বাংলাদেশ অনলাইন : | বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫
ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো বহু কাক্সিক্ষত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর স্বাক্ষর সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে। জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় গত ১৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং দেশের ২৪টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে স্বাক্ষরিত এই দলিল কেবল একটি রাজনৈতিক চুক্তি নয়, বরং এটি নাগরিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের একটি সামাজিক চুক্তি। গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্নকে ধারণ করে রচিত এই সনদ প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ভাষায় ‘নবজন্ম’। বর্বরতা থেকে সভ্যতায় যাত্রা শুরুর নামান্তর।
দীর্ঘদিনের আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে এই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। আলোচনায় অংশ নেয়া ৩০টি দলের মধ্যে ২৪টি দল সনদে সই করেছে। সই করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসসহ কমিশনের সদস্যরাও। প্রায় এক বছরের আলোচনা ও চেষ্টার পর সনদ স্বাক্ষর হলো; কিন্তু যে জুলাই বিপ্লব নিয়ে এ সনদ সেই বিপ্লবের সম্মুখ সারির অংশীজনদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি সনদে স্বাক্ষর করেনি। আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তা ছাড়া তারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবেন না বলে আগেই জানিয়েছিলেন। সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিদেশী দূতাবাসের প্রতিনিধি, বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। এটি একধরনের সামাজিক চুক্তি। যেমনটি বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি নয়। এটি হচ্ছে প্রত্যেক নাগরিকের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর এবং রাষ্ট্রের একটি সামাজিক চুক্তি।
সনদে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সুনির্দিষ্টভাবে অঙ্গীকার করছে, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে এ সনদ গ্রহণ করছে। তাই সনদটি সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা উপযুক্তভাবে সংযুক্ত করার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। জুলাই জাতীয় সনদের বৈধতা বা প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা হবে না; বরং এর প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হবে। একই সাথে দলগুলো এ অঙ্গীকারও করেছে, জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, অন্তর্বর্তী সরকার সেগুলো কোনো রকম বিলম্ব ছাড়া দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করবে। অতএব, ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন কোনো দলের পক্ষে এ চুক্তির ব্যত্যয় ঘটানো কঠিন হবে; কিন্তু বাংলাদেশে এমন উদাহরণ আছে। শঙ্কার জায়গা সেটিই। নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পর সে সময়ের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক জোট এমন একটি অঙ্গীকারে পৌঁছেছিল।
তিন জোটের সেই রাজনৈতিক রূপরেখা পরে বাস্তবায়ন হয়নি। নব্বইয়ের সেই অঙ্গীকার পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুতরাং এনসিপির আশঙ্কা অমূলক এমন বলার সুযোগ নেই। তারপরও রাজনীতিক ও বেশির ভাগ বিশ্লেষক গত শুক্রবার স্বাক্ষরিত জুলাই সনদ নিয়ে উৎসাহী। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এ সনদ সারা বিশ্বের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে। বিএনপি এটিকে স্বাগত জানিয়েছে। জুলাই বিপ্লবের অন্যতম প্রধান নির্মাতা জামায়াতে ইসলামী সরকারের প্রতি অবিলম্বে এর আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করার কথা বলেছে। রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক প্রফেসর দিলারা চৌধুরী বলেছেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না থাকলে দেশ সঙ্কটে পড়বে এবং আগামী নির্বাচনও ঝুলে যেতে পারে। তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর বিপ্লবী সরকার গঠন করতে না পারা একটা ভুল ছিল। সরকারব্যবস্থার সঙ্কট তখনই তৈরি হয়েছে। এমন এক জটিল বাস্তবতায় শুধু জুলাই সনদের অঙ্গীকারের ওপর ভিত্তি করে জুলাই বিপ্লবী ও পরবর্তী সরকারের বৈধতা নিশ্চিত হবে কি না তা এখনো ভেবে দেখার সুযোগ আছে। জুলাই সনদকে দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন এবং আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য কমিশনকে আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সুপারিশ করতে হবে।
সনদে স্বাক্ষরকারী দলগুলোর এখন প্রধান দায়িত্ব হলো এই সামাজিক চুক্তিকে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা। কোনোরকম শঙ্কার কারণ যেন না থাকে সেটি নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্ট সবার জন্য জরুরি।
Posted ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh