জাফর আহমাদ | বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪
সাহাবা আজমাইন রা: ছিলেন রাসুল্লাহ সা: এর সংগ্রামমূখর জীবনের সুখ-দু:খের সাথী। সত্য অনুসরণে ও দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁরা ছিলেন এ উম্মতের সর্বোচ্চ ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুলুল্লাহ সা: কর্তৃক প্রদর্শিত সত্যের মানদন্ডে তারা ছিলেন উত্তীর্ণ। রাসুলুল্লাহ সা: এর মিশন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা যে ত্যাগ ও কুরবানী করে গেছেন, তা ইতিহাসের পাতাকে বার বার কাঁপিয়ে তুলে। মিশন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেতাঁরা ছিলেন দিনের বেলায়দিগ্বিজয়ী ঘোড় সওয়ারআর রাতের বেলায় গভীর ইবাদাতে নিমগ্ন আল্লাহর আবেদ। চারিত্রিক মানদন্ডে তাঁরা বিশেষ মানদন্ডে উত্তীর্ণ।
ফলে তাঁদের কেউ কেউ দুনিয়াতেই বেহেশতের সুসংবাদ লাভ করেছেন। আল কুরআনের বেশ কিছু জায়গায় তাঁদের মর্যাদা ও ইসলামী অনুশাসনের প্রতি তাদের একনিষ্ঠতার বর্ণনা এসেছে। যেমন: আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আমার আয়াতের প্রতি তো তারাই ঈমান আনে যাদেরকে এ আয়াত শুনিয়ে যখন উপদেশ দেয়া হয় তখন তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং নিজেদের রবের প্রশংসা সহকারে তার মহিমা ঘোষণা করে এবং অহংকার করে না। তাদের পিঠ থাকে বিছানা থেকে আলাদা, নিজেদের রবকে ডাকে আশংকা ও আকাঙ্খা সহকারে এবং যা কিছু রিযিক আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।”(সুরা আস সাজদা:১৫-১৬)
এ আয়াতটিতে সাহবাদের রা: তিনটি গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।প্রথমত: পুর্ব থেকে তাদের মস্তিস্কে যেই চিন্তা-চেতনা পোষণ বা লালনই করুন না কেন, আল্লাহর আদেশ শোনার পর সেই চিন্তা-চেতনা পরিহার করে আল্লাহর কথা মেনে নেয় এবং আল্লাহর বন্দেগীর পথ অবলম্বন করে, তাঁর ইবাদাত করাকে নিজেদের জন্য সম্মানহানিকর মনে করে না। আত্মম্ভরিতা তাদেরকে সত্যগ্রহণ ও রবের আনুগত্য করার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। দ্বিতীয়ত: আরাম-আয়েশ করে রাত কাটাবার পরিবর্তে তারা নিজেদের রবের ইবাদাত করে।
তাদের অবস্থা এমনসব দুনিয়াপূজারীদের মতো নয় যাদের দিনের পরিশ্রমের কষ্ট দূর করার জন্য রাতে নাচ-গান, শরাব পান ও খেলা-তামাশার মতো আমোদ প্রমোদের প্রয়োজন হয়। এর পরিবর্তে তাদের অবস্থা হচ্ছে ্এই যে, সারা দিন নিজেদের দায়িত্ব পালন করে, কাজ শেষে এসে তারা দাঁড়ায় নিজেদের রবের সামনে। তাকে স্মরণ করে রাত কাটিয়ে দেয়। তাঁর ভয়ে কাঁপতে থাকে এবং তার কাছেই নিজেদের সমস্ত আশা-আকাঙ্খা সমর্পণ করে। বিছানা থেকে পিঠ আলাদা রাখার মানে এ নয় যে, তারা রাতে শয়ন করে না। বরং এর অর্থ হচ্ছে, তারা রাতের একটি অংশ কাটায় আল্লাহর ইবাদাতের মধ্য দিয়ে। তৃতীয়ত: আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ থেকে ব্যয় করে। আল্লাহ সামান্য কিছু পবিত্র রিযিক যা দিয়েছেন তা থেকেই খরচ করে। তার সীমা অতিক্রম করে নিজের খরচপাতি পুরা করার জন্য হারাম সম্পদে হাত দেয় না। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল। আর যারা তাঁর সাথে আছে তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে আপোষহীন এবং নিজেরা পরস্পর দয়া পরবশ।
তোমরা যখনই দেখবে তখন তাদের চেহেরায় সিজদার চিহ্ন বর্তমান যা তাদেরকে আলাদা চিনে নেয়া যায়। তাদের এ পরিচয় তাওরাতে দেয়া হয়েছে। আর ইনযিলে তাদের উপমা পেশ করা হয়েছে এই বলে, যে, একটি শস্যক্ষেত যা প্রথমে অঙ্কুরোদগম ঘটলো। পরে তাকে শক্তি যোগালো তারপর তা শক্ত ও মজবুত হয়ে স্বীয় কাণ্ডে ভর করে দাঁড়ালো। যা কৃষককে খুশী করে কিন্তু কাফের তার পরিপুষ্টি লাভ দেখে মনোকষ্ট পায়। এ শ্রেনীর লোক যারা ঈমান আনয়ন করেছে এবং সৎকাজ করেছে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।”(সুরা আল ফাতহ্:২৯) এ আয়াতে সাহাবায়ে কেরামদের কয়েকটি গুণের বর্ণনা করা হয়েছে।
কাফেরদের প্রতি সাহাবীদের কঠোর হওয়ার অর্থ এ নয় যে, তারা কাফেরদের সাথে রূঢ় এবং ক্রুদ্ধ আচরণ করেন, বরং এর অথ হচ্ছে, তারা তাদের ঈমানের পরিপক্কতা, নীতির দৃঢ়তার চারিত্রিক শক্তি এবং ঈমানী দুরদর্শিতার কারণে কাফেরদের মোকাবেলায় মজবুত পাথরের মত অনমনীয় ও আপোষহীন। তারা চপল বা অস্থিরমনা নন যে, কাফেররা তাদেরকে যেদিকে ইচ্ছা ঘুরিয়ে দেবে। তারা নরম ঘাস নন যে, কাফেররা অতি সহজেই তাদেরকে চিবিয়ে পিষে ফেলবে। কোন প্রকার ভয় দেখিয়ে তাদেরকে স্তব্ধ করা যায় না। কোন লোভ দেখিয়ে তাদের কেনা যায় না। যে মহত উদ্দেশ্যে তারা জীবন বাজি রেখে মুহাম্মদ সা: কে সহযোগীতা করতে প্রস্তুত হয়েছেন তা থেকে তাদের বিচ্যুত করার ক্ষমতা কাফেরদের নেই। তারা তাদের উদ্দেশ্যে ফাটল সৃষ্টি করতে পারে না। উদ্দেশ্য হাসিলে তারা বজ্রকঠোর।
ঈমানদারদের কাছে তারা বিনম্র, দয়া পরবশ, স্নেহশীল, সমব্যাথী ও দু:খের সাথী। নীতি ও উদ্দেশ্যের ঐক্য তাদের মধ্যে পরস্পরের জন্য ভালবাসা, সাযুজ্য ও গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করে দিয়েছে। তারা পরশ্রীমূখর, নিজের প্রয়োজন পূরণের পরিবর্তে অন্যের প্রয়োজন পূরণের প্রতি অধিক মাত্রায় অগ্রাধিকার দানকারী। প্রতিবেশীকে ভূখা রেখে তারা নিজেদের উদর ফূর্তি করেন না। যেমন: তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন,“এবং মু’মিনদের অন্তর পরস্পরের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। তুমি সারা দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ ব্যয করলেও এদের অন্তর জোড়া দিতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের অন্তর জুড়ে দিয়েছেন।
অবশ্যিই তিনি বড়ই পরাক্রমশালী ও জ্ঞানী।”(সুরা আনফাল:৬৩) আরববাসীদের মধ্য থেকে যারা ঈমান এনে রাসুল সা: এর সাথী হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব, স্নেহ, প্রীতি, ভালবাসা সৃষ্টি করে মহান আল্লাহ তাদেরকে একটি শক্তিশালী দলে পরিণত করেছিলেন, এখানে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। অথচ রাসুল সা: এর এ সমস্ত সাথীরা বিভিন্ন গোত্র থেকে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে জাহেলিয়াতের শত শত বছরের শুত্রুতা চলে আসছিল। তাদের অনেকে পরস্পরের রক্ত পিয়াসু ছিলেন। এই কঠিণ পরিস্থিতিতে মাত্র দুই/তিন বছরের মধ্যে ইসলাম ও ঈমানের বদৌলতে তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি হলো। ব্যাপারটি খুব সহজসাধ্য ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তাদের হৃদয়গুলো এমনভাবে জুড়ে দিয়ে সীসা ঢালা মজবুত প্রাচীরে পরিণত করলেন। এ কথাটিই আল্লাহ তা’আলা সুরা আলে ইমরানে উল্লেখ করেছেন,“আল্লাহর তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখো। তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু। তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহ ও মেহেরবানীতে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছো।”(সুরা আলে ইমরান:১০৩)
সিজদা করতে করতে কোন কোন সালাত আদায়কারীর কপালে যে দাগ পড়ে যায় তা এখানে বুঝানো হয়নি। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে আল্লাহভীরুতা, হৃদয়ের বিশালতা, মর্যাদা এবং মহৎ নৈতিক চরিত্রের প্রভাব যা আল্লাহর সামনে মাথা নত করার কারণে বা আল্লাহর আনুগত্যশীলতা স্বাভাবিকভাবেই কোন মানুষের চেহারায় ফুটে উঠে।মানুষের চেহারা একখানা খোলা গ্রন্থের মত যার পাতায় পাতায় মানুষের মনোজগতের অবস্থা সহজেই অবলোকন করা যেতে পারে। একজন অহংকারী মানুষের চেহেরা একজন বিনম্র ও কোমল স্বভাব মানুষের চেহেরা ভিন্ন হয়ে থাকে। একজন দুশ্চরিত্র মানুষের চেহারা একজন সচ্চরিত্র ও সৎমনা মানুষের চেহেরা থেকে আলাদা করে সহজে চেনা যায়।
একজন গুণ্ডা ও দুশ্চরিত্রের চেহেরা-আকৃতি এবং সম্ভ্রান্ত ও পবিত্র ব্যক্তির চেহেরা-আকৃতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাথর্ক্য থাকে। মুহাম্মাদ সা: এর সাথীরা এমন যে, কেউ একবার দেখা মাত্রই অনুধাবন করতে পারতো তারা সৃষ্টির সেরা ও উন্নত চরিত্রের লোক। কারণ তাদের চেহারায় আল্লাহ ভীরুতার দীপ্তি সমুজ্জল ছিল। এ বিষয়টি সম্পর্কে ইমাম মালেক রহ: বলেন, সাহাবীদের সেনাদল যে সময় সিরীয় ভুখণ্ডে প্রবেশ করে তখন সিরীয়ার খৃষ্টানরা বলেছিল: ঈশা আ: এর হাওয়ারীদের চালচলন সম্পর্কে আমরা যা শুনে আসছি এদের চালচলন দেখছি ঠিক তাই।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এ কারণেই যখন ঐ সব কাফেররা তাদের মনে জাহেলী সংকীর্ণতার স্থান দিলো তখন আল্লাহ তাঁর রাসুল ও ঈমানদারদের ওপর প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে তাকওয়ার নীতির ওপর সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত রাখলেন। তারাই এ জন্য বেশী উপযুক্ত ও হকদার ছিল। আল্লাহ জিনিস সম্পর্কেই পরিজ্ঞাত।”(সুরা ফাতাহ:২৬) এ আয়াতে নবী সা: এর সমস্ত সংগী-সাথীদেরকে মু’মিনীন বলা হয়েছে। তাদের প্রতি আল্লাহ তা’আলার প্রশান্তি নাযিলের খবর দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, এসব লোক তাকওয়ার নীতি অনুসরণের অধিক যোগ্য ও অধিকারী।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে থেকে যারা সবার আগে ঈমানের দাওয়াত গ্রহণ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে এবং যারা পরে নিষ্ঠা সহকারে তাদের অনুসরণ করেছে আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আল্লাহ তাদের জন্য এমন বাগান তৈরী করে রেখেছেন যার নিম্নদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হবে এবং তারা তার মধ্যে থাকবে চিরকাল। এটাই মহা সাফল্য।”(সুরা তাওবা: ১০০)
Posted ৪:৫৩ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh