সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫ | ২৫ কার্তিক ১৪৩২

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

রম্য রচনা

কাবাডি ম্যাচ

মো. মোশাররফ হোসেন :   |   বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কাবাডি ম্যাচ

ছবি : সংগৃহীত

আষাঢ় মাস, আকাশের কান্না থামছেই না। একটানা ঝমঝম বৃষ্টি, দরিদ্রের ঘরে বৃষ্টি মানে চাল নেই, খড়ি নেই, আর চুলায় কেবল ধোঁয়ার স্মৃতি। ঠিক এই সময়ে গোলাপদি চাচা তার পীর সাহেব কেবলাকে সাথে নিয়ে বাড়িতে হাজির। পীর কেবলাকে দেখেই আমাদের চাচি মানে গোলাপদি চাচার স্ত্রী তাহমিনা বেগম তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। অতিথি মানেই রান্নাবান্নার হুলস্থুল আর কাঁড়িকাঁড়ি টাকার বাপের শ্রাদ্ধ। কিন্তু তার ঘরেতো এই বৃষ্টির দিনে, ডাল-ভাতেরও জোগাড় নেই! এমনকি চুলা ধরানোর জন্য যে শুকনো লাকড়ি দরকার হয় তাও নেই, বৃষ্টিতে ভিজে সব একাকার।

যখনকার কথা বলছি তখন গ্রামেগঞ্জে আজকের মত এত সুন্দর সুন্দর রাস্তা ছিল না। আষাঢ় মাসের বৃষ্টির নামাজ শুরু হলে রাস্তাঘাটে কাদা থৈথৈ করত। গোলাপদি চাচা আবার ছিলেন অনেক পীর ভক্ত লোক। পৃথিবীতে পীরের উপরে তার কাছে আর কোন বস্তু ছিল না। গোলাপদি চাচা মনে করতেন এই পীরকে রাজি খুশি রাখতে পারলে তার জন্য পরকালে বেহেশত ওয়াজিব হয়ে থাকবে। কিন্তু তাহমিনা চাচী ঠিক তার বিপরীত, তিনি এইসব পীর বুজুর্গ পছন্দ করতেন না। তার ভাষ্য এই যে, পীরের দোয়া যদি আল্লাহর কাছে কবুল হয় তাহলে পীর তার নিজের জন্য দোয়া করবেন মুরিদানের জন্য নয়। তাই তিনি অত্যন্ত রেগে গিয়ে গোলাপদি চাচাকে বললেন, খুব যে ধিন ধিন করে পীর সাহেব কে বাড়িতে নিয়ে আসলে, শুধু পীর না তার সাথে আবার একজন তালবেলেমও নিয়ে আসা হয়েছে, ঘরে যে ডালভাতের ব্যবস্থাও নাই সেদিকে কোন খেয়াল আছে, তাদের খাওয়াবে কি তোমার মাথা আর মুন্ডু? তাহমিনার ধমক খেয়ে গোলাপদি চাচা ফিসফিস করে বললেন যে, কোন অসুবিধা নাই, তুমি মোটামুটি রেডি হও। আমি বাজার থেকে সদাই করে আনছি। তাহমিনা চাচি জানেন যে, তার স্বামীর পকেটে টাকা না থাকলেও আজ ধার করে পীর সাহেবের জন্য গরুর মাংস কিনবেন। তাই মরিচ-মসলা বাটার জন্য পাটাপুতো (শিলনোড়া) ধুয়েমুছে রাখার আয়োজন শুরু করলেন।

এদিকে পীর সাহেবের আবার পুরনো অভ্যেস, হুক্কা না টানলে পেটের ভাত হজম হয় না। তাই তার সাথে থাকা বারোতেরো বছরের তালেবে-এলেমকে পাঠালেন ভিতর বাড়ি থেকে আগুন নিয়ে আসার জন্য।
তালবে-এলেম ভিতর বাড়িতে গিয়ে দেখে তাহমিনা বেগম পাটাপুতো ঘষাঘষি করছেন, পাটায় কোনো হলুদমরিচ নেই। সে আরও লক্ষ্য করলো যে তাহমিনা বেগমের পাশে একটি বড় পুতো পড়ে আছে আর হাতে ছোট একটি পুতো নিয়ে পাটার উপর ঘষাঘষি করছেন! ছেলেটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, খালা পাটায়তো কিছুই নেই! এই খালি শিলনোড়া ঘষছেন কেন? আর একটা পাটায় দুইটা পুতো দিয়ে কি হবে?

তাহমিনা বেগম কিছুটা উষ্মা আর কিছুটা কৌতুক নিয়ে বললেন, এই দুটো পুতো দিয়ে আমার স্বামী তোদের দুজনের দাঁত ভাঙবে। কারণ আষাঢ় মাসের এই অভাব অনটনের দিনে তোদের দুজনই পরের বাড়ি খেতে খেতে দাতগুলো লম্বা করে ফেলেছিস, তাই আমার স্বামী সেগুলো আজ ভেঙ্গে সাইজ করে দিবে। আর এই দুইটা পুতো হচ্ছে এই জন্য যে, বড়টা দিয়ে তোর পীর সাহেবের দাঁত ভাঙা হবে আর তুই ছোট মানুষ তাই বড়টা তোর মুখে ঢুকবে না বলে এইটা ঘষে ছোট করছি যাতে তোর মুখের মধ্যে ঢুকানো যায়।

ছেলেটি অনেকটাই হাবাগোবা টাইপের, তাই সে বড় বড় চোখ করে তাহমিনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনার স্বামী কোথায়? তাহমিনা জবাবে বললেন যে, তার স্বামী বাজারে গেছে দড়ি কিনতে আর তার দু একজন বন্ধুবান্ধবকে ডাকতে। কারণ, দাঁত ভাঙাতো আর সহজে কথা নয়। তাই আগে তোর পীর আর তোকে দড়ি দিয়ে বাঁধতে হবে, কিন্তু আমার স্বামী তো আর একা তোর পীরের সাথে পারবে না, তাই তার বন্ধুবান্ধব সাহায্য করবে।
ছেলেটার চোখ কপালে!সে ভাবল, হুজুরের দাঁত ভাঙবে? এটা তো বড্ড বিপজ্জনক!

আরতো দেরী করা যায় না। মহিলার স্বামী যখন তখন বাড়িতে চলে আসতে পারে, আর এলে যে কি অবস্থা হবে তা শুধু একমাত্র আল্লাহই জানেন। তাই সে দৌড়ে গিয়ে পীর সাহেবকে বলে, হুজুর অবস্থা ভাল নয় জলদী আমাকে নিয়ে পলান তা না হলে দাঁত আর একটাও মুখে থাকবে না।

খবর শুনেই পীর সাহেবের মুখের রঙ কাগজের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তাহলে গোলাপদি তলে তলে এই মতলব করে বসে আছে। পীর সাহেবের মনে পড়ল কয়েকদিন আগে গোলাপদি তার কাছে দ্রুত ধনী হওয়ার জন্য আমল জানতে চেয়েছিল। ধনী হওয়ার কথা শুনে পীর সাহেব তাকে বকাঝকা করেছিলেন এবং নাদান নাপাক বলে গালাগালি করেছিলেন। গোলাপদি হয়তো সেই গালাগালির প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই আজকে এরকম বৃষ্টির দিনে সব ব্যবস্থা করেছে, যাতে রশি দিয়ে বেঁধে দাঁত ভেঙে দিলেও পাড়াপড়শি না জানতে পারে। পীর সাহেব মনে মনে বললেন, বিষয়টা সুবিধার নয়, দাঁতটাত ভাঙা কোন মজার ব্যাপার নয়! তাই আর কাল বিলম্ব না করে তিনি তালবে-এলেমকে সাথে নিয়ে চুপি চুপি বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় নেমে পড়লেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পলায়ন করতে হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গোলাপদি চাচা বাজার থেকে ফিরে দেখেন পীর সাহেব উধাও! তিনি তাহমিনা বেগমকে জিজ্ঞেস করলেন যে, হুজুর কোথায়? তাহমিনা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাবে বললেন, তোমার পীর সাহেব রাগ করে চলে গেছেন। কারণ উনি এই পুতো আর গরু বাঁধার জন্য নতুন পাকানো রশিটি চেয়েছিলেন আমি দিইনি। গোলাপদি চাচা হায় হায় করে উঠলেন, কি করেছিস! পীর সাহেব কিছু চাইলে তা না দিলে কি হয় জানিস? এক্কেবারে গুনাহে কবিরা! হায়রে হায় আমিতো এই খাণ্ডারনী মেয়ে মানুষের জন্য আখের পরকাল সবই হারালাম। তাড়াতাড়ি দে ওগুলি! যেভাবেই হোক ওগুলো পীর সাহেবের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। বলতে বলতে তিনি ছোঁ মেরে পাটাপুতা আর গরু বাঁধার জন্য নতুন পাকানো দড়ি হাতে নিয়ে নিলেন এবং ছুটলেন পীর সাহেবের সম্ভাব্য পথের দিকে। সেই সঙ্গে পীরের আরো দু’জন মুরিদান আনেছ আর দানেছও গোলাপদী চাচার সাথে ছুট লাগালো।
কিছু দূর গিয়ে সত্যিই পীর সাহেবকে দেখতে পেয়ে গোলাপদি চাচা দূর থেকে চিৎকার করতে লাগলেন—
হুজুর! হুজুর! এই যে পুতো (শিলনোড়া) আর দড়ি!

পীর সাহেব ঘুরে তাকাতেই দেখলেন গোলাপদি মাথার উপর সেই কথিত পুতো আর দড়ি উঁচিয়ে ধরে এগিয়ে আসছে! তার পেছনে আরো দু’একজন লোক দেখা যাচ্ছে। তালবে এলেমের কাছে শোনা তাহমিনা বেগমের বক্তব্য সব মিলে যাচ্ছে। ঐ দড়ি দিয়ে বেঁধে পুতো বা শিলনোড়া দিয়ে দাঁত ভাঙার জন্যই গোলাপদি প্রবল পরাক্রমে ছুটে আসছে! পীর সাহেবের চোখ কপালে উঠে গেছে, এবার তো দাঁত-টাঁত সব শেষ! গোলাপদি ধরতে পারলে আর রেহাই নাই!
গোলাপদীর সাথে পীর সাহেবের দূরত্ব ক্রমেই কমে আসছে। দাঁত বাঁচাতে তিনি শেষমেষ একেবারে লুঙ্গি কাছা মেরে কাদামাখা রাস্তায় দৌড় লাগালেন। তালেবে-ইলমও দৌড়াচ্ছে তার সাথে, পেছনে গোলাপদী দৌড়াচ্ছেন পীর সাহেব কেবলাকে ধরার জন্য আর মুখে বলছেন হুজুর এই যে দড়ি আর পুতো।

বৃষ্টি পড়ছে, কাদা ছিটছে আর রাস্তায় ছপা ছপাৎ শব্দ করে দৌড়। এ দৃশ্য দেখে রাস্তার মানুষ ভাবল, যেন কাবাডি ম্যাচ চলছে! পীর সাহেব আর তালেবে-ইলমের হাঁপাতে হাঁপাতে সেই দৌড় আর গোলাপদী চাচার দড়ি আর পুতো (শিলনোড়া) উঁচিয়ে হুংকার, সব মিলিয়ে গ্রামে সেই দিনটাকে মানুষ স্মরণ করে তাদের দেখা সেরা কাবাডি ম্যাচ বলে অভিহিত করে আজও।

Posted ১১:০৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

গল্প : দুই বোন
গল্প : দুই বোন

(8704 বার পঠিত)

অমর জিয়া
অমর জিয়া

(2059 বার পঠিত)

ঠ্যালা সামলা!
ঠ্যালা সামলা!

(2040 বার পঠিত)

আইসবার্গ থিওরী
আইসবার্গ থিওরী

(1852 বার পঠিত)

বন্ধন
বন্ধন

(1442 বার পঠিত)

ছিপ
ছিপ

(1403 বার পঠিত)

খড়কুটো

(1306 বার পঠিত)

বৃক্ষ, অতঃপর
বৃক্ষ, অতঃপর

(1209 বার পঠিত)

কেউ ভালো নেই
কেউ ভালো নেই

(1156 বার পঠিত)

কুহক ও কুহকী
কুহক ও কুহকী

(1129 বার পঠিত)

একটা বোবা ছেলে
একটা বোবা ছেলে

(1108 বার পঠিত)

প্রত্যাশা
প্রত্যাশা

(1103 বার পঠিত)

রম রোদ
রম রোদ

(1055 বার পঠিত)

গাঁয়ের বিল
গাঁয়ের বিল

(1025 বার পঠিত)

কষ্ট নিদারুণ
কষ্ট নিদারুণ

(1004 বার পঠিত)

কবিকে ভয় কেন
কবিকে ভয় কেন

(987 বার পঠিত)

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

86-47 164th Street, Suite#BH
Jamaica, New York 11432

Tel: 917-304-3912, 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.