সেতারা কবির সেতু | বৃহস্পতিবার, ০৭ জানুয়ারি ২০২১
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
বাবার কথা শুনে ছেলে কিছুটা অবাক হলো আর ভাবতে লাগলো, বাবার কি মাথা খাবাপ হয়েছে! ভোর বেলা এসেছে এ কথা বলতে। সকালে নাস্তা করে আড়তে যাওয়ার সময় মাকে বলে মা বাবার কি হয়েছে? মা কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ছেলের হাতদুটি ধরে বলে, তোরা নতুন বাসায় না গেলে হয়না বাবা। এতো বড় বাড়ি এখানে থাকতে তো তোদের কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। মায়ের কথা শুনে ছেলে কিছুটা বিরক্ত হলো। মাকে বললো, মা তুমি একথা বলছো কেন? আমরাতো আর দেশের বাহিরে যাচ্ছি না। শুধুমাত্র নতুন বাসায় যাচ্ছি। আর বাবা ও তোমাকে আমাদের সাথে যাওয়ার কথা বলেছিতো।
মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, আমারা তোর সাথে গেলে তোর ছোট বোন কার কাছে থাকবে। কোথায় থাকবে মানে? এতো বড় বাড়ি সে এখানেই থাকবে। তাছাড়া আমাদের সাথে গেলে আমি আমার বন্ধু, আত্নীয়, স্বজন, শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে কি বললো। বোনের ডিভোর্স হয়েছে তারপর থেকে সে আমার কাছে থাকে। তুমিই বলো মা এতে সমাজে আমার সম্মান থাকবে। মা আর কিছুই বলতে পারলো না। ছেলের কাছ থেকে এমন উত্তর কখনোই প্রত্যাশা করেননি। মা শুধুই ভাবলো কতো গর্ব ছিলো দুই ছেলেকে নিয়ে আমাদের। কতো চাওয়া, পাওয়া আর প্রত্যাশা ছিলো। আর আজ মনের কথাগুলো নির্ভয়ে বলতে পারছি না।
ঠিক তখনই ছোট মেয়ে পাশের ঘর থেকে বলে উঠলো, মা এদিকে এসো বাবা তোমাকে ডাকছে। ঘরে ডুকতেই দেখে খলিল সাহেব বড়, বড় চোখ করে বসে আছে। কি হয়েছে, কেন ডাকছো? খলিল সাহেব কিছুটা উচ্চস্বরে বললো, তোমাকে এসব কথা কে বলতে বলেছে? তারা চলে যেতে চায়, যাক। তুমি কেন আটকানোর চেষ্টা করছো। ছেলেরা যদি আমাদের কাছ থেকে দূরে গিয়ে ভালো থাকতে পারে তাহলে আমরাও তাদেরকে ছেড়ে ভালো থাকতে পারবো। খলিল সাহেবের স্ত্রী মেয়েকে বললো, মা চুলায় তরকারি দিয়েছি একটু দেখতো গিয়ে। এবার স্বামীর কাছে এসে বসলো। আস্তে করে বললো, আপনি কি সত্যি চান তারা চলে যাক।
খলিল সাহেব স্ত্রীর চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে ঘর থেকে বের হতে, হতে বললো, যে চলে যেতে চায় তাকে আটকানো যায় না। তুমি কি তা জানো না । খলিল সাহেব দ্রুত বাড়ি থেকে বাহিরে বের হলেন। চোখের কোনায় পানি চিকচিক করছে। ব্যাথাতুর হৃদয় নিয়ে বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, এতো বড় পৃথিবী, চারপাশে এত্তো মানুষজন তারপরও কেন আমাকে এতো শূন্য লাগছে। মনে হচ্ছে এই পৃথিবী বড়ই নিষ্ঠুর। যেখানে সত্যিকারের আদর, ভালোবাসা, স্নেহের কোন মূল্য নেই। এই নির্দয় পৃথিবীতে আমি অসহায় এক বৃদ্ধ!
দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে তারপরও খলিল সাহেব বাসায় ফিরছে না। স্ত্রীর খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ছেলের বউদের বার, বার বলছে তোমরা ছেলেদের কাছে ফোন করো, তাদের বাবা কি আবার আড়তে গেল জিজ্ঞেস করো? কিন্তু ছেলের বউরা শাশুড়ির কথার কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না। তারা বলে, বাবা তো প্রায় এমন করে মা। দেখবেন কোথাও গিয়ে গল্প করছে কিছুক্ষণ পর ঠিকই চলে আসবে। শাশুড়ি ছেলেদের বউয়ের কথায় শান্ত্ব হতে পারলো না। যতোই সময় যাচ্ছে অস্হিরতা ততোই বাড়ছে তার। শাশুড়ির অস্থিরতা দেখে এবার বউরা বললো, এতোই যখন চিন্তা হয় তাহলে তাকে একা, একা বের হতে দেন কেন? সবসময় চোখে, চোখে রাখলেই তো পারেন। প্রতিটি দিন কোন, না কোন নতুন ঘটনা এই বাড়িতে ঘটতেই আছে, এসব দেখতে আর ভালো লাগে না।
এ কথা বলেই দুই বউ নিজেদের ঘরে চলে গেল। বেলা তখন তিনটা তখনো খলিল সাহেব বাড়ি আসেনি। ছোট মেয়ে মাকে বললো, মা তুমি একটু স্হির হত্ত। আমি সামনে গিয়ে দেখি বাবা কোথায় গেল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো তখনো খলিল সাহেবের কোন খোঁজ পাত্তয়া গেল না। এবার খলিল সাহেবের স্ত্রী বাড়িতে উচ্চস্বরে কানাকাটি শুরু করেছে। শাশুড়ির কান্নার শব্দ শুনে ছেলের বউরা ঘর থেকে বের হলো। আশেপাশের অনেক মানুষ এসেছে। দুই ছেলেকে ফোন দিয়ে ঘটনা বলা হলো। ফোনের ওপাশ থেকে বড় ছেলে বললো, বাবা হয়তো তার কোন পুরনো বন্ধুর বাড়ি গিয়েছে সন্ধ্যার দিকে চলে আসবে এতো দুশ্চিন্তার কি আছে। আড়তে এখন অনেক লোকজন এসেছে। আমরা খুব ব্যস্ত, পরে কথা বলবো।
মাগরিবের আযান হলো, মানুষজন বাড়ি চলে গেল নামাজ পড়ার জন্য। খলিল সাহেবের স্ত্রী তখনো মূল দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে আর চিন্তা করছে এখনোই মনে হয় চলে আসবে। কিন্তু অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে, করতে রাত ৮ টা বাজলো। তখনো খলিল সাহেবের কোন খোঁজ পাত্তয়া যায় নি। ঠিক তখনই দুই ছেলে বাড়ি আসলো। দরজায় মাকে কাঁদতে দেখে দুই ছেলেরই একটু রাগ হলো। বড় ছেলে বললো, এখানে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করার কিছু নেই ভিতরে চলো।
বড় ছেলে এবার রাগান্বিত হয়ে মাকে বললো, বাবার কি কোনদিন বুদ্ধি হবে না! কোথায় গিয়েছে বাড়িতে বলে যায়নি আবার ফোনটাও সাথে নিয়ে যায়নি। বড় ছেলের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে ছোট ছেলে বলে উঠলো, যতোই দিন যাচ্ছে ততোই মনে হয় বাবার জ্ঞান লোপ পাচ্ছে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের কতোটা টেনশনে থাকতে হয়, এদিকে বাবা আবার প্রতিদিন নতুন, নতুন কান্ড করেন। এবার খলিল সাহেবের স্ত্রী আর চুপ থাকতে পারলো না। ছেলেদের উপর কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো, এসব কথা পরে হবে আগে তোর বাবাকে খুঁজে বের করতে হবে।
ঠিক তখনোই, পাশের বাড়ির রহমত মিঞার ছেলে রতন হাঁপাতে , হাঁপাতে এসে বললো, চাচী আজ দুপুরে নাকি একজন বৃদ্ধ লোক বাসস্ট্যান্ডে অজ্ঞান হয়ে যায় তারপর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আপনারা কি হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছেন? এবার খলিল সাহেবের স্ত্রী আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। চিৎকার করে মেয়েকে বললো, তোর সব বোনকে ফোন করে কাল বাড়িতে আসতে বল। আর তুই আমার সাথে চল আমি এখনোই হাসপাতালে যাবো। রতনকে বললো, তুমি একটু নিয়ে চলো বাবা আমাদের। বড় ছেলে বলে উঠলো, তোমাদের যাওয়ার দরকার কি? আমরা দুই ভাই যাচ্ছি। মা বড়, বড় চোখ করে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো, তোরা না অনেক ব্যস্ত! তোদের সময় হবে হাসপাতালে যাওয়ার। রতনের সাথে খলিল সাহেবের স্ত্রী ও মেয়ে দ্রুত ছুটলো হাসপাতালের দিকে। পিছনে, পিছনে দুই ছেলেও গেল। (আগামী সংখ্যায়)
Posted ৭:১৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৭ জানুয়ারি ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh