আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : | বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫
ক্ষমতার লোভ, খ্যাতির লোভ, সম্পদ আত্মসাতের লোভ, বাংলাদেশে একক দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার লোভ শেখ হাসিনা ও তার লোভের সঙ্গীদের ডুবিয়েছে। একজন ব্যক্তির এত লোভ থাকা উচিত? প্রধানমন্ত্রীর পিয়ন চারশ’ কোটি টাকার মালিক ও তিনি হেলিকপ্টারে ভ্রমণ করেন! কল্পনা করা যায়? পিয়নের মালের পরিমাণ যদি এত হয়, তার পারিষদবর্গের একেক জন কত বিত্তের মালিক হতে পারেন? কৌটিল্য তার বিখ্যাত ‘অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে বলেছেন: “পানিতে একটি মাছ কখন কতটুকু পানি পান করে তা জানা যেমন অসম্ভব, অনুরূপ একজন সরকারি কর্মচারি কি পরিমাণ অর্থ চুরি করছেন তা নির্ণয় করাও অসম্ভব।” কৌটিল্য তার যুগে ‘সরকারি কর্মচারি’ উল্লেখ করলেও আধুনিক যুগে সরকারি কর্মচারির ঘাড়ের ওপর চেপে থাকে মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিনিধি, দলীয় নেতাকর্মীরা। অতএব চুরির ক্ষেত্র নিম্নস্তর থেকে উর্ধতন পর্যায়ে ব্যাপ্ত। যার ক্ষমতার এখতিয়ার যত বেশি, তার চুরির পরিমাণও তত বেশি।
পরলোকগত লেখক সাংবাদিক খুশবন্ত সিং এর সংকলিত অসংখ্য ‘জোকস’ এর একটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দুর্নীতির ওপর: কেরালা বিধানসভার এক সদস্য চণ্ডীগড়ে এসে তার বন্ধু পাঞ্জাবের এক মন্ত্রীর বাসভবনে উঠেন। তার বিলাসবহুল বাড়ি ও প্রাচুর্য দেখে জানতে চান, “তুমি কীভাবে এত বিত্তের মালিক হলে?” মন্ত্রী বন্ধুকে বলেন, “আগামীকাল তোমাকে দেখাবো। পরদিন মন্ত্রী মহোদয় বন্ধুকে গাড়িতে নিয়ে এক জায়গায় থামলেন। গাড়ি থেকে নেমে মন্ত্রী আঙুল তুলে দূরের এক উপত্যকা দেখিয়ে কেরালার বন্ধুকে বললেন, “দুমি কি ওখানে একটি ব্রিজ দেখতে পাচ্ছো। ওই ব্রিজের নির্মাণ ব্যয়ের অর্ধেকটাই আমার পকেটে এসেছে।”
চার বছর পর পাঞ্জাবি তার মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। তিনি কেরালার রাজধানী ত্রিবেন্দ্রামে গিয়ে তার পুরনো এমএএ বন্ধুর বাসভবনে উঠলেন, যিনি তখন কেরালার মন্ত্রী হয়েছেন। পাঞ্জাবি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, “তুমি আমাকেও হার মানিয়ে দিয়েছ। ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি, ইটালিয়ান মার্বেল, মার্সিডিজ গাড়ি। কী করে এসব সম্ভব হলো?” মন্ত্রী বললেন, “তোমাকে আগামীকাল দেখাবো।” পরদিন সকালে মন্ত্রী তাকে গাড়িতে নিয়ে গেলেন। এক স্থানে থামার পর মন্ত্রী উপত্যকার দিকে দেখিয়ে বললেন, “তুমি কি ওখানে কি একটা ব্রিজ দেখতে পাচ্ছ?” পাঞ্জাবি উত্তর দিলেন, “না, আমি তো ওখানে কোনো ব্রিজ দেখতে পাচ্ছি না।” মন্ত্রী বললেন’, “ঠিকই বলেছ’, ওখানে কোনো ব্রিজ নেই। কারণ, ব্রিজের পুরো অর্থ আমার পকেটে এসেছে।”
এ ধরনের জোকস কেবল হাসি-মস্করার জন্য নয়, সরকারের দায়িত্বে নিয়োজিতদের চরম দুর্নীতিপরায়ণতার কারণেই সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম ছিল না। জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা দলের লোকজনের বিত্তবৈভব কামাইয়ের অবাধ সুযোগ এসেছিল পাকিস্তান সমর্থক অবাঙালিদের সম্পত্তি দখল-লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে। এরপর বিত্ত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কেউ আর রাখঢাক করেনি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি সমানতালে মাল কামিয়েছে। আওয়ামী লীগ ‘আমার দেশ,’ ‘বাবার দেশ,’ এর দাবিদারের সাঙ্গপাঙ্গরা দেশকে ‘মৌরসি পাট্টা’ (পুরুষানুক্রমে জমি ভোগ করার বন্দোবস্ত; বা চিরস্থায়ী অধিকার’) ভেবে হিসেবে মাল কামানোর ক্ষেত্রে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। তারা লক্ষ-কোটি টাকার প্রজেক্ট নিয়েছে এবং বিনা বাধায় লুট করেছে। পিয়নের ৪০০ কোটি টাকা হলে পাইক-বরকন্দাজ, উজির-নাজিরদের কত হয়েছে?
‘লোভই সকল পাপের মূল’।
এ সম্পর্কে একটি সংস্কৃত প্রবাদ আছে: “লোভাত ক্রোধপ্রভবতি, লোভাত কাম প্রজায়তে, লোভান-মহাশ্চ নাহাশ্চলোভা পাপস্য কারানাম” অর্থ্যাৎ ‘লোভ ক্রোধ সঞ্চার করে, অতিরিক্ত লোভ-লালসা ধ্বংস ডেকে আনে, কারণ লোভই সকল পাপের মূল।’ চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে সাড়ে পনেরো বছর ধরে বাংলাদেশে ক্ষমতার এক্চ্ছত্র অধিশ্বরী দশভূজা মা দুর্গার মতো কল্পিত অসুর বিনাশিনী শেখ হাসিনা ও তার দুস্কর্মের সঙ্গীরা সদলবলে পলায়ন করলেও বাংলাদেশ থেকে লোভের বিনাশ ঘটবে, এমন আশা করা বৃথা। ১৯৪৭ সাল থেকে হিসাব করলে গত ৭৮ বছর যারাই শাসকের মসনদে বসেছেন, দৃশ্যত তারা সুদর্শন, আকর্ষণীয়, সুঠামদেহী হলেও এবং তারা সুন্দর সুন্দর বচন দিলেও তাদের অন্তরে ছিল প্রতারণা।
এ প্রসঙ্গে সংস্কৃতে একটি প্রবাদ আছে: “আকৃতিরবাকাস্য দৃষ্টিসতু কাকস্য,” অর্থ্যাৎ ‘দেখতে তারা সারসের মতো হলেও তাদের দৃষ্টি কাকের মতো।’
যারা শেখ হাসিনা ও তার সঙ্গীদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে তাদের মতোই চুরি-চামারিতে লিপ্ত হতে ব্যগ্র, তারা নিয়মরীতি লঙ্ঘন করে হলেও তড়িঘড়ি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। দীর্ঘ আঠারোটি বছর তারা ক্ষমতা-বঞ্চিত। ক্ষমতার বঞ্চনার চেয়ে তাদের বেশিষ্ট কষ্ট দু’হাতে মাল কামাতে না পারার কষ্ট। ক্ষমতা হাতে এলেই পথটা সহজ হয়ে যায়। তাদের সময় কম, বাধা অনেক, সংষ্কৃত প্রবাদে বলা হয়: “অল্পশ্চ কালা বভশ্চ বিঘ্ন।”
তারা ‘জুলাই সনদ’ মানতে অনাগ্রহী। তাদের দাবি, আগে নির্বাচন পরে সংস্কার। সরকার পতনের মূলে যারা ছিল, তাদের কথা হলো, ‘জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন’। শেখ হাসিনার মেয়াদ যদি ২০২৮ সাল পর্যন্ত লম্বিত হতো, তাহলে তারা কার কাছে ‘অবিলম্বে নির্বাচন’ দাবি করতেন? লেজ গুটিয়ে লোকান্তরিত থাকতে হতো তাদের। অন্তবর্তী সরকার নির্বাচন দিতে চেয়েছে, এই তো বেশি। গতবছরের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সামরিক আইন জারি করা হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে গর্তেই থাকতে হতো।
প্রাচীন রোমের একটি প্রবাদকে প্রায়ই এভাবে অনুবাদ করা হয়: “একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি উপাদেয় খাদ্যের স্বপ্ন দেখতে পারে না,” যার ইংরেজি রূপ: “অ্যা বেগার ক্যান নট বি চুজারস।” সরকার যা দিচ্ছে, তা গ্রহণ করুন।
যেভাবেই হোক, কোনো ব্যতিক্রম না ঘটলে সাড়ে পাঁচ পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে আমার মতো অনেকে আশাবাদী। যারা নির্বাচিত হবেন, তারা নির্বাচনের খরচ তোলার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবেন, তা প্রায় স্বতসিদ্ধ। আমার মতো যারা নির্বাচনের ধারেকাছে নেই, তারা তো আশা করতে পারি, যেকোনোভাবে জন্মভূমির কল্যাণ হোক।
Posted ১১:১৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh