সাহেলা সারমিন : | বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫
এমনতো হওয়ার কথা ছিলো না। কেনো এমন হলো? সাঁঝের আকাশে সন্ধ্যা তাঁরার কাছে জানতে চায় সেঁজুতি।
মাস্টার্স পরীক্ষা মাত্র শেষ হয়েছে। এক কলেজ শিক্ষকের সাথে বিয়ে হলো সেঁজুতির। অবশ্য পরীক্ষার আগেই বিয়ের কথাবার্তা চলছিলো। কথা হচ্ছিলো, ঐ কলেজে বাংলা বিভাগে একটি পদ শূন্য হয়েছে, সেই পদে এ্যাপ্লাই করে চেষ্টা করবে নিয়োগ দেয়া যায় কিনা। সেঁজুতিও বি সি এস পরীক্ষার প্রেপারেশন নিচ্ছিলো। তাই নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে ওর কোনো বিচলিত ভাব ছিলো না। ওর ভাবনা ছিলো অন্য জায়গায়। শ্বশুর বাড়ি থেকে সংসারের ঝামেলা পোহায়ে চাকরি করতে পারবে তো?
যথা সময়ে চাকরি এবং বিয়ে দুটোই সম্পন্ন হলো। এক সপ্তাহের ছুটিও শেষ হয়ে গেলো। বিশাল পৃথিবীতে বসে বসে রেডিমেড খাবারের দিন শেষ হয়ে গেলো। ভোরে উঠে নামাজ শেষে ঘর উঠান পরিস্কার করে রান্নার বন্দোবস্ত, রান্না হতে না হতেই দ্রুত অফিসের জন্য রেডি হওয়া তারপর রিক্সা,বাস আবার রিক্সা যোগে কর্মস্থলে পৌঁছানো। তারপর মাথা খাটিয়ে জার্ণি করে বাড়িতে ফিরে আবার গৃহকর্মে হাত লাগানো এক নিত্যনৈমিত্তিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
গ্রামের শান্ত নিবিড় পরিবেশ, ছায়াঘন পাখি ডাকা বন বিথিকার সম্মুখে বিশাল ফসলের মাঠ। অথচ সেঁজুতির নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা বা সময় কোনোটাই ছিলো না। উল্টো লেখালেখিটাও বন্ধ হয়ে গেলো। সেঁজুতির বাবা ছিলো না। তাই তাকে দেখতে আসার মতো কারো সেরকম তাড়া ছিলো না। মনোকষ্ট আর অস্থিরতায় রাতের বালিশে চোখের জলে চলতো শত নালিশ।
হঠাৎ একদিন সেঁজুতির নামে একটি রেজিষ্ট্রি করা চিঠি এলো। কবি শামসুর রাহমান সহ বেশ কয়েকজন নতুন কবির সাথে বিটিভিতে একটি টকশো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ। চিঠিটা দেখে ওর হাজবেণ্ড বললো, রাখো ওসব, ওখানে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। আড্ডা ছাড়া আর কি হবে? এসব লেখালেখি করে সময় নষ্ট করার কোনো দরকার নাই। সংসারে মন দাও।
এভাবেই চলতে ছিলো বেশ কয়েক বছর। হাজারো কথা মাথায় ঘোরে, চোখে ভাসে প্রকৃতির অপরূপ রূপ মাধুরি! মনের ভিতরে আকুলি বিকুলি করে কাব্য কথারা। মঞ্চে বক্তব্য, আবৃত্তি আর চলে যায় সেই আমন্ত্রণে! এমনি হাজারো স্বপ্নচারী সঙ্গ দেয় নির্ঘুম আঁধার কক্ষে। পুরোনো ডাইরিটা আলমারিতে তালাবদ্ধ। ওর কাছে অবশ্য প্যাড আছে কিন্তু সময় আর সুযোগ নেই। তীব্র ঘৃণায় আর অভিমানে বন্ধ করে দিলো লেখালেখি। তবে কষ্টের বোঝা যখন বড় হয় তখন গোপনে দু’ একটা কবিতা লিখে লুকিয়ে রাখে, কাওকে দেখায় না। অথচ বিয়ের পূর্বে সে নিয়মিত কয়েকটি পত্রিকায় লিখেছে।
টিচার্স ট্রেনিংয়ের ব্যপারেও একই নিষেধাজ্ঞা। আঠারো,আটাশ, এক সপ্তাহের ট্রেনিংগুলো নানাবিধ উপায়ে ক্যান্সেল করে দিলো। শুধু দু-তিন দিনের ট্রেনিং যেটা বাসা থেকে যেয়ে করা যায় সেগুলোতে বাঁধা নেই। সেবারেও আটাশ দিনের বিষয় ভিত্তিক ট্রেনংয়ের চিঠি এলো। সেঁজুতি বললো, এই ট্রেনিংটা তার অবশ্যই করার দরকার ছিলো। সে একজন সহকারী অধ্যাপক, এই ট্রেনিংটা তার এখনো করা হয়নি। উত্তরে ওর হাসবেন্ড বলেছে, আমাদেরকে রান্না করে খাওয়াবে কে? তোমার মেয়েকে সামলাবে কে? ওর টেক কেয়ার করবে কে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
আজ সেঁজুতির চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, এই সংসারের সব দায়ভার কি শুধু তার? তারা দু’জনেই মাস্টার্স পাস। দু’জনেই সহকারী অধ্যাপক। তাহলে অধ্যাপনার পাশাপাশি এই বাড়তি কাজ কি শুধুই সেঁজুতির একার? তার কি কোনো নিজস্বতা নেই? তার কি কোনো উন্নতির দরকার নেই? তার কি আরো বেশি কিছু শেখার দরকার নেই? তার সাহিত্যের ওপর যে মেধা সেটা কি সে বিনষ্ট করে দেবে? সাহিত্য চর্চা কি সে একেবারে বন্ধ করে দেবে? ভাত খেয়ে সে পেটের ক্ষুধা নিবারণ করে কিন্তু মনের ক্ষুধা যে তার কাব্য চর্চা, সাহিত্য চর্চা! তার কী হবে?
Posted ১১:৫১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh