জাফর আহমাদ : | বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই ২০২৪
আরবী বর্ষপঞ্জিকার প্রথম মাস মহররম। আল্লাহ তা’আলার ১২টি মাসের মধ্যে আসহারুল হুরুম বা সম্মানিত চারটি মাস যথা: রজব, যুলকা’দাহ, যুলহিজ্জাহ ও মুহররমকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। অত্যন্ত সম্মানিত এ চারটি মাসে ঝগড়া-বিবাদ, যুদ্ধ-লড়াই, খুন-খারাবী ও অন্যায়-অপরাধ থেকে বিরত থেকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা প্রতিটি মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আসলে যখন আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তখন থেকেই আল্লাহর লিখন ও গণনায় মাসের সংখ্যা বারো চলে আসছে। এর মধ্যে চারিটি হারাম মাস। এটিই সঠিক বিধান। কাজেই এ চার মাসে নিজেদের ওপর জুলুম করো না।”(সুরা তাওবা:৩৬) অর্থাৎ বিশেষ কল্যাণকারিতা ও উপযোগিতার ভিত্তিতে এ মাসগুলোতে যুদ্ধ করা হারাম করা হয়েছে সেগুলোকে নষ্ট করো না। এবং এদিনগুলোতে শান্তি ভংগ করে বিশৃংখলা ছড়িয়ে নিজেদের ওপর জুলুম করো না। আবু বাকরাহ রা: হতে বর্ণিত। নবী সা: বলেন,আল্লাহ যেদিন আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন হতে সময় যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল আজও তা সেভাবে আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। যুল-কা’দাহ, যূল-হিজ্জাহ ও মুহররাম। তিনটি মাস পরস্পর রয়েছে।
আর একটি মাস হলো রজব-ই-মুযারা(মুযারা একটি সম্প্রদায়ের নাম। আরবের অন্যান্য সম্প্রদায় হতে এ সম্প্রদায়টি রাজাব মাসের সম্মান প্রদর্শনে অতি কঠোর ছিল। তাই এ মাসটিকে তাদের দিকে সন্বন্ধ করে হাদীসে “রাজাব-মুযারা” বলা হয়েছে) যা জুমাদা ও শা’বারন মাসের মাঝে অবস্থিত।(বুখারী:৩১৯৭, কিতাবু বাদায়েল খালকে, বাবু মা জা’আ ফি সাবয়ি আরদিন, ইফা: ২৯৬৭, আ:প্র:২৯৫৬)
মহররম মাসের সবচেয়ে বড় সুন্নাহ হলো, সিয়াম পালন করা। রাসুলুল্লাহ সা: ১০ই মহররম সিয়াম পালন করেছেন। ইহুদী ও নাছারারা শুধুমাত্র ১০ই মহররমকে সম্মান করতো এবং সিয়াম পালন করতো। তাই রাসুলুল্লাহ সা: তাদের থেকে বৈচিত্র আনার জন্য ঐদিনসহ তার পুর্বের বা পরের দিনসহ সিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব সুন্নাহ হলো, ৯ ও ১০ই মুহররম অথবা ১০ ও ১১ইই মুহররম সিয়াম পালন করা। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা: যখন আশুরার দিন সিয়াম পালন করেন এবং লোকতেরকে সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ সা: বললেন, ইনশা’আল্লাহ আগামী বছর আমরা নবম তারিখেও সিয়াম পালন করবো। বর্ণনাকারী বলেন, এখনো আগামী বছর আসেনি, এমতাবস্থায় রাসুলুলাহ সা: এর ইন্কোল হয়ে যায়।(মুসলিম:২৫৫৬, আন্ত: নাম্বার:১১৩৪, কিতাবুস সিয়াম, বাবু আয়য়ু ইয়াউমিন ইউছামু ফি আশুরা, ইফা:২৫৩৩, ই.সে.২৫৩২) মর্যাদার দিক থেকে রামাযানের সিয়ামের পরেই আশুরার সিয়ামের অবস্থান। এটি পূর্ববর্তী এক বৎসরের গুনাহের কাফফারা স্বরূপ। আবু হুরাইরা রা: হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সা:কে প্রশ্ন করা হলো, ফরয সালাতের পর কোন সালাত সর্বোত্তম এবং রমযানের সিয়ামের পর কোন সিয়াম সর্বোত্তম? তিনি বললেন, ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হলো রাতের সালাত(অর্থাৎ তাহাজ্জুদ সালাত) এবং রমযানের সিয়ামের পর সর্বোত্তম সিয়াম হলো মহররমের আশরা বা ১০ই মহররমের সিয়াম।(মুসলিম:২৬৪৫, আন্ত. নাম্বার-১১৬৩, কিতাবুস সিয়াম, বাবু ফাদলি সাওমিল মুহররম, ইফা:২৬২২, ই.সে:২৬২১) কাতাদাহ আল আনসারী রা: থেকে বর্ণিত। দীর্ঘ হাদীসের শেষের দিকে ‘অত:পর আশুরার সওম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, বিগত বছরের গুনাহের কাফফারাহ হয়ে যাবে।”(মুসলিম:২৬৩৭, আন্ত: নাম্বার:১১৬২,কিতাবুস সিয়াম, বাবু ইসতিহবাবে সিয়ামে……., ইফা:২৬১৪, ই.সে:২৬১৩)
মহরর আশুরার সাওম পালনের উদ্দেশ্য ঐ তারিখে স্বৈরচারী,অত্যাচারী ও সীমালংঘনকারী ফেরাউন ও তার কওম আল্লাহর প্রিয় নবী মুসা আ: কে হত্যার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে ফেরাউনের সাগরডুবি হয় এবং মুসা আ: ও তাঁর সাথীরা আল্লাহ তা’আলার বিশেষ রহমতে অত্যাচারী ফেরাউনের হাত থেকে নিস্কৃতি পায়। তার কৃতজ্ঞতা হিসাবে মুসা আ: এদিন নফল সিয়াম রাখেন। মুসা আ: এর তাওহীদি আদর্শের অনুসারী হিসাবে স্বয়ং মুহাম্মদ সা: এদিনে নফল সিয়াম পালন করেছেন। ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা: মদীনায় হিজরত করে ইহুদীদেরকে আশুরার দিন সওম পালমরত দেখতে পেলেন। এরপর রাসুলুল্লাহ সা: জিজ্ঞেস করলেন. তোমরা কোন দিনের সওম পালন করছো, তারা বলল, এ মহান দিনে আল্লাহ তা’আলা মূসা আ: ও তার সম্প্রয়দায়কেমুক্তি দিয়েছেন এবং ফিরাউন ও তার কওমকে ডুবিয়ে দিয়েছেন। এরপর মুসা আ: কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার লক্ষ্যে এদিন সওম পালন করেছেন। তাই আমরাও এদিন সওম পালন করছি। তারপর রাসুলুল্লাহ সা: বললেন, আমরা তো তোমাদের থেকে মুসা আ: এর অধিক নিকটবর্তী এবং হকদার। অতপর রাসুলুল্লাহ সা: ঐ সওম পালন করলেন এবং সওম পালন করার জন্য সকলকে নির্দেশ দিলেন।(মুসলিম:২৫৪৮, আন্ত; নাম্বার: ১১৩০, কিতাবুস সাওম, বাবু সাওমি ইয়াউমিল আশুরা, ইফা:২৫২৫, ই,সে:২৫২৪) সুতরাং এর বাইরে অন্য কোন নিয়তে সওম পালন করা ভিত্তিহীন ও মনগড়া। রাসুলুল্লাহ সা: সাওম যে উদ্দেশ্যে সাওম পালন করেছেন, আমাদেরকে সে সুন্নাহর ওপর দৃঢ় থাকতে হবে। এ ছাড়া এদিনে আনন্দ উৎসব, তা’যিয়া, শোকে চুল ছেঁড়া, চেহেরা বিশেষভাবে সাজানো, রাস্তায় নেমে শোকগাথা গেয়ে নাচানাচি করা বা শোক মিছিল করা বৈধ হতে পারে না।
পৃথিবী তার বিশাল বুকে যতগুলো দুঃখ আর বেদনাকে ধারণ করে এখনো ঠিকে আছে এবং যতগুলো মর্মান্তিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা ইতিহাসকে বার বার কাঁদায়, তন্মোধ্য শাহাদাতে কারবালা সর্বোচ্চ আসনকে সিক্ত করেছে। প্রতিটি মুসলমান পুরুষ ও নারী হযরত ইমাম হোসাইনের রাঃ শাহাদাতের ঘটনায় আন্তরিক দুঃখ ও বেদনা প্রকাশ করে থাকে। নিঃসন্দেহে এটি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সঃ প্রতি ঈমানের স্বাভাবিক প্রতিফলন এবং মানবতার প্রতি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু সেই সাথে হৃদয় আরো দুঃখ-ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে যখন এমনটি হতে দেখা যায় যে, বিশ্ব মুসলিম ইমাম হোসাইন রাঃ এর শাহাদাতের মুল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে ভূলে গিয়ে বেহুদা সব কাজে লিপ্ত হয়। রাসুল সঃ তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে ইসলামের যে গাছটি পরিপূর্ণ মহিরূপে রেখে গেছেন তার প্রথম থেকে শেষ অবদি চাক্ষুস স্বাাক্ষী ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হযরত হোসাইন রাঃ। সেই আদর্শিক গাছটির ডাল-পালা ইতিমধ্যে কেটে দেয়া হলো। কিন্তু যখন তার মূল কর্তন ও নতুন একটি বিষবৃক্ষ রোপণ করতে এগোয়, তখন তিনি এর গতি প্রতিরোধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। আর এ জন্যই ইতিহাসের এ মর্মান্তিক অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে।
মহররমের সঠিক ইতিহাসকে বিস্মৃত করার কারণে মর্হরম বা আশুরা বা শাহাদতে কারবালাকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজ নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড ও কুসংস্কারের প্রচলন হয়েছে। বেহুদা, অনর্থক ও ধারণা ভিত্তিক এমন সব কুসংস্কারের পাহাড় গড়ে তুলেছে। সেসব থেকে বেঁচে থাকা প্রতিটি মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। বিশেষত এদিনে ক্রন্দন-বিলাপ, বুকে চাপড়ানো, পিঠে চাবুক দিয়ে আঘাত করা, নিজেকে রক্তাক্ত করা ও শোক মিছিল করা সুস্পষ্টভাবে কুসংস্কার ও বাজে কাজ। শরী’আতে এগুলোর কোন ভিত্তি আছে বলে মনে করি না। ধারণার বশবর্তি হয়ে কারবালার শহীদগণ পিপাসার্ত অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেছেন,তাই তাদের পিপাসা নিবারণের জন্য বা অন্য কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে এই দিন লোকদের পানি বা শরবত পান করানো ভিত্তিহীন ধারণা। ইমাম ও তাঁর স্বজনদের উদ্দেশ্যে ইছালে সওয়াবের জন্য বিশেষ করে হালুয়া খিচুড়ি পাকিয়ে খাওয়ানো একটি কুপ্রথা।
আমরা যদি ইমাম হোসাইন রা: এর মূল চেতনাকে উপলব্ধি না করি, তবে তাঁর প্রতি ভালবাসার পরিবর্তে সুস্পষ্ট জুলুম করা হবে। কিয়ামাতের দিন ইমাম যদি তাঁর রক্তমাখা জামা আর ছোট্র শিশু বাচ্চাদের নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির হয় এবং আমাদের কাছে প্রশ্ন করে বসেন যে, আমি কি আমার ব্যক্তিগত কোন উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার জন্য শহীদ হয়েছিলাম? তখন আমাদের কি কোন জবাব থাকবে ?সুতরাং আমাদেরকে সঠিক ইতিহাস এবং মহররমের সঠিক শিক্ষা জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী আমাদের কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে।
ইমাম হোসাইন রা: শাহাদাত আমাদের জন্য প্রেরণার বাতিঘর। আমাদেরকে ঈমামের শাহাদাতের মুল উদ্দেশ্য ভালো করে উপলব্ধি করতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদী নীতি সংরক্ষণের জন্য ইমামের শাহাদাত ছিল এক ঐতিহাসিক নযরানা। আমাদেরকে প্রথমতঃ ইসলামী সমাজ বিনির্মানের পথে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই ইমামের প্রতি ভালবাসার যর্থার্থতা প্রকাশ পাবে। মনে রাখতে হবে এ পথে বাঁধ সাজবে পৃথিবীর তাবত তাগুতী শক্তি ও কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। ইমাম হোসাইন রা:-এর মতো দৃঢ ঈমান নিয়ে আমাদেরকে এ সকল শক্তির মোকাবেলায় এগিয়ে যেতে হবে।
Posted ১:০১ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh