কাজী জহিরুল ইসলাম | বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫
গোয়ার্তুমি না করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিজেদের অবস্থান বোঝা উচিত ছিল, অন্তত এক বছর চুপচাপ থাকা উচিত ছিল। আওয়ামী লীগ ধ্বংস হওয়ার জন্য অর্ধেক দায়ী দুর্নীতি ও ভারতের দাসত্ব বাকি অর্ধেক দায়ী শেখ হাসিনার লাগাম ছাড়া মুখ। ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরেও অবশিষ্টাংশ ধ্বংসেরও একটা বড়ো দায় তার মুখেরই।
হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণেই বত্রিশ নম্বরে বুলডোজার মিছিল, অতঃপর ভাংচুর হয়েছে। তার লাগামছাড়া বক্তব্যের প্ররোচনায় পড়েই বিচ্ছিন্নভাবে দলের কিছু অন্ধ সমর্থক ঝটিকা মিছিল করেছে, এর-ওর গাড়িতে আক্রমণ করেছে। সর্বশেষ হাসনাতের গাড়িতে আঘাত করে নিজেদের কফিনে নিজেরাই শেষ পেরেকটি বসালো।
যারা আওয়ামী দুঃশাসনের কড়া সমালোচক তারাও বিএনপির মত চেয়েছিল, থাক না, দলটাকে নিষিদ্ধ করার কী দরকার? মানুষই ঠিক করবে তারা আওয়ামী লীগকে চায় কী চায় না। কিন্তু তাদের ক্রমাগত উশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড সকলকেই বিষিয়ে তুলেছিল। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় এখনো যে পরিমাণ আস্ফালন, মিথ্যা প্রচার প্রপাগাণ্ডা ছড়ানো হচ্ছে, তাতে নিরপেক্ষ বিবেকবান মানুষেরাও, যারা কিছুটা চোখ বন্ধ করেই ছিল, তারাও পুরোপুরি তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ৩টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল ব্যক্তির পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের বিচার করতে পারার যে ধারাটি ছিল তা পুনর্বহাল করেছে, বিচার চলাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে এবং ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
হাসনাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে সংগঠিত আন্দোলনের মাঠ থেকে এই দাবীগুলো তোলা হয়েছিল। বিশেষ করে তারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে ছিল অনড়। এক পর্যায়ে এক ঘন্টার আল্টিমেটামও দিয়েছিল তারা। এই আন্দোলনে জুলাই বিপ্লবের সকল পক্ষ যুক্ত হলেও জুলাইয়ের মতোই দলের ব্যানারে যোগ দেয়নি বিএনপি কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দলের পক্ষ থেকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। জুলাই বিপ্লবের মত এবারও দল হিসেবে বিএনপির পরাজয় ঘটল। উভয় ক্ষেত্রেই তারা বিজয়ের পরে স্বাগত জানিয়েছেন, এটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের অদূরদর্শীতা প্রমাণ করে।
আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড়ো প্রতিপক্ষ হওয়া সত্বেও শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতে বিএনপির কোনো ভূমিকা বা স্বীকৃতি নেই, এই পরাজয় তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। যাদের কাছে তাদের এই শোচনীয় পরাজয় হয়েছে, পরবর্তীতে তাদের কোনো কিছুর সঙ্গেই তারা একমত হতে পারছেন না, যেন গোপনে অন্তরে ধারণ করা প্রতিশোধ নিতেই তাদের এই অবস্থান। তবে সব ক্ষেত্রে তারা পরাজিত হননি, আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর অপসারণ-বিরোধীতা করে তারা জিতে গেছেন। এইভাবে তারা তাদের জুলাইয়ের হারানো গৌরব ফিরে পাবার চেষ্টা করছেন।
কিন্তু এই বিরোধীতা যে রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদেরকে ক্রমশ জাতির কাছে বিবেকহীন ও অন্ত:সারশূন্য করে তুলছে, সম্ভবত এটি বোঝার মত উদার তারা এখনো হতে পারেননি।
আমার বিবেচনায় যেসব কারণে বিএনপি আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ হওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল সেগুলো হচ্ছে, তাদের নেতৃত্ব তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ জুলাই বিপ্লবের যোদ্ধাদের চেয়ে বড়ো শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করার একটা বালখিল্য ইগো অনুভব করছেন। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা, জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া, রাষ্ট্র সংস্কার করা এগুলো সবই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের, অর্থাৎ জুলাই যোদ্ধাদের দাবী, এই দাবীর সঙ্গে একাত্ম হওয়া মানে তাদের নেতৃত্ব মেনে নেওয়া, এটাকে তারা তাদের দলের অস্তিত্বের সংকট মনে করছেন।
দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, ভারতের চাপ। বিএনপি ইতোপূর্বে সরকার পরিচালনা করেছে, তাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, সরাকারে টিকে থাকতে হলে ভারতকে পাশে পেতেই হবে, আওয়ামী লীগের মতো তাদের মধ্যেও এই নতজানু পররাষ্ট্রনীতি আছে। ভারতকে ক্ষেপিয়ে সরকারে টিকে থাকা যাবে না, এটি হচ্ছে তাদের বিশ্বাস, তাই, অতীতে তারা দেশের মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে, ভেতরে ভেতরে ভারতের সঙ্গে দাসত্বের সম্পর্কই বজায় রেখেছিল, যদিও আওয়ামী লীগের মত নির্লজ্জভাবে তা প্রকাশ্যে করেনি। তাই দেশবাসীদের মধ্যে একটা বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল বিএনপি ভারত বিদ্বেষী, এই ন্যারেটিভ বিএনপির জনপ্রিয়তার একটি বড়ো কারণ। কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সব তথ্যই মুহূর্তের মধ্যে মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে অন্ধ করে রাখার দিন আর নেই। এখন যা করার তা প্রকাশ্যেই করতে হবে, নীতি-কৌশল দুদিন আগে আর পরে তা জনসমক্ষে স্পস্ট করে বলতেই হবে।
তৃতীয় কারণটি একটি ষড়যন্ত্র তত্ব। অনেকে মনে করেন, আওয়ামী দুঃশাসনের পুরো সময় জুড়ে বিএনপির নেতৃত্ব একটি আন্দোলন আন্দোলন খেলা খেলেছে। দলের বহু নেতা আওয়ামী সরকারের এবং কেউ কেউ ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার পেরোলে ছিলেন। কী সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন সেগুলোর রেকর্ড ফাস করে দেবার একটা হুমকি তাদের মাথার ওপরে আছে। এই হুমকির ভয়ে তারা আওয়ামী লীগকে মৃদু সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার মনে হয় প্রকাশ্যে তারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ব্যাপারে না বললেও ভেতরে ভেতরে এটাই চাইছিলেন এবং তাদের সেই মনোভাব সরকার বুঝতে পেরেই খুব সহজেই এই সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছেন।
চতুর্থ আরেকটি কারণ আছে বলে আমার মনে হয়। এইরকম বড়ো বড়ো সিদ্ধান্তগুলি যদি বিনা বাধায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে ফেলিতে পারে তাহলে এই সরকার শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং তখন দীর্ঘদিন ক্ষমতাত থাকার চেষ্টা করতে পারে, বিএনপিকে নির্বাচিনে হারানোর জন্য কোনো কৌশলগত অবস্থানে যেতে পারে। বিএনপি চায় না সরকার বড়ো ধরণের কোনো পদক্ষেপ নিয়ে সফল হোক, যা দেশের মানুষ ইতিবাচকভাবে নেবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বয়স যত বাড়বে, যত তারা বড়ো বড়ো সাফল্য দেখাবে ততই তারা শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং বিএনপি ততোই অজনপ্রিয় হয়ে পড়বে, ক্ষমতামূখী রাজনৈতিক দল হিসেবে এই ঝুকিটা তারা নিতে চাইবে না এটিই স্বাভাবিক।
কিন্তু রাজনীতি শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, ক্ষমতার বাইরে থেকে যদি দেশের কল্যাণ করা যায় সেটিই প্রকৃত রাজনীতি। এই রাজনীতি আমাদের দেশের দলগুলো কি কোনোদিনও বুঝবে?
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৪ মে ২০২৫
Posted ১:৪৪ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh