভুল হবে, গড়ে তুলছে সমাজ পরিচালন ব্যবস্থা। অপসংস্কৃতির জোয়ার বইয়ে দেওয়া হচ্ছে গোটা দেশে। তার শিকার দেশের উঠতি প্রজন্মও। এর প্রমাণ মেলে বিভিন্ন ক্লাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানাদিতে। তরুণ-তরুণীদের একত্রে মিলে এসব অনুষ্ঠান দেখে শহরবাসীকে ভাবিয়ে তোলে। এসব অনুষ্ঠানে নাচ-গানের যে ব্যবস্থা রাখা হয় তা দেখে সুস্থ সংস্কৃতিকে কোন পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে তা বুঝতে সংস্কৃতিপ্রেমী ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের কোনো অসুবিধা হয় না। কেননা, এসব দেখে অনেকে ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন পত্র-পত্রিকায়।
কিন্তু ক্ষোভ বা দুঃখ প্রকাশ করলে কোনো লাভ হবে না। এসব অনুষ্ঠানে যারা অংশগ্রহণকারী বা আয়োজক, তাদের দোষ দিয়েও কোনো লাভ নেই। কেননা, এরই মধ্যে আমেরিকার অভিভাকরা টিনএজারদের দিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে সেখানকার নবীন প্রজন্ম। দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকরাও এদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অপসংস্কৃতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে তারা। তার প্রতিফলন ঘটছে প্রতিনিয়ত। ছোটপন্দা বা বড়পর্দায় সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি প্রচার আর সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাস্তবে এসব অনুষ্ঠান আয়োজন করে যুবদের আকৃষ্ট করছে সমাজের একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী লোক। তাদের খপ্পরে পড়ে নিজের বিবেক বিসর্জন দিয়ে অশ্লীল নৃত্যে অংশ নিচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ চালকরা।
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র শ্রীকান্ত উপন্যাসে বলেছিলেন, ‘সমাজকে পশু করে নিতে না পারলে, পশুর কাজ আদায় করা যায় না।’ পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা কায়েম রাখতে মানুষ পশুর আচরণ করাতে পিছপা হচ্ছে না। অশ্লীল প্রচারের মধ্য দিয়ে মানুষের মনুষ্যত্ব কেড়ে নিচ্ছে। বিবেকশূন্য করে তুলছে। মানবতাহীন সমাজ গড়ে উঠছে। যার ফলে দেশের আনাচে-কানাচে তাদের রুচি মতো অপসংস্কৃতি পল্লবিত হচ্ছে। ছোট-বড় শহরে স্থান করে নিচ্ছে নাইট ক্লাব। যেখানে যুবরা আনন্দ উপভোগের নামে নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দিচ্ছে। কেন যুবসমাজকে অশুভ অনুষ্ঠানের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তা ভাবতে হবে। বর্তমানে আমাদের দেশে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট রয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা পচনের পথে। দিন দিন বাড়ছে সমস্যা। শিক্ষিত বেকার সমস্যা, দ্রব্যমূল্য সমস্যা, যাতায়াত সমস্যা ইত্যাদি। পাহাড়সম এসব সমস্যার বিরুদ্ধে ছাত্র-যুবরা গর্জে উঠলে পুঁজিপতিদের বিপদ ঘটাবে। সে বিষয়ে শিল্পপতিরা একশ শতাংশ ওয়াকিবহাল। তাই যুবসমাজকে ধ্বংস করতে অর্থাৎ বিবেকহীন করে তুলতে প্রচার মাধ্যমকে হাতিয়ার করে চালিয়ে যাচ্ছে অপসংস্কৃতির জোরদার প্রচার। পর্নো ফিল্ম থেকে শুরু করে সব ধরনের অশ্লীল ছবি ছাত্রছাত্রীদরে হাতে অতি সহজে তুলে দিচ্ছে তারা। যেসব পড়য়া বা যুবরা এর শিকার হচ্ছে না, তাদের মাথায় ‘ব্যক্তিবাদ’ চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’, ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ ইত্যাদি সোগানের মধ্য দিয়ে। ফলে দিন দিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী যুবদের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
সড়ক ও মহাসড়ক ইত্যাদি বিরাট সমস্যা হিসেবে দেখা দিলেও যুবসমাজের এই বিপথগামিতা রোধে কোনো তৎপরতা নেই। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত নেতারা নিজের কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত। সমাজের প্রতি এতটুকু সহানুভূতিও চোখে পড়ে না তাদের কাছ থেকে। দেশের সংস্কৃতি তীব্র সংকটের মধ্যে রয়েছে। অপসংস্কৃতির চাদরে ঢাকা সমাজে বাড়ছে কুকর্ম। বাড়ছে ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, প্রকাশ্যে খুন ইত্যাদির ঘটনা। প্রেম-ভালোবাসা পণ্যে পরিণত হচ্ছে। সংস্কৃতির নামে উলঙ্গ নৃত্য হচ্ছে। আর সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের কিছু যুবক, যারা নিজের কোমর ভেঙে দিতে উদ্যত আয়োজন করছে নানা জাতীয় ড্যান্সের মতো অসামাজিক অনুষ্ঠান। ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা। তবে একটা জায়গায় ইতি টানতেই হবে আমাদের। সুস্থ সংস্কৃতি বহাল রাখতে গ্রাম শহরে, পাড়ায় পাড়ায় আয়োজন করতে হবে বিবেক-জাগানো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ঘটা করে পালন করতে হবে একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, কাজী নজরুল ইসলাম, সোহরাওয়ান্দীর মতো দেশের কৃতী পুরুষদের জন্মজয়ন্তী বা স্মরণানুষ্ঠান। দেশের বা সমাজের জন্য তাদের চিন্তা, আদর্শ বেশি করে ছড়িয়ে দিতে হবে আমাদের। আধুনিক উপস্থাপনার মাধ্যমে তাদের চিন্তাকে নবপ্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে হবে আমাদের। উন্নতমানের বড় বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা দরকার। আর প্রত্যেক অভিভাবককে নিজের সন্তানদের কর্মপন্থার ওপর ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। কেননা, অপসংস্কৃতির খপ্পর থেকে কেউ রেহাই পাবে না। মানবতা, মূল্যবোধ, প্রেম-ভালোবাসা, সম্মান, মনুষ্যত্ববোধ সমাজে অব্যাহত রাখতে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে সবারই সজাগ ও সচেতন থাকা উচিত।
Posted ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২১ জুন ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh