রবিবার, ৩ নভেম্বর ২০২৪ | ১৮ কার্তিক ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

চৌদ্দ বছর পর কেমন দেখছি বাংলাদেশকে

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু :   |   বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

চৌদ্দ বছর পর কেমন দেখছি বাংলাদেশকে

চৌদ্দ বছরের বনবাস কেবল ভগাবান রামের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাঁর কারণে তাঁর স্ত্রী ও কণিষ্ঠ ভ্রাতা লক্ষ্মণকেও চতুর্দশ বর্ষ বনবাস কাটাতে হয় রাক্ষসদের ভূখণ্ডখ্যাত ‘দণ্ডকারণ্যে’। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাকে চতুর্দশ বছর “জনারন্যে”, বা “নগরবাসে” থাকতে হয়েছে। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে কোনো হাসপাতাল পরিদর্শন করতে হবে বলে ভাবিনি।

নিউইয়র্ক থেকে মানবাধিকার নেত্রী কাজী ফৌজিয়া জানিয়েছেন কবি ও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আমি যেন তাঁকে দেখতে যাই এবং নিউইয়র্কে তার ভক্তদের উদ্বেগ ও তার সুস্থতা কামনার কথা জানাই।

আমি যাব বলে সম্মত হলেও ঢাকায় কোথাও যাওয়া হাশরের ময়দানে বান্দার “ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি” করার শামিল। একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, আমি কীভাবে বলি যে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। ফরহাদ মজহারের সঙ্গে যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় এবং একদিন ফোনে কথা বলার স্মৃতি ছাড়া তার সাথে আমার ঘনিষ্টতা নেই। তিনি আমার লেখালেখি সম্পর্কে জানেন, এটুকুই আমার জন্য যথেষ্ঠ। তার কণিষ্ঠ ভাই ফয়সালের সাথে বরং পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা অধিক। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বেশ জুনিয়র।

বিগত দেড় দশকের শেষ বছরগুলোতে যারাই বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন, তাদের মধ্যে এমনকি কট্টর বিএনপি-পন্থীরাও স্বীকার করেছেন, দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমনই হোক, দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। তাদের প্রত্যেকে পদ্মা সেতু দেখে গেছেন, ও সেতুকে ব্যাকগ্রাউণ্ডে রেখে ছবি তুলেছেন, গভীর রাতে মাওয়া ঘাটে গিয়ে ভাজা ইলিশ মাছ খেয়েছেন, কেউ কেউ মেট্টোরেলে উঠেছেন, অনেকে একটু দূরের সাজেক ভ্যালিতে গেছেন। দারিদ্র সদ্য কাটিয়ে উঠার পর্যায়ের একটি দেশের জন্য রাজধানীতে মেট্টোরেল, পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী টানেল বিরাট ব্যাপার।

ফরহাদ মজহারকে দেখতে যাওয়ার আগে আমি দু’দিন বের হয়েছিলাম। উন্নয়ন দেখার জন্য আমি মিরপুর ১১ থেকে বাসে উঠে বাংলামটর যাই। মেট্টোতে উন্নয়ন দেখা সম্ভব নয়। রাস্তায় যান চলাচলের কোনো মা-বাপ নেই। কত রকমের যানবাহন – বাস, রিকশা, প্যাডেল রিকশা ও ব্যাটারি-চালিত রিকশা, থ্রি-হুইলার, ট্রাক, ভ্যান, ডাবল ডেকার বাস, মোটর সাইকেল – এক রাস্তা দিয়ে চলছে সব। বাস এগোয় না। যেকেউ যেকোনো স্থানে হাত দেখালেই বাস থামে ও যাত্রী উঠায়। মনোযোগ দিয়ে হেঁটে গেলেই বাসের গতির সাথে পাল্লা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ফুটপাত জুড়ে দোকানপাট ও মালামালের স্তুপের কারণে কারও পক্ষে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার।

দুদিনে মোটামুটি রাজধানীর উন্নয়ন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভের পর মেট্টোতে যাতায়াত শুরু করি। ফরহাদ মজহারকে দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মেট্টোতে উঠি এবং আগারগাঁও স্টেশনে নেমে হাঁটতে থাকি। যেহেতু ফুটপাত দোকানিদের দখলে, অতএব মূল রাস্তার প্রান্তভাগ দিয়ে হাঁটছিলাম, রিকশার ফাঁকফোকর দিয়ে। প্রখর রোদ, তাপমাত্রার আধিক্যে দর দর করে ঘামছিলাম।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন রোগব্যাধির চিকিৎসা ও গবেষণায় এ এলাকায় সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা অধিক। অর্থপেডিক হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল, কিডনি হাসপাতাল, চক্ষু হাসপাতাল, হৃদরোগ হাসপাতাল, এবং সোহরাওয়ার্দি হাসপাতাল। এসব হাসপাতাল থেকে রোগী ছিনিয়ে নিয়ে চিকিৎসা করার নামে রোগীদের পরিবারের গলা কাটার জন্য মিরপুর রোডের উল্টো দিকে উপরোক্ত ডিসিপ্লিনের বহু সংখ্যক ছোটবড় প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতাল গড়ে উঠেছে।

সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালের প্রবেশপথ জুড়ে রীতিমতো বাজার। একটু এগুতেই ইউনিফর্ম পরা নার্স ও তাদের সহযোগী স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা অবস্থান ধর্মঘটে বসেছে। তাদের ডিঙ্গিয়ে হাসপাতালের প্রথম বারান্দায় হাজার হাজার লোক বিভিন্ন কাউন্টারের সামনে দাঁড়ানো। ফরহাদ মজহারের অ্যাটেনডেন্ট আরিফ বিল্লাহকে ফোন করে নির্দেশনা জেনে নিলাম। ৫ তলায় ভিআইপি কেবিন নং ৫১২। করিডর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়্ওা ধৈর্যের চরম পরীক্ষা। করিডর দিয়ে শতশত লোক যাচ্ছে, আসছে। যেন চলমান মিছিল। তাদের কলরবে স্থানটি হাসপাতাল কিনা সংশয় হতে পারে। করিডোরে বেশ ক’জন শারীরিক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকের সাক্ষাৎও পেলাম। তিনটি লিফটের সামনেই বহু লোকের ভিড়। সিঁড়ি বেয়ে গেলে হাঁপিয়ে উঠতে পারি ভয়ে লিফটের অপেক্ষা করলাম। তৃতীয় বারের চেষ্টায় লিফটে আশ্রয় পেলাম। স্ট্রেচারে এক মহিলা রোগীসহ জনা পনের লোক উঠেছি। ওজন বেশি হয়ে গেছে।

লিফটম্যান নামতে বললেও কেউ নামে না। একজন অপরজনকে নামতে বলে। আমি বয়সে বৃদ্ধ এবং লিফটের ভেতরের দিকে ছিলাম, অতএব আমাকে যে নামতে হবে না, তা নিশ্চিত। দু’একজন কলহে মেতে উঠল: বাঙালি জাতির মত খারাপ জাতি যে আর দুনিয়ায় নাই, কবে কোথায় উপর থেকে লিফটের স্টিলের রশি ছিড়ে ধপাস করে নিচে পড়ে ক’জন লোক মারা গেছে, এসব প্রসঙ্গও এলো। কলহের সময়ের মধ্যে একবার লিফট ওপরে উঠে নেমে আসতে পারত।

দরজার দিকের ক’জন নিতান্ত অনিচ্ছায় নেমে গেলে লিফট ওপরে উঠল। পাঁচতলায় পৌছার সময়ের মধ্যে ঘেমে গেঞ্জি ভিজে শার্টও সিক্ত হয়ে গেছে। পকেটের চার-পাঁচটি টিস্যু কপালের ঘাম মুছেই শেষ হয়েছে। ৫১২ কেবিনের সামনে পৌছলে অস্ত্রধারী প্রহরী স্যালিউট দিয়ে মুখে আসসালামু আলাইকুম বললেন। বয়সের একটা দামও আছে। আমি সালামের উত্তর দিয়ে জুতা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ফরহাদ ভাই ঘুমাচ্ছেন। মুখ দেওয়ালের দিকে। তিনজন লোক ছিলেন, তাদের একজন বললেন,ডাক্তার বলেছেন, যত ঘুম হয় তত ভালো। প্রচুর ঘেমেছি। পানি পান করার পর বসে অপেক্ষা করলাম, যদি ঘুম ভাঙে তার সাথে কথা বলে যাব। আধ ঘন্টায় তার ঘুম না ভাঙলে অধীর চন্দ্রের কাছে কাগজ কলম নিয়ে একটা নোট লিখে বিদায় নিলাম।

প্রতিদিন বের হওয়া কঠিন। আহমদ পাবলিশিং পাশা ভাইকে কল করলাম। তিনি কণ্ঠ শুনেই চিনলেন এবং আমি ঢাকায় জেনে উচ্ছসিত হলেন। এরপর ফোন করলাম আমার মম ফাতেমা আবেদিন নাজলাকে। কয়েক দফা হ্যালো হ্যালো এবং মম মম বলার পরও আমার কণ্ঠ শণাক্ত করতে না পেরে ‘ভাইয়া’ ‘ভাইয়া’ বলছিল। আমি হতাশ হয়ে বললাম, ‘প্রচন্ড গরমে পুত্রও ভাই হয়ে যায়।” অবশেষে চিনতে পেরে “চাচা” “চাচা” বললো। তার এন’স কিচেনের লোকেশন জেনে নিলাম। পরের কল করলাম সুমনকে। ফোন ধরলে বললাম “সুমন ভাইয়া, আমি মঞ্জু,” সুমন ভাই বলে উঠে, “কোন মঞ্জু? আমি শত শত মঞ্জুকে চিনি।” কি বিপদের কথা! অনুপস্থিতি আপনজনকেও এভাবে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে দেয়।

সুমন ভাই শেষ পর্যন্ত চিনতে পারে। কিন্তু সে প্রেস ক্লাবে। আমি কাছাকাছি দূরত্বের সবার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। পাশা ভাইয়ের সাথে কথা শেষ করে টিপটিপ বৃষ্টি মধ্যে আবাহনী মাঠের উল্টো দিকে এন’স কিচেনের কাছে পৌছলে মম বের হয়ে এসে আমাকে নিয়ে গেল। আহ কি শান্তি!

পরের গন্তব্য গ্রিন রোড। ডেন্টিস্ট বন্ধু আবদুল্লাহ খানের চেম্বার। দীঘদিন পর তার সাথে সাক্ষাৎ। তিনি রেকর্ড দেখলেন ২০০৫ সালে শেষবার তার কাছে দাঁতের চিকিৎসা করিয়েছি। তার হিজাব পরিহিতা তরুণী টেকনিশিয়ানকে বললেন, দেখো এই স্যার ২০ বছর পর এসেছেন। মেয়েটিকে বললাম, তোমার বয়সও তো ২০ হয়নি। সে বলে, না ২৩ হয়েছে। করোনা মহামারী আবদুল্লাহ ভাইয়ের পারিবারিক জীবনে বিপর্যয় এনেছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভাবি মারা গেছেন। তার ছোট ভাইও মারা গেছেন করোনায়। আল্লাহ তাদের জান্নাত নসীব করুন। আমরা গল্পগুজব ও স্মৃতিচারণ করলাম।

তিনি আমার দাঁতের চিকিৎসার প্রাথমিক কাজগুলো সারলেন। আগামী সপ্তাহে আবার যেতে হবে। শেষ গন্তব্য কাঁটাবনে কনকর্ড টাওয়ারে তরুণ প্রকাশক আবু বকর সিদ্দিক রাজু’র প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান স্ব অ। বেশ অন্ধকার। তার ওপর বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির মধ্যে হেঁটেই যাব। কিন্তু গ্রিন রোড থেকে বামে এলিফ্যান্ট রোডের দিকে টার্ন না নিয়ে ডান দিকে টার্ন নিয়ে দুটি রাস্তা পার হওয়ার পর ভুল ভেঙেছে। আমি সচরাচর দিকভ্রান্ত হই না। ট্রাফিক সামলাতে ব্যস্ত এক তরুণ পুলিশ সদস্যকে বললাম, “এলিফ্যান্ট রোড কোনটি?” বেচারা সরল কনস্টেবল হেসে বলল, “আংকেল আমি ঢাকায় নতুন এসেছি। আমি কিছু চিনি না।” আমিও হেসে তার পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে বললাম, “সমস্যা নেই। আমি জেনে নিচ্ছি।” এক রিকশাচালক আমাকে এলিফ্যান্ট রোড দেখিয়ে দিল। রাজুর শোরুমে কিছু সময় বসে মেট্টো ধরতে শাহবাগ গেলাম।

Posted ১২:১৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আমরা মরি কেন?
আমরা মরি কেন?

(705 বার পঠিত)

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বু বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩১৫
১৬১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭
৩০  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

86-47 164th Street, Suite#BH
Jamaica, New York 11432

Tel: 917-304-3912, 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: weeklybangladesh@yahoo.com

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.