বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪
ভালো মেলা’য় সঙ্গীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী তাহসান খাান
নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটিতে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে ‘ভালো’। স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সমাবেশ ঘটেছে ভালো মেলায়। বাংলাদেশী অধ্যুষিত জ্যামাইকা হিলসের হাইল্যান্ড এভিন্যুতে বইয়ে গেছে মানুষের বন্যা। নারী-পুরুষ, শিশু ও নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশী অভিবাসীদের বহুমুখী স্রোতধারা সেদিন মিলে গিয়ে পরিণত হয় জনসমুদ্রে। ভালো মেলাকে কেন্দ্র করে হাজারো প্রাণের স্পন্দনে কম্পিত হয়ে উঠে গোটা জ্যামাইকা এলাকা।
নিউইয়র্ক ভিত্তিক অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশী আমেরিকান হিউম্যানিটেরিয়ান এইড লীডারশীপ আউটরিচ’ সংক্ষেপে ভালো। সংগঠনটির উদ্যোগে জ্যামাইকার হাইল্যান্ড এভিন্যুতে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে প্রথমবারের মতো ‘ভালো মেলা’ অনুষ্ঠিত হয় গত ৩০ জুন রোববার। জ্যামাইকা হিলসের ১৬৫ স্ট্রিট থেকে ১৬৯ স্ট্রীট জুড়ে প্রশস্ত হাইল্যান্ড এভিন্যুতে বিশাল এলাকা জুড়ে ভালো মেলা অপরাহ্ন ২টা থেকে শুরু হয়ে চলে সন্ধ্যা ৮টা পর্যন্ত। এজন্য গ্রহণ করা হয় ব্যাপক প্রস্তুতি। মেলার গ্র্যান্ড স্পন্সর ছিলো ডিএইচ কেয়ার। এই মেলায় অন্য কোন স্পন্সর ছিলো না।

রোববারের পড়ন্ত বিকেলকে বাংলাদেশী কমিউনিটির জন্য উপভোগ্য করে তুলে ভালো মেলা। দীর্ঘদিন নির্মল বিনোদনের খরায় ভুগছিলো কমিউনিটি। প্রকৃতির বর্ষণের সাথে ভালো মেলার সাংস্কৃতিক আয়োজন দর্শক শ্রোতাদের আবিষ্ট করে। শুধু বৃষ্টির ঝুকি মাথায় নিয়েই নয় কাক ভেজা হয়েও সেদিন মেলা প্রাঙ্গণকে মুখরিত করে রাখে তারা।

উল্লেখ্য চমৎকার আবহাওয়ার মধ্যে বিকেলে দফা দু’য়েক বৃষ্টির কবলে পড়ে মেলা। তারপরও উচ্ছ্বাস কমেনি মানুষের। গতানুগতিক পথমেলায় খোলস থেকে বেড়িয়ে এসে ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বের আয়োজন করে ভালো। এই পর্বটি মূলত রূপ নেয় কনসার্টে। ঝাঁক বাঁধা শিল্পীর পরিবর্তে দেখা যায় বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় গায়ক তাহসান খান, মোজা, মাশা ও রন্টিকে সঙ্গীত পরিবেশন করতে। তারা দর্শক-শ্রোতাদের পছন্দনীয় ভিন্ন ধাঁচের গান গেয়ে মাতিয়ে রাখেন পুরো অনুষ্ঠান। বিশেষ করে তাহসান খানের গানের সময় ঘটে অভাবনীয় দৃশ্যের অবতারণা। এসময় অনুষ্ঠানস্থলে ঠাঁই না পাওয়া অনেককে পার্শ্ববর্তী বাড়ির চালে উঠে গান শুনতে দেখা যায়। তাহসানের গানের মধ্য দিয়েই সমাপ্তি ঘটে ভালো মেলার।

ভালো মেলা নানা কারণেই পায় ভিন্ন মাত্রা। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরণের বাহারি স্টলে ক্রেতাসাধারণের ভীড় ছিলো উপচেপড়া। নারী-পুরুষ শিশুদের জন্য ছিলো হাল ফ্যাশনের পোষাকের সমাহার। শাড়ী, সালোয়ার কামিজ, পায়জামা-পাঞ্জাবী সহ গহনা ও তৈজষ পত্রে ঠাসা ছিলো স্টলগুলো। শিশুদের জন্য খেলনার কমতি ছিলো না। খাবার স্টল গুলোতে দেশীয় খাবারের পাশাপাশি ছিলো আফগান, ভারতীয় ও মেডিটেরিয়ান ফুড। চা সিঙ্গারা, সামুচা, ফুচ্্কা, ঝালমুড়ির স্টল ছিলো অনেকগুলো। আটটায় মেলা বন্ধ হলেও রাত ৯টা পর্যন্ত বেচা-কেনা চলে অনেক স্টলে। হাইল্যান্ডের পাশের বাড়িগুলোর বাইরে বসে চায়ের আড্ডা।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবেশ বিষয়ক তথ্য সহযোগিতা প্রদানের জন্যও ছিলো অনেকগুলো স্টল। এছাড়া মূলধারার বেশ কয়েকটি স্টল ছিলো ভালো মেলায়। শিশুদের জন্য ছিলো আকর্ষনীয় খেলাধূলার ব্যবস্থা। শিশুরা ঘোড়ায় চড়ার অভিজ্ঞতা নিয়েছে বাবা-মার সাথে মেলায় এসে। এছাড়া রক ক্লাইমবিং, বাউঞ্চি হাউজ, ফেইস পেন্টিং সহ অন্যান্য খেলাধূলায় শিশুরা ও তাদের পরিবার অতিবাহিত করে আনন্দঘন কিছুটা সময়। ভালো মেলায় অংশগ্রহণকারীদের দৃষ্টি কেড়েছে ব্যতিক্রমী ও আকর্ষনীয় ‘কার শো’।
ম্যাডিসন কার ক্লাব এক ডজনের অধিক সর্বাধুনিক মডেলের দামি গাড়ি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে। অনেক শিশু এবং পরিবার এসব গাড়ি দর্শন করেন এবং ছবি তুলেন। ভালো’র প্রাণপুরুষ শাহারিয়ার রহমান মেলায় উপস্থাপন করেন নিউইয়র্ক সিটির পাবলিক এডভোকেট জুমানী উইলিয়ামস ও নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলীমেম্বার জোহরান মামদানিকে। ডেমোক্র্যাট দলীয় উভয় জনপ্রতিনিধি তাদের বক্তব্যে ভালো’র কমিউনিটি ভিত্তিক মেলা আয়োজনের প্রশংসা করেন। তারা বলেন, এই মেলার মধ্য দিয়ে নিউইয়র্কে অভিবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটি জাতীয় পরিচিতি আরো ব্যপকতা লাভ করবে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম এবং অন্যান্য জাতি গোষ্ঠির মানুষ বাংলাদেশী সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে।
নেতৃবৃন্দ নিউইয়র্ক সিটির উন্নয়নে বাংলাদেশী কমিউনিটির অবদানের কথা স্মরণ করেন এবং কমিউনিটির সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। এছাড়া সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটির সভাপতি ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ছিলেন ভালো’র পাবলিক রিলেশন পরিচালক-শাহারিয়ার নবী।
শাহারিয়ার রহমান মেলায় অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানান সবাইকে। ভালো মেলাকে কেন্দ্র করে পুরো এলাকায় ভিন্ন আমেজ ও আবহের সৃষ্টি হয়। মেলায় অভূতপূর্ব শৃংখলা ও নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলো নজিরবিহিন। হাইল্যান্ড এভিন্যুর ১৬৪ স্ট্রিট থেকে হোমলন স্ট্রিট পর্যন্ত পুরো এলাকায় কড়া নিরাপত্তায় ছিলো এনওয়াইপিডি পুলিশ। দক্ষিণে হিলসাইড এভিন্যু এবং উত্তরে গথিক এভিন্যুর মাঝের সবগুলো স্ট্রিটের মুখে ছিলো পুলিশি প্রহরা। এনওয়াইপিডি পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, প্রাইভেট সিকিউরিটি ছাড়াও ভালো’র বিপুল সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক নিরাপত্তা বেস্টনী গড়ে তুলে। কোথাও ঘটেনি কোন অপ্রীতিকর ঘটনা। পূর্ব ঘোষণামতো সন্ধ্যা ঠিক ৮টায় বন্ধ করা হয় মেলার কার্যক্রম। নিউইয়র্ক সিটি ছাড়াও লং আইল্যান্ড, নিউজার্সি, কানেকটিকাট সহ পাশ্ববর্তী শহরগুলো থেকে অনেকে আসেন মেলায়।
ভালো মেলার বিশেষত্ব হলো-কমিউনিটির চলমান অন্যান্য পথমেলার গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে নতুনত্ব উপহার দেয়ার মধ্যে। এই মেলায় ডজন-ডজন পৃষ্ঠপোষক, ঝাঁক ঝাঁক শিল্পী, বিভিন্ন ধারার অতিথি, ভাই ব্রাদারের পরিচিতি ও কমিউনিটির একশ্রেনীর ভবঘুরের মঞ্চ দখলের সুযোগ ছিলো না। উদ্বোধনী পর্ব, ফিতা কাটা, বৃক্ততাবাজি, মাইক টানাটানি, এওয়ার্ড প্রদান ও ফটোসেশনের বিরক্তি সৃষ্টির কোন বালাই ছিলো না মেলায়। একই ধরণের বস্তাপচা গান ঝালাপালা করতে পারেনি দর্শক-শ্রোতাদের কান। উপস্থাপকের অতি কথনের ফুলঝুড়ি না থাকায় অনেকদিন পর নির্ভেঝাল একটি অনুষ্ঠান উপভোগ করেন কমিউনিটির সাধারণ মানুষ। অসাধারণ এই অনুষ্ঠানের পেছনের কারিগররা এভাবেই পর্দার অন্তরালে সাফল্যের ফসল গোলায় তুলেন। বাংলাদেশী কমিউনিটিকে ভালো যে আনন্দ উপহার দিয়েছে তা তারা অনেকদিন মনে রাখবেন বলে মন্তব্য করেন অংশগ্রহণকারীদের অনেকে।
দীর্ঘদিন পর ভালো মেলায় সাক্ষাত ঘটে অনেক পুরনো বন্ধুর সাথে। এক প্রতিক্রিয়ায় শাহারিয়ার রহমান বলেন, মেলার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ ছিলো কমিউনিটির শিশু, কিশোর ও টিনেজরদেরকে সম্পৃক্ত করা। তারা যদি এখানে নিজেদের সম্পৃক্ত করে আনন্দ পায়, তাহলেই সফল হবো। আমরা মেলার আয়োজন করার পেছনে আরো একটি কারণ হলো কমিউনিটির বিভিন্ন শ্রেণীর ও বয়সের মানুষকে এখানে বিভিন্ন বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের নতুন একটি স্বপ্ন তৈরিতে সহায়তা করা। ভালো কিছু করতে উৎসাহিত করা। সে অর্থে আমরা অনেকটাই সফল বলে মনে করছি। মেলায় কোন প্রবেশ মূল্য ছিলো না।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিককালে নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটিতে সেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে ‘ভালো’। নিউইয়র্ক ভিত্তিক অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশী আমেরিকান হিউম্যানিটেরিয়ান এইড লীডারশীপ আউটরিচ’ সংক্ষেপে ভালো। ভয়াবহ করোনা মহামারিকালে গোটা নিউইয়র্ক সিটি যখন নিস্তব্ধ, মূহ্যমান শোকে। তখন একদল নির্ভীক তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেমে আসেন রাস্তায়। সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন করোনা আক্রান্ত মানুষের প্রতি। বিশেষ করে খাবার, চিকিৎসা ও করোনা প্রতিরোধী সামগ্রী নিয়ে। শাহারিয়ার রহমানের নেতৃত্বে সেই থেকে তারা দরিদ্র ও দুর্গত মানুষের পাশে থেকে কুড়িয়ে আসছেন প্রশংসা। মূলধারার জনপ্রতিনিধিদের সাথেও রয়েছে তাদের নিবিড় সর্ম্পক। রোজা, ঈদ সহ বিভিন্ন উৎসবে ভালো আয়োজন করে থাকে সামাজিক সম্প্রীতি সমাবেশ।
Posted ১২:৫৩ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh