বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ২৪ আগস্ট ২০২৩
সমবেত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছেন মিজানুর রহমান আজহারী
মুসলিম উম্মাহ অফ নর্থ আমেরিকা – মুনা’র ষষ্ঠ কনভেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে ফিলাডেলফিয়ার পেনসিলভেনিয়া কনভেনশন সেন্টারে। গত ১৮ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী কনভেনশনে সমাবেশ ঘটে২০ স্রহস্রাধিক মানুষের। নারী-পুরুষ-শিশুসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেট থেকে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশী মুসলিমগণ।
মুনা’র সদস্য ছাড়াও বিপুলসংখ্যক মানুষ সপরিবারে অংশ নেন কনভেনশনে। ফিলাডেলফিয়া সিটির ডাউন টাউনে প্রায় সবগুলো হোটেল ছিল কনভেনশনে অংশগ্রহণকারী দ্বারা পূর্ণ। এর আগে ফিলাডেলফিয়ায় পেনসিলভেনিয়া কনভেনশন সেন্টারে আরো দুবার মুনার কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নজর কাড়ে সবার । তাদের জন্যও ছিল পৃথক অনুষ্ঠানাদি। অবিবাহিত তরুণ-তরুণীদের জন্য তাৎক্ষণিক বিয়ের আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানও ছিল এই কনভেনশনে।
“আল-কোরআন: গাইডেন্স অফ হিউম্যানিটি” শীর্ষ প্রতিপাদ্যের ওপর ভিত্তি করে সাজানো হয় পুরো অনুষ্ঠানমালা। তিনদিনের কনভেনশনে একই সময়ে একাধিক মিলনায়তনে চলে সমান্তরাল আলোচনা পর্ব। বিশ্বের চারটি মহাদেশ থেকে আগত অর্ধশতাধিক ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক অংশগ্রহণ করেন আলোচনা পর্বে।
প্রতিটি আলোচনাই ছিল প্রাণবন্ত এবং দর্শক-শ্রোতায় ঠাসা। নিবন্ধন কার্যক্রম, পন্যের বাজার, ফুডকোর্টসহ সর্বত্র বিরাজ করে শৃঙখলা। বিপুল সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক কনভেনশন প্রাঙ্গণে গড়ে তোলেন চমৎকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মাওলানা মিজানুর রহমান আযহারীর বক্তব্যের সময় মূল মিলনায়তন এবং এর বাইরে প্রশস্ত লবি ও করিডোরে ঠাঁই ছিল না তিল ধারণের । যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী মুসলিমদের এত বড় সমাবেশ আগে কখনো অনুষ্ঠিত হয়নি।
কনভেনশনে পরপর দু’দিন বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা ড. মিজানুর রহমান আজহারী আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। তার বক্তব্য শুনতে কনভেনশন সেন্টারের বিশাল কেন্দ্রীয় হলরুম ছিল কানায় কানায় ভর্তি। অনেকে প্রাচীর ঘেষে দাঁড়িয়েছে এবং সামনের প্রশস্ত করিডোরে দর্শক-শ্রোতারা করিডোরে দাঁড়িয়ে-বসে তার বক্তব্য শুনেছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মিজানুর রহমান আজহারীর জনপ্রিয়তা এত বেশি ছিল যে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার তার বেড়ে চলা জনপ্রিয়তাকে ভীতির চোখে দেখতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে তাকে দেশ থেকে বিতাড়ন করে। বর্তমানে তিনি মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন। মুনা’র কনভেনশনে তিনি যখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কোরআনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করছিলেন তখন ধর্মপ্রাণ প্রবাসী মুসলমানদের মাঝে ছিল পিন পতন স্তব্ধতা।
মিজানুর রহমান আজহারী কনভেনশনের দ্বিতীয় দিন গত ১৯ আগস্ট শনিবার সন্ধ্যায় তার আলোচনায় বলেন, আল কোরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষ তথা সমগ্র জীবজগতের জন্য প্রদত্ত নিরাময়। কোরআন এক কালজয়ী অলৌকিক ঘটনা। মহান রাব্বুল আল্লাহতা’য়ালার যেমন লয় নাই, ক্ষয় নাই, তেমনি কোরআনেরও কোন লয় নাই, ক্ষয় নাই। মুনা সম্মেলনের আয়োজকরা জানান, ড. মিজানুর রহমান আজহারী এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যে কোরআন ও হাদিসের আলোকে আলোচনা এবং মুনা কনভেনশনে অংশ নিয়েছেন।
সম্মেলনে ইসলামি চর্চা ও আলোচনা ছাড়াও ছিল সেমিনার, ছোটদের অনুষ্ঠান, মহিলাদের জন্য আলাদা অনুষ্ঠান, বাচ্চাদের খেলাধুলা, কালচারাল প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ প্রোগ্রাম। চার মহাদেশ থেকে ইসলামী চিন্তাবিদগণ কনভেনশনে যোগ দেন। মুনা কনভেনশনের চেয়ারম্যান আরমান চৌধুরী সিপিএ ও আনিসুর রহমানের যৌথ সঞ্চালনায় শনিবারের আলোচনায় অংশ নেন- ড ওমর সুলাইমান, ড আলতাফ হোসেন, হারুণ ও রশিদ ও সাইখ আব্দুল নাসির জাঙ্গদা।
বাংলা ভাষাভাষি তরুণদের শ্রদ্ধার পাত্র ড. মিজানুর রহমান আজহারী আরও বলেন, কোরআন না থাকলে পৃথিবীতে আমাদের আসার উদ্দেশ্য কি তা জানতে পারতাম না। ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াতাম। খেতাম, কাজ করতাম, পৃথিবী আবাদ করতাম, উন্নয়ন হতো কিন্তু পৃথিবীতে আমাদের আসার উদ্দেশ্য কি? তা কখনই জানতে পারতাম না। কোরআন আমাদেরকে সেটা পরিস্কার করেছে। তিনি আরো বলেন, বলেন, কোরআন ছাড়া সকল ধর্মগ্রন্থই নবীদের উপর একবারেই নাজিল হয়েছে। কিন্তু কোরআন নাজিল সম্পন্ন হতে সময় লেগেছে ২৩ বছর। কোরআন আমাদের আলোকিত জীবনের সন্ধান দেয়, উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানো মানবতাকে আলোকিত করে। কোরআন বিশ্লেষন করে দেখা যায় একটি ভূ-খন্ডের অক্ষর জ্ঞানহীন জাতি ও গোষ্টির পুরো জীবনধারাকে পাল্টে দিয়েছিল এই কোরআন।
তিনি মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যু সম্পর্কে বলেন, কিছুদিন আগে আমরা আমাদের প্রিয় আল্লামাকে হারিয়েছি। আমরা এই ভেবে বুকে আশা বেঁধে রাখি যে, এই দুনিয়ায় তাঁকে সাময়িকভাবে হারিয়েছি। কিন্তু কেয়ামতের দিনে, জান্নাতে এই কোরআনের বুলবুলির কন্ঠে আমরা আবার কোরআন শুনতে পাবো। একইভাবে বাবা-মা, বন্ধুকেও হারিয়েছি। এ বিচ্ছেদ সাময়িক। আমরা তাদেরকে জান্নাতে একদিন পাবো। পরদিন দুপুর ১২টার দিকে ড. মিজানুর রহমান আজহারী পুনরায় কোরআনে উল্লেখিত মানব জীবনের রিযিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি সূরা যারিয়াত, সূরা বাকারা, সূরা হুদ, সূরা বনী ইসরাইল ও সূরা রহমানের বিভিন্ন আওয়াতের অর্থ ব্যাখ্যা করে রিযিক নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। তিনি বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ হলেন তিনি, যিনি রিযিকদাতা এবং মহাশক্তিধর ও মহাপরাক্রমশালী। আল কোরআনে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছেন, তিনি হলেন রিযিকদাতা। আল্লাহ আমাদের রিযিক দান করেন। কিন্তু রিযিক নষ্ট করতে বলেন নি। আপনাকে আল্লাহ অনেক রিযিক দান করেছে? তাহলে আপনি সাবধান হোন। কারণ, এটা একটি পরীক্ষা।
আজহারী ২০১০ সালে ইসলামি গজল ও কিরাত দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি একটি বাংলা টিভিতে ইসলামি অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে তিনি ওয়াজ-মাহফিল নিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি অল্প কয়েক বছরেই সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেন। বর্তমানে যে ক’জন ইসলামি চিন্তাবিদ রয়েছেন, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পড়াশোনার কারণে তার নামের সাথে ‘আজহারী’ উপাধি যুক্ত হয়েছে। খুব অল্প সময়ে সুললিত কণ্ঠে কুরআন-হাদিসের সহজ-সাবলীল আলোচনা করে অসংখ্য মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। তার গবেষণাধর্মী আলোচনার কারণে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। তিনি বাংলা, আরবি, ইংরেজি ভাষায় খুবই দক্ষ। যে কারণে বিভিন্ন দেশের মানুষ তার আলোচনা বুঝতে পারে। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন।
পোস্ট-গ্রাজুয়েশন শেষ করে মালয়েশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে এমফিল এবং পিএইচডি করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৬ সালের মধ্যে এমফিলও শেষ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘হিউম্যান এম্ব্রায়োলজি ইন দ্য হোলি কুরআন’। তারপর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হন। ‘হিউম্যান বিহ্যাভিয়ারেল ক্যারেক্টারইসটিক্স ইন দ্য হোলি কুরআন অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল স্টাডি’র ওপর পিএইচডি গবেষণা করছেন। তার এমফিল এবং পিএইচডির মাধ্যম ছিল ইংরেজি।
গত শুক্রবার সম্মেলনে বক্তব্য দেন মুনার ন্যাশনাল কমিটির সভাপতি হারুন ও রশীদ, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা লুৎফর রহমান, আব্দুস সালাম আজাদী ও আহমেদ আবু ওবায়দুল্লাহ। উল্লেখ্য, গত ১৮ আগস্ট শুক্রবার কনভেনশনের উদ্বোধনী দিবসে বিভিন্ন সেশনে বক্তব্য দেন মুনার ন্যাশনাল কমিটির সভাপতি হারুন ও রশীদ, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা লুৎফর রহমান, আব্দুস সালাম আজাদী ও আহমেদ আবু ওবায়দুল্লাহ। দ্বিতীয় দিনে বিভিন্ন ইভেন্টে শিশু কিশোরদের মধ্যে প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশন করেন মুনার বিভিন্ন চ্যাপ্টার থেকে আগত শিল্পীরা। মহিলা ও তরুণদের পৃথক অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদগণ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা রাখেন।
মুনা কনভেনশনে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়
ফিলাডেলফিয়ায় পেনসিলভেনিয়া কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত মুনা কনভেনশনের দ্বিতীয় দিনে গত ১৯ আগস্ট শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময়ে মিলিত হন মুসলিম উম্মাহ অব নর্থ আমেরিকার (মুনা) নেতৃবৃন্দ। মতবিনিময়ে কনভেনশনে নানা বিষয়ে ক্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে সাংবাদিকদের মতামত ও পরামর্শ চান তারা।
সাংবাদিকরা কনভেনশনের সুষ্ঠু সুশৃংখল আয়োজনের প্রশংসা করে আগামী কনভেনশনে সম্ভব হলে সকল সাংবাদিকদের জন্য একই হোটেলে রুম বুকিং দেওয়ার আহবান জানান। এছাড়া তারা কনভেনশনের প্রধান বক্তা বা অতিথির সাথে আলাদা করে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলেন। খাওয়া সমস্যা, হোটেলে যাতায়াত ও নানাবিধ সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। নেতৃবৃন্দ আগামীতে এসব বিষয়ে খেয়াল রাখবেন বলে আশ্বাস দেন। মতবিনিময়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন মুনা ন্যাশনাল কমিটির প্রেসিডেন্ট হারুন অর রশীদ, কনভেনশনের চেয়ারম্যান আরমান চৌধুরী।
মুনা সোসাল সার্ভিস এর ডাইরেক্টর আব্দুল্লাহ আরিফের সঞ্চালনায় উপস্থিত ছিলেন মুনার সাবেক ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমাম মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন, মুনার এসিসটেন্ট এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর ও মিডিয়া কালচারাল বিভাগের ডাইরেক্টর আনিসুর রহমান গাজী, কনভেনশনের কো-চেয়ারম্যান ড: নকিবুর রহমান তারেক, জিয়াউল ইসলাম শামীম ও মুনা কনভেনশনের পাবলিসিটি ও মিডিয়া বিভাগের সদস্য রশীদ আহমদ।
Posted ৩:৩৭ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৪ আগস্ট ২০২৩
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh