কাজী জহিরুল ইসলাম | বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫
নিউইয়র্ক থেকে সাত ঘন্টা এগিয়ে আছি। ইস্তাঁবুলে এখন সকাল দশটা হলেও আমার দেহঘড়িতে বাজে রাত ৩টা। এতক্ষণ যে পড়ে যাইনি এটাই ঢের বেশি হয়ে গেছে। তুর্কি বিমানের সার্ভিস আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে, বহুদিন পর এই বিমানে চড়ে তাই মনে হলো। এক পর্যায়ে একজন পুরুষ এয়ার ক্রু এসে বলেন, স্যার, এখন কি ঘুমাবেন, বিছানাটা করে দিই?
আমি, দিন, বলে লেভেটরির দিকে হাঁটতে থাকি। ফিরে এসে দেখি ম্যাট্রেস বিছিয়ে, বালিশ পেতে বিছানা তৈরি করে রেখেছে। গায়ে দেবার জন্য বেশ আরামদায়ক একটি বিশেষ কম্বলও দিয়েছে। বসার সময় গায়ে দেবার জন্য তো একটা ব্লাঙ্কেট দেয়ই, এটা শোয়ার জন্য। ট্রাভেল এজেন্ট বলে দিয়েছিল, তুর্কি বিমানে যান, ওদের বিজনেস ক্লাসের সেবার মান খুব উন্নত। আমি বিশ্বাস করিনি, কারণ অতীতে এই বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা আমার তেমন সুখকর ছিল না। তবে ওদের খাবার সব সময়ই পছন্দ হত। এবারও অতি উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করেছে। সবচেয়ে যেটা ভালো লাগে তা হচ্ছে পরিবেশন। কোনো প্যাকেটের খাবার নয়, কোনো ওয়ান টাইম ইউটেনসিলস নয়। অবশ্য এই স্ট্যান্ডার্ড সব এয়ারলাইন্সের বিজনেস ক্লাসই মেন্টেইন করে। সুদৃশ্য সিরামিকের কাপে চা, কাচের চমৎকার গ্লাসে জুস, পানি। শেফ এসে পাশে দাঁড়িয়ে একটা একটা আইটেম সিরামিকের প্লেটে তুলে দিচ্ছে। খাবার তো আজকাল আর শুধু খাবারে সীমাবদ্ধ নেই, কে কতটা ইপ্রোভাইজ করতে পেরেছে, কে কতটা শৈল্পিকভাবে পরিবেশন করতে পারছে, তার ওপরই নির্ভর করছে তাদের সেবার মান এবং তা দিয়েই অনেকটা নির্ণীত সেই জাতির সভ্যতার মানও। যত আরামদায়ক বিছানাই দিক, প্লেনে আমি কখনোই ঘুমাতে পারি না। প্রকৃতপক্ষে কোনো যাত্রায়ই আমি ঘুমাতে পারি না। গতিশীল অবস্থায় স্থির নিদ্রা – বিষয়টা আমার দেহযন্ত্রে নেই। শুধু দুপুরে খাওয়ার পরে গাড়ি চালাতে গেলে একটু ঝিমুনি আসে। আজকাল তো আর দুপুরে কিছু খাইই না, কাজেই সেই ঝামেলাও গেছে।
একটি হিন্দি সিনেমা দেখলাম। হিন্দি সিনেমা আমার পছন্দের তালিকায় থাকে না, হালকা বিনোদন এবং একটু বেশি সময় কাটানোর জন্য প্লেনে হিন্দি সিনেমা দেখি। এই সিনেমাগুলোর দৈর্ঘ্য সাধারণত বেশি হয়, কমপক্ষে সোয়া দুই ঘন্টা। এরই মধ্যে তিনটি কবিতাও লিখেছি। মাঝে মাঝে জানালায় সেলফোন ক্যামেরার লেন্স তাক করে ছবি তুলছি। পায়ের নিচে মেঘের বাগান। যেন সারি সারি শুভ্র পুষ্প ফুটে আছে। মেঘের নিচে নীল আটলান্টিক। কী অপূর্ব দৃশ্য। এই দৃশ্যগুলো ধারণ করে রাখার লোভ আমি প্রায়শই সামলাতে পারি না। এই করে করেই ইস্তাঁবুল পৌঁছে যাই। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। ইস্তাঁবুলের ঘড়ির কাটা মাত্র পাঁচটা ছুঁই ছুঁই করছিল।
দেহঘড়ির ডাকে সাড়া দিয়ে শুয়ে পড়ি। হঠাৎ দুই দশক আগের ল্যান্ডফোন বেজে ওঠে। স্বপ্নের মধ্যে ছিলাম হয়ত। মাথার ভেতরে প্লেনের একটানা ভোঁ ভোঁ শব্দের রেশ তখনো রয়ে গেছে। আজে-বাজে স্বপ্ন তৈরি করছে সেই শব্দ। যখন ঘুম ভাঙে প্রথমে ভেবেছিলাম স্বপ্নের মধ্যে শব্দটা শুনেছি। কিন্তু না, ফোনের শব্দ তখনো বেজে চলেছে। উঠবো না, উঠবো না করছি, আবার সঙ্গে সঙ্গেই ভাবি, না, এখন বেশি ঘুমালে সারা রাত জেগে থাকতে হবে। উঠে ল্যান্ডফোনের কর্ডলেস সেটটি কানে লাগাই। ওপাশে পুরুষ কণ্ঠ। কম বয়েসী কোনো তরুণ হবে। খুব দ্রুত কথা বলছে।
স্যার, আমি রিসেপশন থেকে বলছি, ১৪ তলায় আমাদের ক্লাব লাউঞ্জ। ওখানে লাঞ্চ এবং ডিনার সার্ভ করা হয়। আমার প্রতি নির্দেশ এসেছে আপনাকে যেন জানাই, আপনি যে কয়দিন এই হোটেলে থাকবেন আমাদের ১৪ তলার ক্লাব লাউঞ্জে এবং ৩৪ তলার রুফটপ লাউঞ্জে আপনার ফুল এক্সেস আছে। আমি কি আপনাকে আর কোনো সাহায্য করতে পারি?
মনে মনে ভাবছি, ফুল এক্সেস মানে কি? কমপ্লিমেন্টারি খাবার এবং পানীয়? তাহলে কমপ্লিমেন্টারি শব্দটা কেন বললো না? ওদের হোটেলের খাবারের দাম আকাশ ছোঁয়া, আমাকে কেন কমপ্লিমেন্টারি দিতে যাবে?
আমি বলি,
কিছুক্ষণ পরে আমি রিসেপশনে আসবো, শহরে বেরুবো, এই সংক্রান্ত কিছু তথ্য লাগবে। ও হয়ত আমার ইংরেজিটা ভালো বোঝেনি। বলে, না, না, রিসেপশনে আসতে হবে না। আপনি ১১ তলা থেকে সোজা ১৪ তলায় চলে যাবেন ডিনারের জন্য। আপনার কার্ডে এক্সেস দেয়া আছে।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। ডিনার তো করতেই হবে, কমপ্লিমেন্টারি হোক আর চার্জ করুক, অসুবিধা নেই। তার আগে শহরটা একটু দেখে আসি। নিচে নেমে এলে এক সুদর্শনা ছুটে আসে। জিজ্ঞেস করে মেয়েটির নাম জেনে নিয়েছিলাম কিন্তু এখন মনে করতে পারছি না। ঠিক আছে, ওর একটা কাল্পনিক নাম দিই, আইলিন। নামটি আরবী থেকে এসেছে। আধুনিক তুরস্কের মেয়েদের এই নাম রাখতে দেখা যায়। এর অর্থ হচ্ছে “ইচ্ছে পূরণ”। আমি প্রার্থনা করছি মেয়েটির মনের সবচেয়ে প্রধান ইচ্ছেটি যেন শিগগিরই পূরণ হয়। আইলিন ভীষণ স্মার্ট এবং দক্ষ। আমি শুধু জানালাম, আজ তো হাতে খুব বেশি সময় নেই। দুই-আড়াই ঘন্টায় ফিরে আসা যায় এমন কোথাও যেতে চাই। অচেনা জায়গায় প্রথম দিনই রাত করে ফিরতে চাই না। ওর মাথার ভেতরে যে এখন বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে তা মেয়েটির নীল চোখের দিকে তাকিয়েই টের পাচ্ছি। সেই বিদ্যুৎ সে তার অন্য তিন সহকর্মীর চোখেও ছড়িয়ে দিল এবং একসঙ্গে তিনজনই বলে উঠলো,
বেবেক।
বেবেক? হ্যাঁ, বেবেক। খুব কাছে, ট্যাক্সিতে দশ মিনিট লাগবে।
কী আছে ওখানে?॥ পানি। আপনি না সকালে বলেছিলেন পানি আর পাহাড় আপনাকে বেশি টানে, দুটোই আছে ওখানে। বসফরাসের পাড়ে দীর্ঘ হাঁটার রাস্তা আছে। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে যেতে পারবেন।
বেশ। মনে হচ্ছে আমার পছন্দের সঙ্গে মিলে গেছে। ওখানে যাবার জন্য ট্যাক্সি ডাকবো কীভাবে?
কোনো চিন্তা করবেন না। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
কথাটা বলেই আইলিন আমাকে ইশারা করলো ওকে অনুসরণ করতে। গেইটের বাইরে নিরাপত্তা কর্মী। মেয়েটি আমাকে ওর কাছে নিয়ে গেল। তুর্কি ভাষায় ওকে কী কী বললো। নিরাপত্তা কর্মী ফোন করে ট্যাক্সি ডাকলো। তখন আমার মনে হলো, তুর্কি লিরা দরকার। আইলিনকে জানাতেই ও আমাকে একটু হেঁটে এটিএম মেশিনের কাছে নিয়ে গেল। ৫ হাজার লিরা তুলে ফিরে এলাম রাস্তায়, টেক্সির জন্য অপেক্ষা। আমি আইলিনকে বলি,
এবার তুমি ডেস্কে যেতে পারো। অনেকক্ষণ আমার জন্য ডেস্কের বাইরে আছো।
ও বলে,
কোনো অসুবিধা নেই, আপনাকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে আমি ড্রাইভারকে কিছু নির্দেশনা দেব, তারপর যাবো।
৩/৪ মিনিটের মধ্যেই হলুদ ট্যাক্সি চলে এলো। আমাকে কোথায় নামাতে হবে তা বুঝিয়ে দিয়ে আইলিন বিদায় নিলো।
ও মাই গড। এ-কেমন রাস্তা? ৪৫ ডিগ্রির চেয়েও বেশি খাড়া এবং ভীষণ সরু গলিপথ। কিন্তু ড্রাইভার যেন জেমস বন্ড, চালাচ্ছে ঝড়ের গতিতে। গাড়িটা খাড়া গড়াতে গড়াতে, ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া খেলনা গাড়ির মত, নিচে পড়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে আমার সন্দেহই হলো ড্রাইভারের পায়ে কন্ট্রোল আছে তো? নাকি আসলেই ব্রেক ফেইল করে গড়িয়ে পড়ছে। মনে হলো আমরা প্রায় মাইলখানেক সোজা নিচের দিকে নামলাম। ফেরার পথে এই রাস্তা যদি কোনো কারণে আমাকে পায়ে হেঁটে উঠতে হয় তাহলে আমি শেষ।
ভেবেছিলাম পাহাড়ের ঢালুতে একটা নির্জন লোকালয় পাবো, ওমা এ-তো দেখছি এক হুলুস্থুল টাউন। ড্রাইভার জানতে চায়,
এখানে থামাবো?
ও যখন পাহাড় থেকে সমতলে নেমে ডানদিকে বাঁক নিয়েছে তখনই আমি বাঁদিকে তাকিয়ে দেখে নিয়েছি বিপুল নীল জলরাশি। বলি,
হ্যাঁ, এখানেই রাখুন।
বয়স্ক চালক গাড়ি থামাতেই মিটারের দিকে তাকিয়ে দেখি ১৬৫ লিরা,আমি ওর হাতে ২০০ লিরার একটি নোট তুলে দিয়ে নেমে পড়ি। সারি সারি গাড়ি রাস্তায়, কোনো পথচারী পারাপার নেই। হাত দেখিয়ে ঢাকার রাস্তার মত পার হয়ে গেলাম। এবার বাঁ দিকে কিছুদূর এগুতেই লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা বসফরাসের দেখা পাই। নদীর পাড় ধরে ফুটপাত এবং সমান্তরাল বাইক লেইন ছুটে গেছে অন্তহীন দূরে। আমিও পা ফেলি অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটকের সঙ্গে।
বসফরাস ইস্তাঁবুলকে দুভাগ করে দিয়ে কৃষ্ণ সাগরের সঙ্গে মারমারা সাগরকে যুক্ত করেছে। এর দৈর্ঘ মাত্র ৩০ কিলোমিটার। মানচিত্রে বসফরাসকে দেখলে যে কারোরই মনে হতে পারে দুই সাগরকে যুক্ত করার এই চ্যানেলটি সুয়েজ খালের মত মানুষের তৈরি, আসলে তা নয়, এটি প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয়েছে। সম্ভবত প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া এমন সরলরৈখিক নদী পৃথিবীতে বিরল। হয়ত কোনো পাহাড় থেকে এর উৎপত্তি নয় বলেই এটি নদী হিসেবে স্বীকৃত নয় এবং নদীর মত আঁকাবাকাও নয়। বসফরাসের গভীরতা সর্বনিম্ন ১২০ ফুট এবং সর্বোচ্চ ৪০৮ ফুট। এত অল্প গভীর হওয়া সত্বেও কী করে এতো বড়ো বড়ো কার্গো জাহাজ এবং বহুতল যাত্রীবাহী জাহাজ বসফরাসে ঢোকে সেটাই ভাবছি। অবশ্য এই মুহূর্তে যে কার্গো জাহাজটি আমার ডান দিকে ফাতিহ সুলতান মেহমেত সেতুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেটি খালি জাহাজ। হয়ত আনলোড করার পরে কোনো কারণে এখানে ওরা ঢোকে। বসফরাস ভীষণ ব্যস্ত থাকে টুরিস্ট বোট ও যাত্রীবাহী ছোটো ছোটো বোটের ক্রমাগত আসা-যাওয়ায়। ওরা ঢেউ তুলে ধা ধা করে ছুটাছুটি করে। মিনিটে মিনিটেই যাত্রীবাহী বোট আসছে, যাচ্ছে।
সর্বোচ্চ ৩.৭ কিলোমিটার এবং সর্বনিম্ন মাত্র আড়াই হাজার ফুট প্রশস্ত এই সরলরৈখিক জলাশয়।
বেশ কিছু ছবি তোলার পরে নিজের কিছু সেল্ফি তুললাম। এক মধ্যবয়সী লোককে ছবি তুলে দিতে বলায় তিনি হাত ইশারায় নিষেধ করলেন। কিছুটা অপমান বোধ করলাম বটে কিন্তু পর মুহূর্তেই মনে হলো হয়ত তিনি ছবি তুলে দেবেন না, তা বলেননি, বলেছেন, ইংরেজি জানেন না।
একটি যাত্রীবাহী বোট এসে ভিড়লো। বহু মানুষ ওঠার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে। ভিড়ের ভেতরে একজনকে দেখে কিছুটা স্মার্ট মনে হলো। অনুমান করছি ইনি ইংরেজি জানেন। ছবি তুলে দিতে বলায় সানন্দে রাজি হলেন। বেশ সময় নিয়ে আমাকে পোজ ঠিক করতে বলেন এবং নানান নির্দেশনা দেন কোথায় কীভাবে দাঁড়ালে ভালো ভিউ পাবো।
আপনি কি এই শহরের মানুষ?
হ্যাঁ।
বেশ ভালো ইংরেজি বলেন। কী করে শিখলেন?
খুব জোরে একটি হাসি দিলেন ভদ্রমহিলা।
আমিও হাসলাম।
ঠিক জানি না। হয়ত আপনাদের মতো ট্যুরিস্টদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই শিখে ফেলেছি।
আপনি কি কোনো ট্যুর কোম্পানিতে কাজ করেন?
ভদ্রমহিলা আবারো হাসেন।
না, আমি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করি।
তাই তো বলি ছবির ফ্রেম নিয়ে কেন এতো পারফেকশন খুঁজছিলেন।
তিনি আবারও মিষ্টি করে হাসেন। কোনো কথা বলেন না। যেন জমানো কথাগুলো এতো সহজেই খরচ করে ফেলতে চাইছেন না। আমি তখন নিজের নাম বলি এবং প্রশ্ন করি,
আপনি কী করে বুঝলেন, আমি ট্যুরিস্ট?
এটা তো খুবই সহজ। আপনার ভাষা, হাঁটাচলা, দৃষ্টি, সবই বলে দেয়, আপনি একজন ট্যুরিস্ট, বাই দ্য ওয়ে, আমার নাম শেরিফা।
শেরিফা? ওয়াও। আমার দেশেও এই নামের অনেক মানুষ আছে।
কোথায় আপনার দেশ?
বাংলাদেশ।
ও, বাংলাদেশ তো মুসলিম দেশ, শেরিফা নাম তো থাকবেই।
আপনি কি ওপারে, মানে এশিয়ায় যাবেন?
হ্যাঁ।
এপারে কেন এসেছেন?
কাজ করতে।
বাহ, দারুণ তো। ইউরোপে কাজ করেন আর এশিয়ায় বাস করেন।
সত্যিই দারুণ। তবে আমি কিন্তু এপারেই ছিলাম। ২৬ বছর ইউরোপে থেকে গত সপ্তাহে এশিয়ায় গেছি। এশিয়ায় আজ আমার ষষ্ঠ দিন।
কেন গেলেন, এতোদিনের আবাস ফেলে?
এখন বয়স হয়েছে। কোলাহল আর ভালো লাগে না। শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য এশিয়ার দিকটাই ভালো। ওখানে ভীড় নেই, কোলাহল নেই, যানজট নেই, এমন কী ট্যুরিস্টেরও ততটা সমাগম নেই।
আপনি কি আমাকে এশিয়ায় যেতে নিরুৎসাহিত করছেন?
একদম না। আসুন না ওপারে। আমার বাড়িতে চায়ের দাওয়াত।
বেশ। দাওয়াত দিলেন যখন, ভেবে দেখবো। আপনি বোধ হয় এখন ফেরিতে উঠবেন?
না, এটা আমার স্টেশনে যাবে না। আমারটা আসবে আরো কুড়ি মিনিট পরে।
ঠিক আছে, ভালো থাকবেন। আমি বরং আরেকটু এগোই।
আপনার ভ্রমণ আনন্দময় হোক।
আমি মেহমেত সেতুর দিকে আরো একটু এগোই।
বসফরাসে মুখ ফেরানো রাস্তার বাঁ দিকে সারি সারি বেঞ্চ। ওখানে প্রেমিক-প্রেমিকা বসে প্রেম করছে, কেউ তার প্রিয় কুকুর নিয়ে বসে আছে, কেউ বই পড়ছে। মাথায় স্কার্ফ বাঁধা মেয়েদেরও দেখছি ইউরোপীয় দম্পতির মত প্রিয় পুরুষের বাহুলগ্ন হয়ে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে, পরস্পর চুমু খাচ্ছে। মুসলিম সংস্কৃতির একেশ্বরবাদীতা, পর্দা প্রথা, বিনয়, অতিথিপরায়নতা এবং ইউরোপীয় সভ্যতা এই দুইয়ের এক ভীষণ ইতিবাচক সমন্বয় ঘটেছে ইস্তাঁবুলে। মানুষগুলোর মধ্যে পরিচ্ছন্নতাবোধ ঈর্ষণীয় রকমের, অন্যের উপকার করার জন্যও উদগ্রীব, প্রত্যেকেই খুবই মিশুক। আরো একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি উপকার করার ক্ষেত্রে ওদের মধ্যে ইসলামের সেই শিক্ষা ‘ডান হাত দিয়ে দিলে বাঁ হাত যেন টের না পায়’ এর দর্শন দারুণভাবে প্রতিফলিত হয়। কারো মধ্যে কোনো প্রত্যাশা নেই, যেন আমার যা দরকার আমি তা অর্জন করে নেব, কারো কাছে চাইব কেন। মানুষগুলোর মধ্যে চাতুরী একেবারেই নেই বলে মনে হচ্ছে।
আমি এখন সেতুর প্রায় কাছাকাছি। এখান থেকে ছবি তুললে খুব ভালো ভিউ পাওয়া যাবে। একটি বেঞ্চে দুই কিশোরী বসে আছে, এই বয়সের ছেলেমেয়েদের প্রায় সকলেই ইংরেজি জানে এবং ভালো ছবি তুলতে পারে।
লেইলা এবং রুমেইসা দুই বন্ধু। মাথায় স্কার্ফ বাঁধা দুই তরুণী। লেইলার দিকে সেল ফোনটা বাড়িয়ে বলি,
আমার কিছু ছবি তুলে দাও।
ও বড়ো বড়ো চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক তখনই রুমেইসা আমার হাত থেকে ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো। নিয়েই তুর্কি ভাষায় লেইলাকে কিছু একটা বললো, তখন লেইলা আমার কথা না বোঝার জন্য বেশ লজ্জিত হলো। দুজনই চমৎকার ইংরেজি বলে, তখন লেইলা অন্য চিন্তায় ছিল বলে আমার কথাটা ধরতে পারেনি।
আমি ব্রিজের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ালাম। কলেজে পড়ুয়া দুই বান্ধবীর তারুণ্যের উচ্ছাসের মতোই বসফরাস থেকে উত্তাল বাতাস উঠে এসে ধাক্কা দিচ্ছে। আজকের আবহাওয়া কিছুটা উষ্ণ হলেও বাতাসের কারণে একটু ঠাণ্ডাই লাগছে, ভাগ্যিস একটা জ্যাকেট সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম।
ছবি তোলা হয়ে গেলে আরো খানিকটা এগিয়ে গেলাম। ডানদিকে একদল মৎস্যশিকারী বসফরাসে ছিপ ফেলে চণ্ডিদাস হয়ে বসে আছে। ট্রে ভর্তি স্বচ্ছ কাপে রক্তবর্ণ তুর্কি চা নিয়ে চা-বিক্রেতা ছুটে যাচ্ছে বেঞ্চ থেকে বেঞ্চে, ছিপ ফেলা মাছশিকারিদের কাছে। প্রায় সকলেই ওদের ট্রে থেকে চায়ের কাপ তুলে নিচ্ছে এবং ওদের হাতে টাকা গুঁজে দিচ্ছে। কেউ দাম জিজ্ঞেস করছে না এবং ওরাও কে কত দিল তা গুনে দেখছে না। মনে হচ্ছে, বাড়িতে মেহমান এসেছে, চা-অলারা অতিথিদের চা-দিয়ে আপ্যায়ন করছে। আর খদ্দেররাও যেন জোর করে হাতে টাকাটা গুঁজে দিচ্ছে। সত্যিই ওদের সভ্যতায় আমি মুগ্ধ।
বাঁ দিকে পাহাড়ের ওপর বিশাল এক পতাকা উড়ছে, তুরস্কের জাতীয় পতাকা। ইস্তাঁবুলের সর্বত্রই এ দৃশ্য। চাঁদ তারা খচিত একেকটা বিশালাকৃতির লাল পতাকা আকাশে পতপত ধ্বনি তুলে উড়ছে। শব্দটা এতো তীব্র যে যানবাহনের শব্দও এই শব্দের কাছে ম্লান হয়ে যায়। (চলবে)
Posted ১:০০ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh