ঢাকা : | বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৩
বক্তব্য রাখছেন ড. আবু জাফর মাহমুদ
গ্লোবাল পিস অ্যামব্যাসেডর স্যার ড. আবু জাফর মাহমুদ ভিয়েতনাম থেকে নাইট অফ সেন্ট জন অফ জেরুজালেম উপাধি গ্রহণের পর সরাসরি জন্মভূমি বাংলাদেশে গেলে সেখানে বিভিন্ন পর্যায় থেকে তিনি সংবর্ধিত হয়েছেন। গত ১০ আগস্ট সিলেটে প্রত্যন্ত হাওরাঞ্চল সুনামগঞ্জের ছাতকে বিভিন্ন শ্রেনীপেশার মানুষের অংশগ্রহণে বর্ণাঢ্য এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয়েছে। সেখানে উপস্থিত সিলেট বিভাগের তৃণমূল মানুষের উদ্দেশ্যে স্যার ড. আবু জাফর মাহমুদ বলেছেন, আমরা সবাই এক দেশের এক পরিবারের মানুষ। আমাদের এখানে শুয়ে আছেন, হযরত শাহজালাল (রা.)সহ তার সঙ্গীয় ৩৬০ জন ধর্ম প্রচারক। তারা আমাদেরকে যে নৈতিকতা শিখিয়েছেন, এই নৈতিকতার প্রথমটাই হচ্ছে ভালোবাসা। তাদের সেই শিক্ষাই আজ এই ভূমির সাধারণ মানুষ অনুসরণ করেছে। এই জন্য আপনারা সেরা মানুষ। কেবল ডিগ্রি থাকলেই শ্রেষ্ঠ মানুষ হয়ে যায় না। অনেক বড় বড় ডিগ্রি অর্জন ও অনেক ক্ষমতা পাবার পরও গ্রামের মানুষের মতো এই চেতনা অর্জন করতে পারেনা। আপনাদেরকে ভালোবাসা ও আত্ম মর্যাদাবোধে কেউ উদ্বুদ্ধ করেনি, আপনারা জন্ম থেকেই এই শক্তি লাভ করেছেন, সেটিই অনুশীলন করে চলেছেন।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম আলীগঞ্জ বাজারে ওই সংবর্ধনা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা তথা দুর্গম হাওরের বিভিন্ন গ্রাম থেকে তৃণমূল জনগোষ্ঠি উপস্থিত হন। ছাতকের সাধারণ জনগণের প্রাণের মানুষ জননেতা কবীর মিয়ার সভাপতিত্বে সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, এলাকার তরুণ সমাজের প্রতিনিধি আবু বকর, রফিক মিয়া, এলাকার প্রবীনতম ব্যক্তিত্ব হাজী মোখলেসুর রহমান প্রমুখ।
আবু জাফর মাহমুদ সিলেটের দক্ষিণ ছাতকের সমাবেশস্থলকে প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য একটি জনপদ উল্লেখ করে বলেন, আল্লাহ এখানে আমাকে আপনাদের মাঝে নিয়ে এসেছেন, এটা আমার কোনো পরিকল্পনার অংশ নয়। গত বন্যায় আপনাদের সাথে মহান আল্লাহ তায়ালা যে আত্মীয়তা গড়ে দিয়েছেন, আমি খুব চেয়েছি আমার এই আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে। আমি বরাবরই বিশ্বাস করি, ভালোবাসার দায়িত্বের ওপরে কোনো দায়িত্ব নেই। আপনাদের সঙ্গে যে সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে এই সম্পর্কটা হচ্ছে ভালোবাসার। আপনাদের জন্য যে ভালোবাসা সেই ভালোবাসার সঙ্গে কোনো পক্ষ বিপক্ষ নেই। আমি দেশকে ভালোবাসি। একাত্তরে যেভাবে ভালোবেসেছিলাম। এখন আমি আমেরিকান। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র। তারা যদি সারা পৃথিবীর নেতা হয়, তাহলে আমিও নেতা। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি। নিজের কন্ঠে বলছি, পূণ্যভূমি সিলেটের বন্যা চিরতরে বন্ধ হবে। দোয়া করবেন, যাতে ত্রাণ দিতে না হয়। এক্ষেত্রে আপনাদের মধ্যকার ভালোবাসার একতাটি আরো বাড়াতে হবে। বন্যা প্রতিরোধ ও মোকাবিলার জন্য আমাদের একটি স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশের মহান মুুক্তিযুদ্ধের ১ নং সেক্টরের মাউন্টেন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার আবু জাফর মাহমুদ বলেন, বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী সাহেবের কমান্ডে, তার পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। এই যুদ্ধের আমি একজন সৈনিক। আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধ যেমন কোনোদিন শেষ হয় না, একজন মুক্তিযোদ্ধারও কোনো অবসর নেই। যতক্ষণ জীবিত ততক্ষণই যুদ্ধ চলবে। এই যুদ্ধ হচ্ছে প্রেমের যুদ্ধ, সম্পর্কের যুদ্ধ। যদি আমার মধ্যে ভালোবাসা থাকে আপনাদের সঙ্গে, আমার প্রিয় মানুষের সঙ্গে দেখা হবেই। ড. মাহমুদ ২০২২ সালের বন্যায় ছাতকের জনগোষ্ঠির দুর্ভোগের কথা উল্লেখ করে বলেন, বন্যা শুরু হওয়ার দু’দিন আগে আমি কবীর ভাইয়ের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক যা কিছু সম্বল ছিল পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। বন্যা শুরুর অনেক আগেই বুঝেছিলাম, হাওরের মানুষের অনেক কষ্ট হবে। আমার কাছে সংবাদ ছিল, এই সিলেটে উপরের অঞ্চল থেকে পানি পাঠানো হবে, দরজাটা খুলে দেয়া হবে। যারা জেনেছিলেন তাদের অনেকেই হয়তো জেনেও চুপ করে ছিলেন। আমি জেনেই আমার সাধ্যমত ব্যবস্থা নিয়েছি, এখানেই পার্থক্য। আমার সঙ্গে আপনাদের এই যে প্রেম ও সম্পর্ক আর অন্যদের সম্পর্কের পার্থক্যটাও এখানে। এই পার্থক্য দেখানোর স্পর্ধা আমার আছে, তাই আমি এসেছি। আমাদের মধ্যে যে প্রেম সেটি হচ্ছে রিজিক। রিজিক শুধু টাকা পয়সা নয়। শ্রেষ্ঠ রিজিক হচ্ছে, একজন মানুষ আরেকজন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা। এটিই আমি আমার জীবন থেকে শিখেছি। এটির চর্চা করেই আমি আনন্দ পাই, সুখ পাই, সমৃদ্ধ হই। তিনি বলেন, আল্লাহতায়ালা যখন বাড়তি কিছু দেন তখন মনে করি, বাড়তি দায়িত্বটা, আমাকে যতটুকু উপহার দেয়া হলো তার চেয়ে অনেক বেশি।
আবু জাফর মাহমুদ বলেন, শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো আমাদেরকে অনেক কিছু শেখান। অনেকেই মনে করেন, যারা মারা গেছেন, তাদের কাছ থেকে কী পাওয়া যাবে। কিন্তু আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, ওদেরকে মৃত বলো না। আমি নিজেই তাদের রিজিক দিই। সিলেটে হযরত শাহজালাল (রা.) তার সকল সঙ্গীয় ধর্মপ্রচারকসহ এখানে শায়িত রয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি তারা আছেন, তারাই আমাদের ভালোবাসা শিখিয়েছেন। তারা এখানে ইসলাম জারি করেছেন। যুদ্ধ করে তা করেননি। কাউকে ধমকিয়ে শাসন করেও করেননি। ভালোবেসে করেছেন। আপনারাই হচ্ছেন, সেই ভালোবাসার উত্তরসুরী। যেখানে আল্লাহ রাব্বুল আল আমীনের ভালোবাসা আছে, সেখানে আমি কেন সেই ভালোবাসা গ্রহণের জন্য উদগ্রিব হব না।
স্যার আবু জাফর মাহমুদ ছাতকের জনগণের প্রিয় মানুষ জননেতা কবীর মিয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, একজন সৎ মানুষ পেয়েছি। যোগ্য মানুষ। উপযুক্ত নেতা। কর্মঠ মানুষ। আমি তার মাধ্যমেই শীতের সময় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছি। আমি একা ছিলাম কিন্তু পরে তা হয়ে উঠলো একটি পরিবার। আস্তে আস্তে যুক্ত হয়ে গেল কবীর ভাইয়ের আরেক ভাই লিলু মিয়া, জিতু মিয়া, বোন শিউলী বেগমসহ সবাই। একসঙ্গে মিলেই কাজটি করছি। ভালোবাসার এ এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। এক অসাধারণ ও স্পন্দিত ভালোবাসা। তিনি বলেন, আমার এখানে শেকড় হয়ে গেছে। প্রত্যন্ত হাওড়ের মানুষ বুক-সমান পানির ভেতর যখন অসহনীয় জীবন পার করছে, তখন একত্রিত হয়ে এই এলাকাবাসী একযোগে তাদের পাশে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমি তখন আপনাদের মাঝে আমাকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছি। কারণ, আমার কৈশোর, তারুণ্য ও যৌবনের সময়গুলো কেটেছে ঠিক এই রকম। আমি সন্দ্বীপের মানুষ। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, তুফান ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি।
আবু জাফর মাহমুদ জাতির রাজনৈতিক বিভক্তির প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, তিনি বলেন, আমি কোনো রাজনীতিবীদ নই। যে সমস্ত রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিবিদ আমাদের বিভক্ত করেছে তাতে আমাদের কোনো লাভ হয়নি। তাদের কী লাভ হয়েছে, এটি তারাও বোঝে আমরাও বুঝি। ’৭০-এ আমরা বিভক্ত না হয়ে একতাবদ্ধ হয়েছিলাম, তখন শ্লোগান দিতাম ‘জয় বাংলা’। ছাত্রজীবনে তখন উপলব্ধি করতাম বাংলা ভাষাভাষীরা আমরা সবাই এক। কিন্তু যখন একতাবদ্ধ আন্দোলন করতে করতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ জন্ম দিয়েছি। তখন আমার শ্লোগান হওয়া প্রয়োজন ছিল ‘জয় বাংলাদেশ’। আমি শ্লোগান দেই ‘জয় বাংলাদেশ’। আমার জয় বাংলার পথ ধরেই এসেছে ‘জয় বাংলাদেশ’। যদি দেশকে ভালোবাসি তবে এই একটিই শ্লোগান হতে হবে। যদি ভালোবাসার অভিনয় করি, তাহলে অনেক রকমের শ্লোগান দিতে পারি।ড. আবু জাফর মাহমুদ আমারে রাজনৈতিক বিভক্তি ও অন্যান্য প্রসঙ্গে বলেন, একাত্তরের যুদ্ধের সময়, যারা বিরোধীতা করেছিল যুদ্ধ জয়ের পর তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। আমরা বিজয়ী। বিজয়ীরা কখনো শত্রুকে চিরকাল ঘৃণা করে না। এটি পরাজিতদের কাজ। যে বিজয়ী সে বীর। তার বিজয় অর্জিত। তার মর্যাদা সর্বোচ্চ। সর্বোচ্চ যার আছে সে আর কি চায়? যেসব মানুষের কোনো সঠিক নিশানা থাকে না, চেতনা থাকে না, তারা বিজয়ী হবার পরেও সুস্থির হতে পারে না। নিজের ভেতরেই পরাজয়টা কাজ করে। আমার তা করে না। আমরা সবাই একতাবদ্ধভাবে বাংলাদেশের মানুষ। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি।
ড. মাহমুদ ছাতক বাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, আমি কোনো রাজনৈতিক দলের নই। আপনাদের কারো সঙ্গে আমার কোনো পারিবারিক সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, পরিবেশ ও প্রকৃতি যারা ধংস করছে, তারা আমাদের নিঃশ্বাস নেবার শক্তিকে কেড়ে নিচ্ছে। অক্সিজেন পাওয়ার উৎস্যগুলো ধংস করে দিচ্ছে। একজন মানুষকে গুলি করে হত্যা করলে সে ঘাতক হয়, তাহলে যারা শত শত মানুষকে হত্যা করে পরিবেশ ধংস করে তারা কী? তার এই প্রশ্নের জবাবে উপস্থিত দর্শকরাই সমস্বরে বলেন ‘গণ হত্যাকারী’। ‘তারা গণহত্যাকারী’। ড. মাহমুদ বলেন, সেই গণহত্যাকারী মানুষ সংখ্যায় বেশি নয়। মাত্র কয়েকজন। আপনারা এমন পরিবেশ পরিস্থিতি গড়ে তুলুন, যাতে কেউ কোনো গাছ না কটে। হাওরের ভেতর দিয়ে রাস্তা না করে। শহরের ভেতরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ধংস না করে। আপনারা এ ব্যপাারে আবু জাফর মাহমুদ ফাউন্ডেশনকে সব সময় পাশে পাবেন।
Posted ৫:১৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৩
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh