বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই ২০২১
গ্রীষ্ম মৌসুমের ফল কাঁঠাল। সুস্বাদু ও মৌ মৌ গন্ধভরা কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল। কাঁঠালের প্রতি ভোজন বিলাসী বাংলাদেশীদের রয়েছে বিশেষ আকর্ষণ। বাংলাদেশে ঢাউশ এ ফলটি অত্যন্ত সস্তায় পাওয়া গেলেও আমেরিকায় কাঁঠালের মূল্য অনেকটাই আকাশচুম্বী। এখানে এক পাউন্ড কাঁঠালের যে মূল্য তা দিয়ে বাংলাদেশে বড় ধরণের আস্ত একটা কাঁঠাল এখনো কেনা যায়। বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের বাজারে কাঁঠাল পাওয়া গেলেও ভরা মৌসুম হচ্ছে জৈষ্ঠ এবং আষাঢ় মাস। এসময় হাট-বাজার এবং রাস্তার পাশে টাল দেয়া থাকে কাঁচা-পাকা কাঁঠাল। বিশেষ করে মধুপুর ও ভাওয়াল গাজীপুর এলাকার পাহাড়ী লাল মাটিতে ব্যাপকভাবে কাঁঠাল চাষ হলেও দেশের সর্বত্রই কাঁঠাল উৎপন্ন হয়। নিউইয়র্কে আমার বসবাস দুই দশকেরও অধিক সময় কাল ধরে। আগে এখানে বাংলাদেশী গ্রোসারীগুলোতে কালে ভদ্রে কাঁঠাল পাওয়া গেলেও তার সংখ্যা ছিলো খুবই সীমিত। বিগত কয়েক বছর ধরে গ্রীষ্মে নিউইয়র্কের বাংলাদেশী গ্রোসারীগুলোতে কাঁঠালের আমদানী এবং বেচা-কেনা দেখে মনে হচ্ছে এ যেন বাংলাদেশের কোন হাট-বাজার। আগে একটি কাঁঠালকে কয়েকটি টুকরো করে বা কোষগুলো বের করে প্যাকেটে বিক্রি করা হতো। এখন এ প্রচলন বহুলাংশে কমে গেছে। অধিকাংশ গ্রোসারীতে বিক্রি হচ্ছে আস্ত কাঁঠাল। ছোট সাইজের একটি কাঁঠাল সর্বনিম্ন ১৫ ডলার থেকে বড় আকৃতির কাঁঠাল ৮০/৯০ ডলারেও বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন জ্যামাইকা হিল সাইডের একজন সুপার মার্কেট মালিক। প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাঝে কাঁঠালের চাহিদা ব্যাপক বলে জানান তিনি।
নিউইয়র্কের বাজারে যখন কাঁঠালের অভাব, তখন প্রায় প্রতি বছরই ফ্লোরিডা থেকে বন্ধু এবং শুভান্যুধায়ীরা লোক মারফত বাক্সে ভরে কাঁঠাল পাঠাতেন। বছর পাঁচেক আগের কথা। ফ্লোরিডার ওয়েষ্ট পামবীচে বসবাসকারী মোসলেম নামে আমার একজন শুভাকাঙ্খী নিজ বাড়ীর গাছের একটি কাঁঠাল ডাকযোগে পাঠান জ্যামাইকাস্থ সাপ্তাহিক বাংলাদেশ কার্যালয়ের ঠিকানায়। মেইলম্যান কাঁঠালটি যখন ডেলিভারী দিতে আসেন তখন অফিস বন্ধ থাকায় একটি ীপ রেখে ফিরে যান। আমি ভেবেছিলাম হয়তো বা সাধারণ কোন প্যাকেজ হবে। পরদিন জ্যামাইকাস্থ ১৬৫ স্ট্রীটস্থ প্রধান পোষ্ট অফিসে প্যাকেজটি আনতে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। পোষ্ট অফিসে ঢুকতেই কাঁঠালের মৌ মৌ গন্ধ। পুরো পোষ্ট অফিস মাতোয়ারা। ীপটি কাউন্টারে দেয়ার পর তারা আমাকে বড় একটি প্যাকেজ এনে দিল। সেই প্যাকেজ থেকেই সৌরভ ছড়িয়ে পড়ছে। মূল প্যাকেজটি আরো একটি প্লাষ্টিক দিয়ে মোড়ানো হয়েছে গন্ধ নিবারণের জন্য। তারপরও বাতাসে ভাসছিলো কাঁঠালের গন্ধ। সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য মোসলেম সাহেব পূর্বাহ্নে আমাকে কাঁঠালের কথা জানাননি।
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ বিভিন্নভাবে কাঁঠাল খেয়ে থাকেন। তন্মধ্যে মুড়ি এবং খই দিয়ে কাঁঠাল খাওয়া, দুধ-ভাত বা পান্তা-ভাত দিয়ে কাঁঠাল খাওয়ার রেওয়াজ সবচেয়ে বেশী। খুলনা অঞ্চলে লেবু দিয়ে কাঁঠাল খাওয়ার প্রচলনও রয়েছে। শুধু কোষ নয় কাঁঠালের বীচি শুকিয়ে বালিতে ভেজে খাওয়া যায়। কাঁঠাল বীচি দিয়ে নানারকম মুখরোচক তরকারী রান্না করা হয়। কচি কাঁঠাল দিয়ে তরকারি রান্না করেন অনেক গৃহিনী। একসময় ছিলো কাঁঠালের ব্যাপারীরা সাধারণ লাভের মুখ দেখতেন না। কারণ পরিবহণ তখন ছিলো কষ্টসাধ্য। অপরদিকে পাকা কাঁঠাল বরাবরই পচনশীল। এখন আর সে সময় নেই। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় কাঁঠাল লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।
কাঁঠাল মূলত: গ্রীষ্মমন্ডলীয় দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের ফল। ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবাংলা, কেরালা, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে ব্যাপকভাবে কাঁঠাল উৎপন্ন হয়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মায়ানমার কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনসেও কাঁঠালের চাষ হয়। নাতিশিতোষ্ণ মন্ত্রীরা ক্যারাবিয়ান এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে প্রচুর পরিমাণ কাঁঠাল উৎপন্ন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যেও কাঁঠাল উৎপন্ন হয়ে থাকে। নিউইয়র্কের বাজারে আমদানীকৃত কাঁঠালগুলোর বেশীর ভাগই দক্ষিণ আমেরিকার। ভারতীয় উপমহাদেশে কাঁঠালের চাষ এবং খাদ্য হিসেবে ব্যবহার চলে আসছে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে থেকে। কাঁঠাল বা জ্যাক ফ্রুট নামটি এসেছে পর্তুগীজদের নিকট থেকে। পর্তুগীজরা ১৪৯৮ সালে ভারতের কেরালার মালাবার তীরবর্তী কালিকট বন্দরে প্রথম নোঙ্গর করে। এসময় তারা মালয়ালম ভাষায় ‘জ্যাক’ শব্দের সাথে পরিচিত হয়। এভাবে ল্যাটিন ভাষা হয়ে ইংরেজী ভাষায় বহুল প্রচলন ঘটে জ্যাক ফ্রুট শব্দটির।
কারো মতে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে তৎকালীন বেঙ্গল, সুমাত্রা ও মালয়েশিয়ায় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতে কর্মরত স্কটিশ উদ্ভিদ বিজ্ঞানী উইলিয়াম জ্যাক এর নামানুসারে জ্যাক ফ্রুট নামের বহুল প্রচলন ঘটে। আবার কারো মতে যেহেতু কাঁঠাল গাছ বন-জঙ্গলে জন্মায় এবং কাঁঠাল পেঁকে মাটিতে পড়লে শেয়াল এই ফল ভক্ষণ করে। আর শেয়ালের ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘জ্যাকেল’ বা ‘জ্যাক’। সুতরাং ‘জ্যাক’ শব্দ থেকেই ইংরেজীতে জ্যাক ফ্রুট এর উৎপত্তি। তা যে ভাবেই নামকরণ হোক না কেন কাঁঠাল বাঙালীদের একটি প্রিয় ফল।
কাঁঠাল শুধু স্বাদে-গন্ধে না পুষ্টিতেও ভরপুর। মায়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং শিশুর বেড়ে উঠার জন্য ভিটামিন এ ও সি, আয়রন, ক্যালসিয়াম, শর্করা ইত্যাদি সবই আছে এই ফলে। গর্ভবর্তীদের জন্য কাঁঠাল উপকারী। কাঁঠাল খেলে গর্ভস্থ সন্তানের বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়। স্তন্যদানকারী মা পরিমাণ মত পাকা কাঁঠাল খেলে দুধের পরিমাণ বাড়ে। পাঁচ মাস বয়সের পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি পরিমাণ মত কাঁঠালের রস খাওয়ালে বাচ্চার ক্ষুধা নিবারণ হয়। পূরণ হয় তার স্বাভাবিক পুষ্টির চাহিদাও। কাঁঠালে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি ও এ থাকায় চুল ও ত্বকের জন্য উপকারী। ভিটামিন এ চোখের পুষ্টি জোগায়, অন্ধত্বজনিত সমস্যা দূর করে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ফলে ক্ষতিকারক রোগ জীবানু প্রবেশ করতে পারে না। ক্ষত ও দেহের কাঁটা-ছেড়া দ্রুত শুকায় ভিটামিন সি। প্রখর রোদের জন্য গরমে যে সর্দি, কাশি, হাঁচি প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয় তা দূর করে ভিটামিন সি।
কাঁঠাল শক্তির বিশাল উৎস। এতে প্রচুর কার্বোহাইড্রেট এবং ক্যালোরি থাকলেও স্যাচুরেটেড ফ্যাট নেই বললেই চলে। এতে উপস্থিত চিনি সহজেই আমাদের শরীর হজম করতে পারে। কাঁঠালের বিটা ক্যারোটিন, লুটেইন, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট কক্সাৈভিনয়েড নামের উপাদান স্তন, প্রোস্টেট, পাকস্থলী ও ফুসফুসের ক্যান্সারের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করে। কাঁঠাল আঁশ জাতীয় ফল। এটি খাবার হজম করতে সাহায্য করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, রক্ত পরিষ্কার রাখে এবং হৃদপিন্ডের শিরা উপশিরার দেয়ালে ক্ষতিকর চর্বি জমাতে বাঁধার সৃষ্টি করে। এর পটাশিয়াম দেহের কোষগুলোর বৃদ্ধি বা বর্ধনে সাহায্য করে। কাঁঠাল গুরুপাক জাতীয় খাবার হওয়ার কারণে অনেকের হজমের সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে কাঁঠালের একটি বীচি চিবিয়ে রস খেয়ে ফেললে সেটা হজমের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এখনো গ্রামে গ্রীষ্মে শ্বশুড়বাড়ী থেকে জামাইর বাড়ীতে কাঁঠালের চালান আসে। আর তা ভাগাভাগি হয় প্রতিবেশীদের মাঝে। বাগানের কোন কাঁঠালটি পেকেছে তাৎক্ষণিকভাবে তা বুঝতে হলে পরখ করে দেখতে হবে কোন কাঁঠালের গায়ে কালো পিঁপড়ে হাঁটছে এবং কাঠ বিড়ালী তার আশে পাশে ঘুর ঘুর করছে।
কাঁঠাল খাওয়া নিয়ে বাজি ধরার রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। গল্প আছে একবার আলাল-দুলাল দুই জময ভাইয়ের একজন আলাল বাড়ীর পাশের হাটে গিয়েছিলো কাঁঠাল কিনতে। তাদের দু’জনের চেহারায় এতোটাই মিল ছিলো যে গ্রামবাসীতো দূরের কথা তাদের দু’জনকে নিজ বাবা-মাই মাঝে মাঝে পার্থক্য করতে পারতো না। হাটে গিয়ে আলাল দেখলো দূরের একজন বিক্রেতা বেশ বড় এক জোড়া কাঁঠাল নিয়ে বসে আছে। পাকা কাঁঠাল দু’টো আলালের খুব পছন্দ হলো। কিন্তু অতিরিক্ত দাম হাঁকায় আলাল বললো “এতো দাম হাঁকছেন কেন এ কাডাল আমি একলাই একটা খাইতে পারি”। বিক্রেতা বললো-‘আমার সাথে চাপাবাজি’ তুমি যদি একটা একা খাইতে পারো তা হলে বাকিটাও তোমাকে দিয়া দিবো।” আলাল বাজি ধরলো। কথা পাকা করে নিয়ে কাঁঠাল খাওয়া শুরু করলো সে। অর্ধেক কাঠাল খাওয়ার পর আলাল বললো- ‘গলা ভার হয়ে গেছে, বাড়ী থেকে একটু পানি খেয়ে আসি। যামু আর আমু।’ বিক্রেতা গড় রাজি হলো না। আলাল বাড়ি এসে দুলালকে দ্রুত ঘটনাটি বলে বাকি অর্ধেক কাঁঠাল খাওয়ার জন্য তাকে পাঠাল। দুলাল বাকিটা সাবার করে অপর কাঁঠালটি মাগনা নিয়ে বাড়ি ফিরল। আবার বোকা লোকের উদাহরণে মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়।
গল্প আছে একবার এক পাঠান বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে কাঁঠাল খেয়ে ফেঁসে যায়। পরে নিজ দেশে ফিরে বন্ধুর কাছে অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছিলো এমনভাবে-“ইয়ার, বাঙাল মুল্লুকমে এক আজীব ফুরুলট খায়া। বাহারমে খাদরা-খাদরা, অন্দর মে লাব্রা-লাব্রা (বাইরে শক্ত কিন্তু ভেতরে নরম), আওর আন্দরমে এক ডান্ডা ভি হ্যায় (এবং ভেতরে একটি ডান্ডাও আছে)। খোদা কা নূর খারাপ কর দিয়া, অর্থাৎ তার দাড়িতে কাঁঠালের আঁঠা লেগে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা ঘটে গেছে। আবার কচি কাঁঠালের আঁঠাকে গভীর প্রেমের নমুনা হিসেবে উল্লেখ করে গান রচিত হয়েছে বাংলাদেশে। ইদানিং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাঁঠাল নিয়ে গবেষণা চলছে। বিদেশে কাঠাল রপ্তানীর মাধ্যমে কাঁঠালের বাণিজ্যিকিকরণের প্রচেষ্টা চলছে। কেউ কেউ এখন কাঁঠালের উপর পিএইচডিও করছেন।
Posted ১২:২২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh