বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ২৭ মে ২০২১
ছবি : সংগৃহীত
করোনা মহামারির ভয়াবহতা কমে আসায় নূতন স্বাভাবিকতায় ফিরছে যুক্তরাষ্ট্র। সাথে সাথে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি। সময়োচিত সরকারী প্রনোদনার কারণে নাগরিকদের এসময়ে অতিরিক্ত আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২ ট্রিলিয়ণ ডলার। ফলে সাধারণ মানুষের বেড়েছে ক্রয় ক্ষমতা। নিউইয়র্ক সহ বিভিন্ন রাজ্যে বাড়ির মূল্য হয়েছে আকাশ ছোঁয়া। বেড়েছে নূতন গাড়ি বিক্রি। ভীড় জমেছে স্বর্ণ সহ বিভিন্ন বিলাসী সামগ্রীর দোকানে। আমেরিকার অন্যান্য জাতি গোষ্ঠির মানুষের মতো বাংলাদেশী আমেরিকান কমিউনিটিতেও এর প্রভাব লক্ষ্যণীয়। সরকারী প্রণোদনা ছাড়াও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অনেকেই পিপিপি লোন ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য প্রদত্ত ঋণ সুবিধা ভোগ করছেন।
কভিড-১৯ মহামারীর ক্ষত কাটিয়ে উঠতে অর্থনীতিতে বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। দ্রুতগতিতে চলছে কভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম। পাশাপাশি শিথিল করা হয়েছে বিভিন্ন বিধিনিষেধও। ফলে গতি ফিরেছে গ্রাহকব্যয় ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে। সব মিলিয়ে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে দৃঢ়ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল অর্থনীতি। শিগগিরই বিশ্বের বৃহত্তম এ অর্থনীতি প্রাক-কভিড স্তরে ফেরার ইঙ্গিতও দেখা যাচ্ছে। আর চলতি বছর অর্থনীতিতে চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী কর্মক্ষমতার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ব্লুমবার্গের সমীক্ষায় অর্থনীতিবিদরা প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছেন। এ প্রবৃদ্ধির পেছনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে ভোক্তাব্যয়ে বার্ষিক ১০ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। এটা ১৯৬০-এর দশকের পর থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গতি। অন্যদিকে রয়টার্সের সমীক্ষায় অর্থনীতিবিদরা ৬ দশমিক ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছেন। এমনটা হলে এটা ২০০৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকের পর দ্বিতীয় দ্রুততম জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে।
পৃথক দুই রাউন্ডে প্রণোদনা চেক ও বিপুল পরিমাণ সঞ্চয় অনেক গ্রাহককে জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়কালে পণ্য ও পুনরায় চালু হওয়া পরিষেবায় অবাধে ব্যয় করতে সহায়তা করেছে। এরই মধ্যে ক্রমবর্ধমান টিকাদান কার্যক্রম অর্থনীতিকে সব ধরনের বিধিনিষেধের বাইরে বের হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। পাশাপাশি ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বিনিয়োগ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো শ্রমিক নিযুক্ত করার আত্মবিশ্বাস সরবরাহ করেছে।
এমন বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক তথ্য পুনরায় চাঙ্গা করে তুলেছে শেয়ারবাজারকে । ফলে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ নতুন রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। একই সময়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় আরো বেশি সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব করেছেন।
অর্থনৈতিক প্রণোদনা ও সব নাগরিকের জন্য কভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম সম্প্রসারণের কারণে এপ্রিলের শুরুতেও গ্রাহকদের আত্মবিশ্বাস ১৪ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে ছিল। এটি গ্রাহক চাহিদা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। মহামারীর এ সময়ে নাগরিকরা কমপক্ষে ২ ট্রিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত সঞ্চয় করেছে। এর আগে গত বছর দেশটির অর্থনীতি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল, যা ৭৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ কর্মক্ষমতা।
রেকর্ড ছাড়িয়েছে বাড়ির দাম : যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ির দাম রেকর্ড ছাড়িয়েছে। গত এপ্রিল থেকেই বাড়তে থাকে বাড়ির দাম। চলতি মাসে এসে তা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে বেড়ে যায়। ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব রিয়েলটরসের (এনএআর) এক প্রতিবেদন অনুসারে এপ্রিলে মধ্যবর্তী বিক্রয়মূল্য ছিল ৩ লাখ ৪১ হাজার ৬০০ ডলার। ১৯৯৯ সাল থেকে এনএআর বাড়ির দামের তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত এটি সর্বোচ্চ মধ্যবর্তী দাম। এসব বাড়ির মধ্যে রয়েছে একক পরিবারের জন্য বাড়ি, টাউনহোম, যৌথ মালিকানার বাড়ি ও সমবায় সমিতির বাড়ি। গত বছরের তুলনায় এ সব ধরনের বাড়ির দাম বেড়েছে অন্তত ১৯ শতাংশ। কেবল একক পরিবারের বসবাসের মতো বাড়িগুলোর দাম গত বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ বেড়েছে। ১৯৭০ সালের পর এবারই প্রথম এ পরিমাণে বাড়ল একক পরিবারের বাসাবাড়ির দাম। দেশটিতে এখন গৃহঋণের সুদের হার অনেক কম। এটিও বাড়ি কেনার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ।তবে দাম বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে বাড়ি বিক্রির হারও। এনএআরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ দিনে রেকর্ড পরিমাণ বাড়ি বিক্রি হয়েছে। এপ্রিলে ৮৮ শতাংশ বেশি বাড়ি বিক্রি হয়েছে। বাড়ি কেনা নিয়েও শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। অনেকেই নগদ মূল্য পরিশোধ করে বাড়ি কিনে নিচ্ছেন। বিশেষ করে বিভিন্ন শহরের ভালো বাড়িগুলো নগদ মূল্যে কিনতে মুখিয়ে আছেন বহু ক্রেতা। তাদের জন্য পিছিয়ে পড়ছেন প্রথমবার বাড়ি কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করা ক্রেতারা। কারণ তারা হয়তো ঋণ নিয়ে বাড়ি কেনার পরিকল্পনা করেছিলেন।
এনএআরের মুখ্য অর্থনীতিবিদ লরেন্স ইউন বলেন, বাড়ির দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনেও রয়েছে এ প্রতিযোগিতার অবদান। প্রতিটি বাড়ি কেনার জন্য অন্তত পাঁচজন লাইনে থাকছেন। এদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই নগদে মূল্য পরিশোধ করতে চান। নগদে মূল্য পরিশোধের পরিমাণও মার্চের চেয়ে এপ্রিলে বেড়েছে। বাড়ির দাম বেড়ে যাওয়া ও নগদ অর্থে তার দাম পরিশোধের এ প্রক্রিয়া জোগান ও চাহিদার ক্ষেত্রে একটি বৈষম্য তৈরি করছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার জোয়েল কান। তিনি বলেন, এ অসম প্রতিযোগিতা পুরো দেশের বাড়ির দামের ওপর প্রভাব ফেলছে। বাড়ির দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক ক্রেতাই পরিকল্পনা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তা কিনতে পারছেন না।
গত বছরের তুলনায় এ বছর ক্রেতাদের মধ্যে বাড়ি কেনার চাহিদা অনেক বেশি। ২০২০ সালের সঙ্গে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ের বাড়ি বিক্রির হিসাব দেখলে সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়। লরেন্স ইউন বলেন, চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য আসতে আরো সময় লাগবে। হয়তো কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে।
কেনাকাটায় আগ্রহী : যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ নাকি আর ঘরে বসে থাকতে চাইছে না। ঘর থেকে বেরিয়ে কেনাকাটা করার জন্য মুখিয়ে আছে তারা। ওয়ালমার্টের প্রধান নির্বাহী সম্প্রতি এ কথা বলেছেন। ওয়ালমার্টের প্রধান নির্বাহী ডৌগ ম্যাকমিলান বলেছেন, ‘বছরের শুরুর তুলনায় সম্প্রতি আমাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।’ বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য বিক্রি বেড়েছে ৬ শতাংশ। তবে এ তালিকায় নেই পেট্রল। ওয়ালমার্টের ভাষ্যমতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, তাতে মার্কিনদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এবার দেশটির নাগরিকেরা ১ হাজার ৪০০ ডলারের চেক পেয়েছেন। তাঁদের হাতে কেনাকাটা করার মতো যথেষ্ট টাকা আছে। এ জন্য খাদ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্যের বিক্রি বেড়েছে। ওয়ালমার্টের তথ্যমতে, জামাকাপড়, ইলেকট্রনিকস ও খেলনাসামগ্রীর বিক্রি বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। ওয়ালমার্ট মনে করছে, মানুষ এই পুঞ্জীভূত চাহিদা মেটানোর প্রয়াস বছরজুড়েই দেখা যাবে। এ পরিস্থিতিতে মুনাফার হিসাব-নিকাশ শুরু করে দিয়েছে ওয়ালমার্ট। তাদের হিসাব, এ বছর তাদের প্রায় দুই অঙ্কের ঘরে প্রবৃদ্ধি হবে। একই সঙ্গে ম্যাকমিলানের কণ্ঠে সতর্কতার সুরও শোনা গেছে। তাঁরা মনে করছেন, প্রণোদনা প্যাকেজের প্রভাব আছে ঠিক, কিন্তু বছরের দ্বিতীয় ভাগে যথেষ্ট অনিশ্চয়তাও থাকবে। তবে বছরের প্রথম প্রান্তিকে ওয়ালমার্টের মুনাফা কমেছে প্রায় ৩২ শতাংশ। এই সময়ে তাদের মুনাফা হয়েছে ২৭০ কোটি ডলার। যুক্তরাজ্য, জাপান ও আর্জেন্টিনায় ব্যবসা খারাপ হওয়ার কারণে মুনাফা কমেছে তাদের।
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় অনলাইন বিক্রিও কমতে শুরু করেছে। এপ্রিল মাসে অনলাইন বিক্রির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৭ শতাংশ। অথচ গত বছরের এপ্রিলে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭৪ শতাংশ। তখন অবশ্য লকডাউন চলছিল। মানুষ ঘর থেকে বেরোতে পারত না। তাই হঠাৎ অনলাইন বিক্রির পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। ওয়ালমার্ট আরও জানিয়েছে, এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রেতাদের আগমন হঠাৎই বেড়ে গেছে। গত এক বছরে এমনটা দেখা যায়নি। এর অর্থ হচ্ছে, দুই ডোজ টিকাপ্রাপ্ত মানুষেরা এখন অনেকটা স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা শুরু করেছেন। দেশটির সিডিসি বা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বিভাগ সম্প্রতি মাস্ক ব্যবহার নিয়ে নতুন নির্দেশনা জারি করেছে। তারা বলেছে, দুই ডোজ টিকাপ্রাপ্ত মানুষেরা এখন মাস্ক ছাড়াই রাস্তায় হাঁটতে পারবেন, যদি ভিড় না থাকে। তবে ভিড়ের মধ্যে গেলে মাস্ক পরে যেতে হবে। অনলাইন বিক্রি বৃদ্ধিতে ওয়ালমার্ট এখনো অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যাচ্ছে। এক দিনে সরবরাহসহ পোশাকের ভার্চ্যুয়াল ট্রায়ালের ব্যবস্থাও করেছে তারা। লক্ষ্য, আমাজনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা।
Posted ২:১৩ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৭ মে ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh