জাফর আহমাদ : | বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫
সর্ব প্রথম আমি একজন ঈমানদার মু’মিন তারপর আমি একজন মুসলমান। আমি দৃঢ়ভাবে এই আকিদা পোষণ করি যে, আল্লাহ এক ও একক। তাঁর সাথে কোন শরীক নাই। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। ইলাহ মানে আইনদাতা, বিধানদাতা, সার্বভৌম ক্ষমতার একক মালিক ও উপাস্য। তিনি আমার রব, তিনিই আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমি তাঁরই গোলাম বা দাস। তিনি হযরত আদম আ: থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত যত নবী ও রাসুল পাঠিয়েছেন এবং তাঁদের ওপর যেই কিতাব নাযিল করেছেন, সেই সকল নবী-রাসুল ও কিতাবের ওপর ঈমান পোষণ করি। আমি সর্বশেষ নবী ও রাসুল মুহাম¥দ সা: এর উম্মত। আমি বিশ্বাস করি তিনি শেষ নবী ও রাসুল। তাই আমি আমার জীবন ব্যবস্থা বা দীন অনুসরণে দেখিনা কোন কোন বযুর্গ কি বলেছেন, কোন পীর সাহেব কি করেছেন বরং আমি দেখি আল্লাহ কি বলেছেন এবং নবী সা: কি করেছেন। অর্থাৎ আমি আল্লাহর নির্দেশিত ও রাসুল সা: এর প্রদর্শিত পথে নিজেকে পরিচালনা করি।
আল্লাহ তাঁর রাসুল সা: কে যেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, আমি রাসুল্লাহ সা: এর সুন্নাহ অনুসরণে সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কাজকে নিজের জীবনোদ্দেশ্য করে নিয়েছি। এটিই প্রকৃত সুন্নাহ এটিই প্রকৃতপক্ষে রাসুল্লাহ সা: এর অনুসরণ। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি তাঁর রাসুলকে হিদায়াত এবং ‘দীনে হক’ অর্থাৎ ‘সত্য জীবন ব্যবস্থা’ দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি এ দীনকে অন্য সকল দীনের ওপর বিজয়ী করেন, চাই তা মুশরিকদের কাছে যতই অসহনীয় হোক না কেন।”(সুরা সফ:৯)দীন বা জীবন ব্যবস্থা অনুসরণে আমি কখনো অন্যের বানানো বা মনগড়া জীবন ব্যবস্থাকে আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থার সাথে সংমিশ্রণ করি না।
আল্লাহর দাসত্বের সাথে অন্যদের দাসত্ব স্বীকারও করি না এবং পালনও করি না। শুধুমাত্র এক আল্লাহর আনুগত্য ও হিদায়াতের ওপর গোটা জীবন ব্যবস্থা কায়েম হোক এটিই আমার চাহিদা। এর ব্যত্যয় যদি ঘটে তবে আমি মুশরিকদের অন্তর্ভক্ত হয়ে যাবো। প্রকৃতপক্ষে আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। আমি আল্লাহর কাছে সকল প্রকার শিরক থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।
দুনিয়াতে যারা ইচ্ছামত যে কোন প্রভু ও উপাস্যের দাসত্ব করতে সংকল্পাবদ্ধ এবং যে কোন দর্শন ও মতবাদের ওপর নিজেদের আকীদা-বিশ্বাস, নৈতিকতা এবং তাহযীব তমুদ্দনের ভিত্তিস্থাপন করতে প্রস্তুত এমনসব লোকের বিরোধীতার মুখেও তাদের সাথে আমার রাসুল সা: আপোস করেননি, আমিও ঐ সমস্ত মুশরিকদের সাথে কখনো আপোস করি না। বরং রাসুল সা: কে পাঠানো হয়েছিল এ জন্য যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে যে হিদায়াত ও জীবন ব্যবস্থা এনেছেন তাকে গোটা জীবনের সব দিক ও বিভাগের ওপর বিজয়ী করে দিবেন। অবস্থা যাই হোক না কেন, তাঁকে এ কাজ করতেই হবে।
কাফের মুশরিকরা তা মেনে নিক আর না নিক এবং এ বিরোধীতায় সর্বশক্তি নিয়োগ করলেও সর্ববস্থায় রাসুলের এ মিশন সফলকাম হবে এবং পূর্ণতা লাভ করবে। তাঁর ২৩ বৎসরের অবিরত সংগ্রামের মাধ্যমে সফলকাম হয়েছেনও বটে। অসংখ্য মতবাদ ও মানুষের বানোনো জীবন ব্যবস্থার ওপর ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে তিনি কায়েম করেছেন। মদীনা নামক ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করে দুনিয়াবাসীর সামনে এর বাস্তবতার প্রমাণও তিনি দেখিয়ে গেছেন। আমি রাসুলুল্লাহ সা: এর এই প্রকৃত সৃন্নাহর অনুসারী। তাই আমি তাঁর সুন্নাহর অনুসরণে আমার জন্মভূমিতে প্রচলিত জীবন ব্যবস্থার ওপর ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর।
দুনিয়াতে রাসুল সা: এর আগমনের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের মধ্যে ধ্রুম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। এটি কাফের-মুশরিকদেরই কাজ। কারণ রাসুল সা: এর মৌল উদ্দেশ্য যদি আমরা জেনে ফেলি তাহলে কাফের-মুশরিকদের জন্য তা অসহনীয় হয়ে যায়। তাই তারা রাসুল প্রেরণের মৌল উদ্দেশ্যকে ভুলিয়ে দিয়ে রাসুলুল্লাহ সা: কে নির্দিষ্ট কিছু ইবাদাত ও জীবানাচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছে। মুসলমানগণ অত্যন্ত যত্নসহকারে নির্দিষ্ট কিছু ইবাদাত ও যিকর পালন করে আল্লাহর কাছে বেহেশতের নায-নিয়ামত লাভের জন্য দু’আ করে। রাসুলুল্লাহ সা: যে উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন তা আল কুরআনের এক জায়গায় নয় বরং বেশ কিছু সুরাতে বর্ণিত হয়েছে। আমাদের সকল ইমাম ও মুসলিমগণ এগুলো তেলাওয়াতের মাধ্যমে প্রত্যেহ সালাত আদায় করেন,কিন্তু আয়াতগুলো নিয়ে কখনো চিন্তা-ভাবনা করে না এবং আয়াতগুলোর আহবানে কখনো সাড়া দেয় না।
উল্লেখিত সুরা সফ ছাড়াও আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ আল্লাহই তো সে মহান সত্তা যিনি তাঁর রাসুলকে হিদায়াত ও সত্য দীন দিয়ে পাঠিয়েছেন যেন তাকে সমস্ত দীনের ওপর বিজয়ী করে দেন। আর এ বাস্তবতা সম্পর্কে আল্লাহর সাক্ষই যতেষ্ট।”(সুরা ফাতাহ:২৮) আল্লাহ আরো বলেন,“আল্লাহই তাঁর রাসুলকে পথ নির্দেশ ও সত্য দীন সহকারে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি একে সকল প্রকার দীনের ওপর বিজয়ী করেন, মুশরিকরা একে যতই অপছন্দ করুক না কেন।”(সুরা তাওবা:৩৩)
আল কুরআনে দীন শব্দটি আরবী ভাষায় এমন একটি জীবন ব্যবস্থা ব জীবন পদ্ধতি অর্থে ব্যবহৃত হয় যার প্রতিষ্ঠাতাকে সনদ ও অনুসরণযোগ্য মেনে নিয়ে তার আনুগত্য করতে হয়। কাজেই আয়াতে রাসুল পাঠাবার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলা হয়েছে দীন জাতীয় বা দীনের শ্রেনীভূক্ত অন্য কথায় জীবন বিধান পদবাচ্য সমস্ত পদ্ধতি ও ব্যবস্থার ওপর জয়ী করবেন। অন্য কথায় রাসুলের কখনো এ উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়নি যে, তিনি যে জীবন ব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন তা অন্যান্য জীবন ব্যবস্থার কাছে পরাজিত হয়ে ও সেগুলোর পদানত থেকে তাদের দেয়া সুযোগ সুবিধা ভোগ করার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ ও সংকোচিত করে রাখবে।
বরং তিনি আকাশ ও পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতির প্রতিণিধি হয়ে আসেন এবং নিজের মনিবের সত্য ও ন্যায়ের ব্যবস্থাকে বিজয়ী দেখতে চান। দুনিয়ায় যদি অন্য কোন জীবন ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে তাহলে তাকে আল্লাহর ব্যবস্থার আওতাধীনেই তার দেয়া সুযোগ সুবিধা হাত পেতে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। যেমন জিজিয়া আদায় করার মাধ্যমে যিম্মিরা নিজেদের অধীনতার জীবন মেনে নেয়।
সুরা মু’মিনুন এ দীন অর্থ শাসন ব্যবস্থা বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন, “একদিন ফেরাউন তার সভাসদদের বললো: আমাকে ছাড়ো, আমি এ মুসাকে হত্যা করবো। সে তার রবকে ডেকে দেখুক। আমার আশংখা হয়, সে তোমাদের দীনকে পাল্টে দেবে কিংবা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।”
(সুরা মু’মিনুন:২৬) এখানে দীন মানে শাসন ব্যবস্থা। তাই ফেরাউনের কথার অর্থ হলো, “সে তোমাদের শাসন ব্যবস্থাকে পাল্টে দেবে।” অন্য কথায়, ফেরাউন ও তার খাšদানের চুড়ান্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ভিত্তিতে ধর্ম, রাজনীতি, সভ্যতা ও অর্থনীতির যে ব্যবস্থা মিশরে চলছিল তা ছিল তৎকালে ঐ দেশের ‘দীন’। ফেরাউন হযরত মুসার আন্দোলনের কারণে এ দীন পাল্টে যাওয়ার আশংখা করছিলো। কিন্তু প্রত্যেক যুগের কুচক্রী ও ধুরন্ধর শাসকদের মত সেও এ কথা বলছে না যে, আমার হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাওয়ার আশংখা করছি। তাই আমি মুসাকে হত্যা করতে চাই। বরং পরিস্থিতিকে সে এভাবে পেশ করছে যে, হে জনগণ, বিপদ আমার নয়, তোমাদের। কারণ মূসার আন্দোলন যদি সফল হয়, তাহলে তোমাদের দীন বদলে যাবে। নিজের জন্য আমার চিন্তা নেই। আমি তোমাদের চিন্তায় নিশেষ হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে যে, আমার ক্ষমতার ছত্রছায়া থেকে বঞ্চিত হলে তোমাদের কি হবে। তাই যে জালেমের দ্বারা তোমাদের ওপর থেকে এ ছত্রছায়া উঠে যাওয়ার আশংখা দেখা দিয়েছে তাকে হত্যা করা প্রয়োজন। কারণ সে দেশ ও জাতির উভয়ের শত্রু।
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুখলিসিনা লাহুদ্দীন ওয়ালাও কারিহাল কাফিরুন।’আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, কাফিরদের অপছন্দ সত্ত্বেও দীনকে আল্লাহর জন্য সুনির্দিষ্ট করলাম। আমি দৃঢ়পদে মনের সবটুকু শক্তি জমা করে বলছি যে, আমি একজন মুসলমান। আমার কথার চেয়ে উত্তম কথা পৃথিবীর আর একটিও নেই। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,“সেই ব্যক্তির কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হবে যে আল্লাহর দিকে দিকে ডাকলো, সৎকাজ করলো এবং ঘোষনা করলো আমি মুসলমান।”(সুরা হামিম আস সাজদা:৩৩) আমি আল্লাহর আনুগত্যের ওপর দৃঢ়পদ, হে রহমান ও রহিম! আমাকে তা থেকে বিচ্যুত করো না। আমি নিজে শুধু এ পথ অবলম্বন করে নিরবে বসে থাকি না বরং অন্যদেরকে আল্লাহর বন্দেগীর দিকে আহবান জানাচ্ছি। আমি জানি আমার এই ঘোষনায় শয়তান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আমাকে ছিঁড়ে ফেরে খাওয়ার জন্য ছুটে আসবে। আমি আমার আল্লাহর পূর্ণ ভরসা রাখি।
বর্তমান পৃথিবীতে যারা আকীদার সোল এজেন্ট দাবী করেন এবং অন্যের আকীদা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন, তাদের তরে অনুরোধ আমার উল্লেখিত প্রবন্ধের আলোকে আপনার আকীদা যাচাই করুন, দেখুন আপনার আকীদা সঠিক আছে কি না। জীবনের সর্বক্ষেত্রে দীনকে কি আল্লাহর জন্য সুনির্দিষ্ট করতে পেরেছেন? না কি বিজাতীয় মতবাদের আওতায় নিজেকেও নিজের দীনকে সুনির্দিষ্ট কিছু ইবাদাত-বন্দেগীর মধ্যে গুটিয়ে নিয়েছেন? শুধু মসজিদ ও মাদ্রাসা আল্লাহর আইন অনুযায়ী চলে কিন্তু জীবনের বৃহৎ অংশ চলে বিজাতীয় আইনের আওতায়। আল্লাহর দেয়া দীন তথা জীবন ব্যবস্থা এখানে বিজয়ী নেই, আল্লাহর রাসুল সা: এর সুন্নাহ অনুযায়ী এ দীন তথা জীবন ব্যবস্থাকে এখানে বিজয়ী করতে হবে। তাহলে আমার সালাত, আমার সাওম, যাকাত ও হজ¦ পরিপূর্ণতা পাবে। আল্লাহর দীনকে পরাজিত রেখে যতই সালাত, সওম, যাকাত ও হজ্জ পালন করা হোক না কেন, আখিরাতে মুক্তি লাভ করা সহজ নয়। রাসুলুল্লাহ সা: এর সুন্নাহকে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করা হলে, তা হবে তাঁর প্রতি সুস্পষ্ট জুলুম।
আল্লাহর রাসুল সা: কিয়ামতের দিন এ সমস্ত সুন্নাহদারীদের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর রাসুল বলবে,“হে আমার রব! আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা এ কুরআনকে বাস্তুচুত্য করেছিল।”(সুরা ফুরকান:৩০)রাসুলুল্লাহ সা:-এর ২৩ বৎসরের অক্লান্ত পরিশ্রমে মানুষের ব্যক্তি,পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রের সকলস্তরে আল কুরআনকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
আল কুরআন অনুযায়ী তিনি এমন এক সোনার সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিনির্মান করেছিলেন যেখানে মানুষ কুরআন অনুযায়ী মানুষ কথা বলতো এবং কুরআন অনুযায়ী কথা পরিহার করতো। আইন আদালত ও রাষ্ট্রের সকল অবকাঠামো পরিচালিত হতো কুরআন অনুযায়ী। স্কুল-কলেজের শিক্ষার প্রধান ও মূল বিষয় ছিল আল কুরআন। কুরআন অনুযায়ী তিনি নিরাপদ সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। সেই কুরআনকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বাদ দিয়ে যারা শুধু নির্দিষ্ট কয়েকটি সুন্নাহ নিয়ে ব্যস্ত, তারাই রাসুলুল্লাহ সা: এর মামলার আসামী হবে।
Posted ১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh