বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২০
টেক্সাসের এল পাসো কাউন্টিতে করোনার সংক্রমণে মৃত ব্যক্তিদের হিমঘরে নিয়ে যাচ্ছেন কর্মীরা। ছবি : রয়টার্স
যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। মহামারী শুরু হওয়ার পর গত মঙ্গলবার এক দিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত মে মাসে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ দুই হাজার রোগীর মৃত্যু হয়েছিল। গত মঙ্গলবার সেই রেকর্ড ছাড়িয়ে একদিনে মৃত্যু ঘটেছে ২,১৫৭ জন রোগীর। সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে হাসপাতালগুলো কোভিড আক্রান্ত রোগীতে পূর্ণ। রোগীর স্থান সংকুলানের কোনো ব্যবস্থা নেই। রয়টার্সের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে গত মঙ্গলবার কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন করে রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। এছাড়া মঙ্গলবার একদিনে আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে স্বাস্থ্য বিধি অগ্রাহ্য করে লোকজন যদি আসন্ন হলিডে সিজনে অতিউল্লাসে মেতে উঠে তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। গত মঙ্গলবার কোভিড আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৮৭ হাজার। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ঘরোয়া পার্টিগুলোতেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং সবসময় মাস্ক লাগিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। কোভিড ট্র্যাকিং প্রজেক্ট বলছে, গত সপ্তাহে দেশটিতে ৮৮ হাজার ৮০ জন মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলন। যা চলতি বছরের শুরুতে করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর থেকে সর্বোচ্চ।
নিউইয়র্ক সিটির ষ্ট্যাটেন আইল্যান্ড বরোকে রেড জোন ঘোষণা করা হয়েছে। গত সপ্তাহ থেকে সিটির পাবলিক স্কুলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হলেও কিছু বেসরকারি স্কুল ও লং আইল্যাণ্ডের স্কুলগুলো খোলা রয়েছে। শিক্ষক ও অভিভাবকরা স্কুল খোলা রাখা নিরাপদ বোধ করছেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা গত মঙ্গলবার বলেছেন ডিসেম্বরের ১০ তারিখ পর্যন্ত সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে ৬.৪০ মিলিয়ন করোনা প্রতিরোধী ভ্যাকসিন বন্টন করা হবে। এফড্এি বলছে তারা ১০ ডিসেম্বর ফাইজারের তৈরি ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করবে।
সিএনএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা সংক্রমণ আবারও ভয়াবহভাবে বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্রে হাসপাতালের কর্মীদের সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে। গত ২৩ নভেম্বর পেনসিলভানিয়া রাজ্যের শীর্ষ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেছেন, করোনার যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে রাজ্যের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড আর খালি থাকবে না।
মিনিয়াপোলিসের হেনেপিন কাউন্টি মেডিকেল সেন্টারের হসপিটাল মেডিসিন বিভাগের পরিচালক শার্লি জি ২৪ নভেম্বর বলেন, করোনায় সংক্রমিত যেসব রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসেন, তাঁদের যন্ত্রণা কেউ বুঝতে পারবে না। এটা ব্যাখ্যা করার মতোও নয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য বেড ও যন্ত্রপাতি বাড়িয়েছি। কিন্তু আমরা তো এই মুহূর্তে চাইলেও নতুন চিকিৎসক-নার্স বাড়াতে পারব না। এ কারণে সামনে যা ঘটতে চলেছে, তাতে আমরা সবাই ভীত।’
মার্কিন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) পরিচালক রবার্ট রেডফিল্ড বলেছেন, সম্প্রতি দেশজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ হলো—করোনায় সংক্রমিত অথচ লক্ষণ না থাকা মানুষের নানা জায়গায় ঘোরাফেরা করা। ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরাই সবচেয়ে বেশি লক্ষণহীন করোনায় সংক্রমিত হচ্ছেন। এ কারণে করোনা নীরব মহামারি হয়ে উঠছে। এ ছাড়া করোনার সংক্রমণের ধরনও বদলে যাচ্ছে।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ২ লাখ ৬১ হাজার ৩৮৭জন কোভিড-১৯-এ মারা গেছে। ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন ১ কোটি ২৫ লাখের বেশি মানুষ। এর মধ্যে ৩৩ লাখের বেশি সংক্রমণই হয়েছে চলতি নভেম্বর মাসে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত মোট করোনা সংক্রমণের প্রায় এক-চতুর্থাংশই হয়েছে এ মাসে। নভেম্বর মাস এখনো শেষ হয়নি। এমনিতেই করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শীতের আগে থেকেই দ্বিতীয় দফায় দেশটি ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হতে পারে বলে সতর্ক করেছিলেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু শুধু নভেম্বরেই যে পরিমাণ করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে, তা একেবারে অভাবনীয়। শীত একেবারে দোরগোড়ায়। থ্যাংকসগিভিং ডে সামনেই। বড় দিন আছে অপেক্ষায়। উৎসবের এই সময়ে গণজমায়েত রোধ করা গেলেও সামাজিক মেলামেশা একেবারে রুদ্ধ করাটা বেশ কঠিন। ফলে অনেক আগে থেকেই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই সময়ের জন্য বিশেষ সতর্কতার কথা বলে আসছিলেন।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেসের হেলথ বিভাগের সহকারী সচিব ব্রেট গিরর ২৪ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যদি কেউ এই সময় ভ্রমণের পরিকল্পনা করে থাকেন, তাহলে ভ্রমণের আগে তাঁর করোনা টেস্টে কোনো গড়িমসি করা উচিত হবে না। সংক্রমণ এড়াতে মাস্ক ব্যবহার অন্যান্য সুরক্ষা ব্যবস্থা মেনে চলতেই হবে। এর আগে সিডিসি থ্যাংকসগিভিং ডে উপলক্ষে ভ্রমণ পরিকল্পনা বাতিল করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে বলেছে, করোনা সংক্রমণের ৫০ শতাংশের বেশি ঘটে এমন ব্যক্তি থেকে, যাদের মধ্যে কোভিড-১৯-এর কোনো লক্ষণই নেই।
সিএনএন জানায়, শুধু নভেম্বরেই ৩৩ লাখ মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। যা এ পর্যন্ত এক মাসে করোনা শনাক্ত হওয়ার সর্বোচ্চ রেকর্ড। আর ২১ নভেম্বর পর্যন্ত কোভিড-১৯–এ সংক্রমিত হয়ে ২৪ হাজার ২৯১ জন মারা গেছে, যা চলমান মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রে মোট মৃত্যুর ৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বলছে, ২৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ১ লাখ ৯৬ হাজার মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়েছে। আর ২৪ নভেম্বর একদিনেই মৃত্যু হয়েছে দুই হাজার ৮১ জনের। যা গত ছয় মাসের মধ্যে একদিনে মৃত্যুর সর্বোচ্চ সংখ্যা।
ওয়াশিংটন পোস্ট-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি নয়টি অঙ্গরাজ্যে। এই রাজ্যগুলো হলো—মেইন, আলাস্কা, মিসৌরি, নর্থ ডাকোটা, ইন্ডিয়ানা, উইসকনসিন, ওয়াশিংটন, ওহাইও ও অরেগন। করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় লুইজিয়ানার গভর্নর জন বেল এডওয়ার্ডস ২৪ নভেম্বর নতুন বিধিনিষেধ ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে রেস্তোরাঁ, জিম ও কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ধারণক্ষমতার ৫০ শতাংশ এবং চার্চ ও প্রার্থনালয়গুলোতে ৭৫ শতাংশ মানুষ নিয়ে চালাতে হবে। তবে সবখানেই সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক।
লুইজিয়ানার গভর্নর বেল এডওয়ার্ডস আরও বলেন, ঘরে ধারণক্ষমতার ২৫ শতাংশ বা ৭৫ জনের বেশি মানুষের সমাগম করা যাবে না। আর বাইরে ১৫০ জনের বেশি নিয়ে জনসমাগম করা যাবে না। এদিকে টেক্সাসেও করোনার প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাজ্যের এল পাসো কাউন্টিতে বর্তমানে করোনায় মৃত্যুর হার অনেক বেশি। সেখানে মর্গে লাশ ব্যবস্থাপনায় সহায়তার জন্য ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়েছে। ২৪ নভেম্বর এল পাসো কাউন্টির বিচারক বলেন, করোনার ভয়াবহ এই সংক্রমণ রোধে তিনি শিগগির নতুন করে কারফিউ জারি করবেন।
নিউইয়র্ক নগরের ৪০টি জিপকোডে ৪ শতাংশের বেশি হারে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। এর মধ্যে স্ট্যাটেন আইল্যান্ড এলাকার অবস্থা খুবই নাজুক। সংক্রমণের প্রকোপ অনুযায়ী বিভিন্ন রং দিয়ে এখন নিউইয়র্কের বিপজ্জনক এলাকা চিহ্নিত করা হচ্ছে। ২২ নভেম্বর রাজ্যের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো বলেছেন, পুরো স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের অবস্থা খারাপ হয়ে উঠছে। স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের হাসপাতালে স্থান সংকুলান সমস্যা হতে পারে। এখনই উপচে পড়া ভিড় শুরু হয়ে গেছে। নর্থ ক্যারোলাইনায় ২৫ নভেম্বর থেকে আবারও মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এদিকে বিশ্বে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছয় কোটি ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১৪ লাখ।
Posted ৯:৩৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh