বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩
ছবি : সংগৃহীত
চলতি জানুয়ারি মাসের প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলা ঝড়-বৃষ্টি ও চকিত বন্যায় ১৯ জনের মৃত্যুসহ বিপুল ক্ষয়ক্ষতির ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৮০০ মাইল দীর্ঘ পশ্চিম উপকূলের ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় লস অ্যাঞ্জেলেস এবং উত্তর দিকে স্যান ফ্রান্সিসকো সিটির পার্শ্ববর্তী হাফ মুন বে এরিয়ায় দুটি পৃথক ব্যাপক গুলিবর্ষণের ঘটনায় ১৯ ব্যক্তি নিহত হয়েছে। ঘটনা দুটি ঘটে আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে। লস অ্যাঞ্জেলেস এর ঘটনায় নিহত হয়েছে ১১ জন এবং স্যানফ্রান্সিসকো বে এরিয়ায় গুলিবর্ষণের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আট। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো চারটি গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে নতুন বছরের জানুয়ারি মাস শেষ না হতেই মাত্র ২৪ দিনে যুক্তরাষ্ট্রে ৩৯টি গুলিবর্ষণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এসব ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৭০ এবং আহত হয়েছে আরো ১৬৭ জন। নন-প্রফিট সংস্থা ‘গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ’ যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতার আশংকাজনক বিস্তারকে ‘আমেরিকান ব্যাধি’ বলে বর্ণনা করেছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় হাফ মুন বে এরিয়ার ঘটনায় কমপক্ষে আটজন নিহত ও একজন আহত হন। গত ২৩ জানুয়ারি এখানে পৃথক দুটি জায়গায় হামলা চালানো হয়। এই ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে চুনলি ঝাও নামের ৬৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। এর আগে গত ২১ জানুয়ারি লস অ্যাঞ্জেলেসের এশীয় অধ্যুষিত এলাকা মন্টেরি পার্কে চীনা নববর্ষের উৎসবে বন্দুক হামলা হয়। ওই ঘটনায় ১১ জন নিহত ও অন্তত ১০ জন আহত হন। এ হামলার সন্দেহভাজন ব্যক্তি আত্মহত্যা করেন। এর রেশ না কাটতেই গত ২৩ জানুয়ারি রাতে আরেক গণগুলির ঘটনা হলো। স্টেট গভর্নর গ্যাভিন নিউজম টুইটবার্তায় লেখেন, ‘ট্র্যাজেডির পর ট্র্যাজেডি’। মন্টেরি পার্কে আনুমানিক ৬০ হাজার মানুষের বসবাস। যার ৬৫ শতাংশই এশিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান ও ২৭ শতাংশ হিস্পানিক।
ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ম্যাটেও কাউন্টির শেরিফ ক্রিস্টিনা করপাস জানান, হামলা চালানোর দুই ঘণ্টা পর সন্দেহভাজন চুনলি ঝাওকে হেফাজতে নেওয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি একাই এ হামলা চালিয়েছেন। তাঁর গাড়ি থেকে একটি হ্যান্ডগানও উদ্ধার করা হয়েছে। হাফ মুন বে শহরটি সান ফ্রান্সিসকো থেকে ৩০ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। এই ঘটনার পর সংবাদ সম্মেলনে ক্রিস্টিনা করপাস বলেন, ‘এ ধরনের বন্দুক হামলা ভয়ানক ঘটনা। এ ধরনের ঘটনার কথা আমরা দূরে কোথাও শুনি, কিন্তু এবার সান মাতেও কাউন্টিতে আমাদের ঘরে এটি আঘাত করল।’ নগর কর্তৃপক্ষ জানায়, শহরের একটি মাশরুম ফার্মে প্রথম হামলা করা হয়। এতে চারজন নিহত ও একজন আহত হন। ওই ফার্ম থেকে প্রায় দুই মাইল দূরের আরেকটি ফার্মে দ্বিতীয় হামলাটি করা হয়। সেখানে নিহত হন তিনজন। হামলার কারণ সম্পর্কে এখনো কেউ কিছু নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি। গত ২৩ জানুয়ারির ঘটনায় নিহতরা সবাই একটি ফার্মের চীনাকর্মী। ঝাও নিজেও একসময় ওই ফার্ম দুটির কোনো একটিতে কাজ করতেন। ফার্মের মালিকও হামলার কারণ সম্পর্কে কোনো কিছু জানাতে পারেননি। পর পর দুই দিনের এই হামলায় অঙ্গরাজ্যটির সবাই শোকাহত।
অ্যাসাল্ট রাইফেল নিষিদ্ধ আইন নবায়ন করার আহবান বাইডেনের : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পুনরায় কংগ্রেস সদস্যদের প্রতি অ্যাসাল্ট রাইফেল নিষিদ্ধ আইন নবায়ন করার আহ্বান জানিয়েছেন। গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের উপকূলীয় শহর হাফ মুন বেতে পৃথক দুটি হামলায় সাতজন নিহতের পর বাইডেন এই আহ্বান জানালেন। এই ঘটনার দু’দিন আগে ক্যালিফোর্নিয়ার জনপ্রিয় একটি নাচের হলে চীনা নববর্ষ উদ্যাপনের সময় বন্দুকধারীর হামলায় ১১ জন নিহত হয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো, উভালদে, টেক্সাস, হাইল্যান্ড পার্ক, ইলিনয়, নিউইয়র্ক শহরসহ কয়েকটি প্রাণঘাতী বন্দুক হামলায় অ্যসাল্ট অস্ত্র ব্যবহার করে হামলাকারী ব্যক্তিরা।
বন্দুক আইনের সংস্কার আনা প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র মোটাদাগে বিভক্ত। যদিও প্রায়শই দেশটিতে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটছে। এসব হামলায় বহু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। মূলত ডেমোক্র্যাটরা বন্দুক আইন সংস্কার করার পক্ষে, রিপাবলিকানরা বিপক্ষে। বন্দুক নিষিদ্ধ নিয়ে ১৯৯৪ সালে কংগ্রেসে একটি বিল পাস হয়েছিল। কংগ্রেসের উভয় কক্ষে পাস হওয়া ওই বিলটির কারণে ১০ বছরের জন্য ‘অ্যাসল্ট রাইফেল’ ও উচ্চক্ষমতা-সম্পন্ন গুলি বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে ২০০৪ সালে আইনটির মেয়াদ শেষ হয়। এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র বিক্রি অনেক বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন বারবার আইনটি নবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ কংগ্রেসের রিপাবলিকান প্রতিনিধিরা এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করছেন।
তিন সপ্তাহে ৩৯ গুলিবর্ষণের ঘটনা : যুক্তরাষ্ট্রের এসব হামলার অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে। তবে স্বজন হারানোর যন্ত্রণা ও ভয়াবহতার এই দৃশ্যগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমে বাড়ছে। সিএনএনের হিসাব অনুসারে, এ নিয়ে চলতি বছরের প্রথম তিন সপ্তাহে ৩৮টি নির্বিচার গুলির ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ সংখ্যা ৩৯। গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ ও সিএনএনের সংজ্ঞা অনুযায়ী, একটি ঘটনায় বন্দুকধারী ছাড়া কমপক্ষে চারজন মানুষ প্রাণ হারালে সেটি ‘ম্যাস শুটিং এর ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। অবশ্য ২০১২ সালের আইনে এফবিআই’র সংজ্ঞা অনুযায়ী, একটি ঘটনায় তিন বা ততোধিক ব্যক্তি নিহত হলে, সেটি ‘নির্বিচার গুলি’র পর্যায়ে পড়ে। গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৩৯টি নির্বিচার বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত ৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্বিচার গুলির ঘটনা ঘটেছে ২০২১ সালে। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৬৯০টি নির্বিচার গুলির ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৪৭টি ঘটনা ঘটে গত বছর। আর ৬১০টি নির্বিচার গুলির ঘটনা ঘটেছে ২০২০ সালে।
গত বছর জেএএমএ নেটওয়ার্ক ওপেনে প্রকাশিত একটি গবেষণায় গত তিন দশকে আগ্নেয়াস্ত্রে মৃত্যুর ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করা হয়। এতে বলা হয়, ১৯৯০ সাল থেকে ১০ লাখের বেশি মানুষ আগ্নেয়াস্ত্রে প্রাণ হারিয়েছেন। মার্কিনদের চেয়ে অন্যান্য দেশের খুব কম মানুষই এত বেশি আগ্নেয়াস্ত্র রাখেন। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক স্মল আর্মস সার্ভের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ৩৯ কোটি ৩০ লাখ ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র আছে। সে হিসাবে প্রতি ১০০ জনের বিপরীতে ১২০টি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। অবশ্য অনিবন্ধিত ও অবৈধ অস্ত্র কেনাবেচার কারণে ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের প্রকৃত হিসাব পাওয়া কঠিন।
২০২২ সালের অক্টোবরে গ্যালাপের এক জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ৪৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মার্কিন বাসায় আগ্নেয়াস্ত্র রাখার কথা জানিয়েছেন। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মেরিল্যান্ড পর্যন্ত বাসিন্দারা যখন নির্বিচার বন্দুক হামলার দুঃসহ স্মৃতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করছেন, তখন অন্যরা নিজেদের আঙিনায় একই ধরনের সহিংসতার শঙ্কা নিয়েই দিন যাপন করছেন। গত ২২ জানুয়ারি ফ্লোরিডায় এক অনুষ্ঠানে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস বলেন, ‘এই কক্ষের এবং আমাদের দেশের সবাই বুঝতে পারছি, এই সহিংসতা বন্ধ করতে হবে।’ কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কংগ্রেস বিভক্ত। নীতিগত মতভিন্নতা ব্যাপক। আর এই বন্দুক-সংস্কৃতির শিকড়ও অনেক গভীরে। ফলে নির্বিচার গুলির ঘটনা কীভাবে বন্ধ হবে, তা দেখতে হবে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত ২৩ জানুয়ারি দ্রুত দুটি বিল পাস করতে কংগ্রেসের আইনপ্রণেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বিল দুটিতে অ্যাসাল্ট ওয়েপনস ও বেশি বুলেট ধারণক্ষমতার ম্যাগাজিন নিষিদ্ধ এবং অস্ত্র ক্রেতার বয়সসীমা ২১ বছরে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে।
Posted ২:২১ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh