জাফর আহমাদ : | বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫
চীর বিস্ময়, চীর আকর্ষণীয় ও সীমাহীন ভালবাসা বুকে পুড়ে কালো গিলাফে আচ্ছাদিত হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর প্রথম ঘর বাইতুল্লাহ। “নি:সন্দেহে মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে ইবাদাত গৃহটি নির্মিত হয় সেটি মক্কায় অবস্থিত। তাকে কল্যাণ ও বরকত দান করা হয়েছিল এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য হিদায়াতের কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছিল।(আলে ইমরান:৯৬)পৃথিবীর দেশে দেশে আকাশছোঁয়া ভবন দেখেছেন, শৈল্পিক কারুকার্য সম্বলিত বিখ্যাত কতসব ভবন আপনার নযর কেড়েছে, আপনি আসুন পাহাড়ে ঘেরা এই ওয়াদিল মুকাদ্দাসে যেখানে আল্লাহর ঘর অবস্থিত। গভীর মনোনিবেশ সহকারে আপনি প্রত্যক্ষ করুন, আল্লাহর এই ঘরের চেয়ে উঁচু ভবন পৃথিবীতে আর কোনটি আপনার মনে হবে না। কালো গিলাফে ঢাকা ঘরটির সৌন্দর্য ও আভিজাত্য আপনাকে এক মহানত্বের সন্ধান দিবে।
আপনার দৃষ্টিকে বার বার মোহিত করবে। সমুদ্রের বিশালতা যেভাবে আপনার মন-মানসে বিশেষ পরিবর্তন সৃষ্টি করে আল্লাহর এ ঘরটিও আপনার মন-মানসকে বিশালতার দিকে নিয়ে যাবে। কাবার এই মহানত্ব সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, “স্থাপত্যের কৌশলের দিক থেকে কাবা গৃহ নির্মল, নিশ্চিন্ত, পরিচ্ছন্ন এবং অফুরন্ত বিনয় ও প্রেমের উৎস। এই বিনয় এবং প্রেমের সমর্থনে কাবা গৃহ মর্যাদাবান এবং ইসলামী উম্মাহর সকল প্রেরণার কেন্দ্রভ’মি। হারাম শরীফের আলোকিত বিপুল চত্বরের মাঝখানে পবিত্র কাবার অবস্থিতি গৃহটিকে আলৌকিক আকর্ষণে মণ্ডিত করেছে।
হারাম শরীফের বিপুল চত্বরের উন্মুক্ততা কাবা গৃহটিকে এমনভাবে বেষ্ঠন করে রেখেছে যে, সহজেই এই উন্মুক্ত এলাকার সঙ্গে কাবা গৃহের স্থাপত্যগত একটি সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। কাবা গৃহের অভ্যন্তরভাগ উন্মুক্ত নয়। কিন্তু চতুর্দিকের উন্মুক্ততা এবং উর্ধ্বাকাশের উন্মুক্ততা কাবা গৃহকে একটি বিপুল উন্মুক্ততার অংশভাগী করেছে। এককভাবে গৃহটি কোনো বিশেষ পার্থিব শিল্পকুশলতা বহন করে না, কিন্তু হারাম শরীফের বিপুল চত্বরের মাঝখানে গৃহটিকে একটি আলৌকিক অবস্থিতি বলে বিশ্বাস জন্মে।”
সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে অত্যন্ত আকাংখার বন্তু এই ঘর। যার কারণে পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি জনপদের লোকেরা এই ঘরের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ও আবেগ অনভুতি নিয়ে চলে আসে। খরশ্রোতা নদীর পানি যেমন সমুদ্রের টানে প্রবলবেগে বয়ে যায় তেমনি আল্লাহর প্রেমে আবর্তিত এ এক বিশাল জনশ্রোত। খরত্বাপ রোদ্র, আগুনে তাপমাত্রা, ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা ও অস্থির এক পরিবেশের মাঝে কালো গিলাফে ঢাকা এ ঘর সর্বদা শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে যায়।
দুর দিগন্তের ক্লান্ত-শ্রান্ত মুসাফির সাত সমুদ্রের ধকল নিয়ে যখন এ ঘরের কাছে আসে এবং তার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, সকল প্রকার দু:খ-কষ্ট মহুর্তের মধ্যে দূরীভুত হয়ে যায়। ধূ ধূ মরভূমির দেশে কঠিণ পাথরে পর্বতমালায় ঘেরা পাহাড়ী উপত্যকায় অবস্থিত এ যেন এক প্রস্রবন, যা নীরস শুস্ক কঠিণ হৃদয়ের মরুভুমিকে আবহমানকাল ধরে সিক্ত করে চলেছে।
পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের আনাচ-কানাচ থেকে সাহাসী জনশ্রোত হালকা অখবা ভারী প্রস্ততি নিয়ে এবং গগণ বিদারী লাশারিক আল্লাহর দীপ্ত শ্লোগান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয়। যা ওয়াদিল মুকাদ্দাসের পাহাড়-পর্বতের চড়াই-উতরাই ভেদ করে পৃথিবীর বিভিন্ন ধ্বনিত হয়। পৃথিবীর যেথায় যেথায় মিথ্যা প্রভুরা অবৈধ দখলদারিত্ব নিয়ে জবরদখল করে আছে, তাদের অবৈধ তক্ত গদি নড়ে উছে। ঐ আসছে সাহসী বীর সেনানী উজ্জবীত জীবনের দৃঢ় শফত নিয়ে।
এখনি উচ্ছেদ হতে হবে বুঝি। কালো গিলাফে ঢাকা আল্লাহর ঘর যাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর সবকিছু ঘুরছে, যাকে ঘিরে মানুষের সামগ্রীক জীবন ব্যবস্থা আবর্তিত হয়। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে তার পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থা এ ঘরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। হজ্ব মৌসুমসহ প্রায় সারা বৎসর এই ঘরের চারদিকে প্রদক্ষিণ (তাওয়াফ) করে মানুষ এ কথারই স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছে। সে জানান দিচ্ছে, আমার সামগ্রীক জীবন ব্যবস্থা এই ঘরের মালিকের ইচ্ছা মোতাবেক চলছে এবং চলবে। তাঁর মনোনীত জীবন ব্যবস্থা ছাড়া মানুষের মনগড়া অন্যান্য জীবন ব্যবস্থা আমি এই তাওয়াফের মাধ্যমে পরিত্যাগ করলাম। তাওয়াফ আল্লাহ-কেন্দ্রিক জীবনের নিরন্তর পথ চলাকে বুঝায়।
মুমিনের জীবন আল্লাহকে কেন্দ্র করে ঘোরে। আজ ‘আমি সকল কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে ঐ আল্লাহর দিকে মুখ ফিরালাম যিনি কালো গিলাফে ঢাকা এই ঘরের মালিক, যিনি আসমান ও যমীনের মালিক।’ মুসলিম সমাজ-সংস্কৃতি, তাহযীব-তমুদ্দন এই ঘরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে। এটিই মূলত: এই প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
কাবার পথের যাত্রীরা কোথায় হাজিরা দিতে যাচ্ছেন আর হাজিরা দিতে গিয়ে কি বলছেন তা অবশ্যই গভীর মনোযোগের সাথে চিন্তা করতে হবে। এমনিভাবে হজ্বের প্রতিটি অনুষ্ঠান পালন করার সময় কি করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে তা অনুধাবণ করতে হবে।
প্রকৃতপক্ষেই কি আমরা আমাদের বাস্তব জীবনকে শিরকমুক্ত করতে পেরেছি এবং আল্লাহর কাছে নিজেকে পুর্ণাঙ্গ মুসলিম হিসাবে পেশ করতে পেরেছি ? আত্মজিজ্ঞাসার জবাব যদি না বোধক হয়। তবে আমরা লাব্বায়িক বলে এ বিশ্বসম্মেলন কেন্দ্রে হাজিরা দিব ঠিকই কিন্তু আল্লাহর হাজিরা খাতায় অনুপস্থিত লেখা হবে। যেমন: প্রানহীন নামায মন্দ কাজ হতে বিরত রাখতে পরছেনা, প্রানহীন রোযা তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করতে পারছেনা ও যাকাত আমাদেরকে পবিত্র করতে পারছে না। তেমনিভাবে প্রানহীন হজ্ব আল্লাহর হাজিরা খাতায় অনুপস্থিতিই লেখা হবে। তাই কাবার পথের যাত্রীরা তাদের উপস্থিতিকে নিশ্চিত করার জন্য নিম্ন লিখিত বিষয়গুলো প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন।
হজ্জের পদে পদে শিরক না করার স্বীকৃতি ব্যক্ত করি। বিশেষত: তাওয়াফের মাধ্যমে এই স্বীকৃতি দেই যে, শুধু সালাত নয় আমার সামগ্রীক জীবন ব্যবস্থা এই ঘরের মালিকের নির্দেশিত এবং তাঁর মনোনিত বান্দা ও রাসুলের প্রদর্শিত পথে চলবে।
যেই মুসলিম কা’বার কাছে উপস্থিত হওয়ার আর্থিক ক্ষমতা রাখেন না, তারাও আল্লাহর নিদর্শন কা’বাকে সম্মুখে রেখে (কেবলামুখী হয়ে) প্রতিদিন অন্তত: পাঁচবার এই ওয়াদা করেন যে, “আমি সব দিক হতে মুখ ফিরিয়ে বিশেষভাবে কেবল সেই মহান সত্তাকেই ইবাদাত-বন্দেগীর জন্য নির্র্দিষ্ট করলাম, যিনি সমস্ত আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের মধ্যে শামিল নহি।” এবং আমরা প্রতি নামাযে এই ওয়াদাও করি যে,“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি বিশ্ব জগতের রব। তিনি রহমান ও রহিম। আমরা কেবলমাত্র তাঁরই গোলামী করি আর তাঁরই কাছে সাহায্য-সহযোগীতা কামনা করি।”
তার গোলামী করি মানে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি-অর্থনীতি, আইন-আদালত সকল কিছু এই ঘরের মালিক মহান রবের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালিত করি এবং করতে থাকবো। কোথাও যদি সামান্যতমও এর ব্যত্যয় ঘটে তবে আল্লাহর গোলামী থেকে বেরিয়ে অন্যের গোলামীতে ঢুকে যাওয়ার সমূহ সম্ভবনা থেকে যায়।
এই কা’বাকে কেন্দ্র করে শুধু হাজী সাহেবান আবর্তিত হচ্ছেন না বরং বিশ্ব মুসলিমের সকল কিছুই এই কা’বাকে কেন্দ্র করে হরহামেশাই ঘুরছে। পূর্বেই বলা হয়েছে বিশ্ব মুসলিমের সমাজনীতি, সংস্কৃতি, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি ও আইন-কানুন সব কিছুই কা’বাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, মুসলমানের কোন নীতি যদি কা’বার পথ থেকে কখনো সিটকে অন্য পথে চলে যায় বা দিক পরিবর্তিত হয়ে পড়ে তথা কা’বার নীতি থেকে বিচ্যূত হয়, তবে একজন সচেতন মুসলিম হিসাবে প্রথমে এককভাবে ও পরে সম্মিলিতভাবে তাকে কা’বার পথে তুলে দিতে হবে। আল্লাহর মেহমান হিসাবে যারা সেখানে আল্লাহর কাছে এই ওয়াদা করে এসেছেন, তাদের ওপর এই দায়িত্ব আরো বেশী করে চলে আসে।
এ কথাও বলা হয়েছে কা’বার চারদিকে প্রদক্ষিণ করা বা কা’বার দিকে মুখ ফিরানো নিছক কোন শারীরিক কসরত নহে বরং এই প্রদক্ষিণ বা মুখ ফিরানো মানে জীবনের সকল কিছুই কা’বা কেন্দ্রিক। অর্থাৎ পরিপূর্ণভাবে কা’বার মালিকের কাছে আত্মসমর্পণ করা বা মুসলিম হওয়া। এই কা’বা নির্মানের প্রাক্কালে মুসলিম জাতির পিতা ও নেতা হযরত ইবরাহিম আ: ও তাঁর সুযোগ্য সন্তান হযরত ইসমাইল আ: দূ’জনে এমনই এক দো’আ মহান প্রভুর কাছে করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, “হে আমাদের রব! আমাদের দু’জনকে তোমার মুসলিম(নির্দেশের অনুগত) বানিয়ে দাও। আমাদের বংশ থেকে এমন একটি জাতির সৃষ্টি করো যে হবে তোমার মুসলিম।”(সুরা বাকারা:১২৮)
আল্লাহর ঘর কা’বা নির্মাণের উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, তার তাওয়াফ করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা হযরত ইবরাহিম আ:-কে এর জন্য তাকীদ করেছেন এবং এ তাকীদ কুরআনের দু’ জায়গায় করা হয়েছে। “আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের জন্য পাক করো”(বাকারা:১২৫) “এ প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করতে হবে।”(হাজ্জ:২৬) পাক-পবিত্র রাখার অর্থ কেবলমাত্র ময়লা-আবর্জনা থেকে পাক-পবিত্র রাখা নয়। আল্লাহর ঘরের আসল পবিত্রতা হচ্ছে এই যে, সেখানে আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নাম উচ্চারিত হবে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর ঘরে বসে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে মালিক,প্রভু, মাবুদ, অভাব পূরণকারী ও ফরিয়াদ শ্রবনকারী হিসেবে ডাকে বা অন্য কিছুকে মাধ্যম মনে করে, সে আসলে তাকে নাপাক ও অপবিত্র করে দিয়েছে। এবং আল্লাহর ঘর প্রদক্ষিণ করে এসে বাইরে এসে একই নীতি অবলম্বন করে তারাও একই অপরাধে অপরাধী। তারা মূলত কাবার মালিকের সাথে শিরক করার দায়ে দায়ী হবেন। সে কা’বার চেতনা ভূলে গিয়ে নাপাক বা অপবিত্র জীবনের গলিতে প্রবেশ করে।
Posted ১১:৩০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh