সেতারা কবির সেতু | বৃহস্পতিবার, ০৮ অক্টোবর ২০২০
নাম শুনে মনে হবে আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই বোন উপন্যাসের শর্মিলা আর ঊর্মিমালার গল্প বলছি এখানে। কিন্তু না, আজকের গল্পটা কোন উপন্যাস বা নাটকের নয়। আজকের গল্পটা আমাদের দুই বোনের। একই মায়ের পেটের দুই বোন। কিন্তু স্বভাব, চলন, রীতিতে একদম ভিন্ন।
গল্পটার শুরু আমাদের শৈশব দিয়ে। যা অতীত হয়েছে প্রায় ১৮ বছর আগে। আমরা দুই বোন আমার আব্বার দুই চোখের মনি। আব্বা দুই বোনকে সাধারণত একই রকম সবকিছু কিনে দেন। দেখা যায় আমার জিনিসের স্হায়ীত্ব সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ। সেখানে আপার জিনিস বছরের পর বছর অক্ষত থাকে। আমার জিনিসটি হারিয়ে বা নষ্ট করার পর আপার জিনিসটি চুরি করে বলি এটাই আমার। পরিবারের কারোই বুঝতে বাকি থাকেনা যে, আমি সত্য বলছি কিনা।
একবার ঈদে আব্বা দুই বোনকে নতুন জামার সাথে মিলিয়ে সুন্দর জুতা কিনে দিলেন। আমি তখন ৫ম শ্রেণির ছাত্রী। দারুণ দূরন্ত। বাহিরে খেলাধূলা ছিল আমার নিত্য দিনের কাজ। ঈদের সেই নতুন জুতা পায়ে দিয়ে বিকেল বেলা বাহিরে গেলাম। দেখি সব চাচাতো ভাই বোনরা গোল্লাছুট খেলছে। আমার প্রিয় খেলা এটি। এই খেলায় আমি যেই দলে থাকি সেই দলই সাধারণত জিতে। আমিও তাদের সাথে খেলা শুরু করলাম। সবাই বললো জুতা রেখে খালি পায়ে খেল, তাছাড়া ব্যাথা পাবি। কিন্তু আমি কি কারো কথা শুনি। জুতা পায়ে খেলা শুরু করলাম। যথারীতি জুতার গোড়ালি ভেঙে পড়ে গেলাম। পা একটুর জন্য ভাঙলো না, তবে খুব ব্যাথা পেয়েছি। সেই সাথে আমার নতুন জুতা ভেঙে, ছিড়ে শেষ। ব্যাথা পেয়ে যতোটা না কষ্ট হচ্ছে তারচেয়েও বেশি কষ্ট হচ্ছে জুতাটা নষ্ট হওয়ার জন্য।
একহাতে ছেঁড়া জুতা অন্য হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতে, মুছতে বাড়ি ফিরছি। আপা আমার অবস্থা দেখে খিল খিল করে হেঁসে উঠলো আর বললো নিষেধ করেছিলাম শুনলি না তো। এখন কেমন লাগছে। থাম, আমি মাকে বলছি। মা বকা দিল আর বললো তোর বড় বোনের কাছ থেকে শিখ কিভাবে নিজের ও জিনিসের যত্ন নিতে হয়। খুব রাগ হলো আপার প্রতি। পরের দিন আপা তার বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাবে। আপার নতুন জুতা জোড়া ব্লেড দিয়ে আস্তে করে কেটে দিলাম, যেন আপা হাঁটলেই জুতাটা ছিঁড়ে যায়। যা চেয়েছিলাম তাই হলো। আপার আর বান্ধবীদের সাথে যাওয়া হলো না। তবে এ যে আমার কাজ তা বুঝতে আর কারো বাকি রইলো না। তাই সেদিন খেতে আর দেওয়া হলো না আমাকে।
আব্বা প্রতিদিন দুই বোনকে কিছু কয়েন দিত। কয়েন পাওয়ার সাথে, সাথেই দোকানে দিতাম দৌড়। আর আপা মাটির ব্যাংকে কয়েন জমা করে খাটের নিচে রাখতো। তার অনেক কয়েন জমা হয়েছে। জমানো কয়েন দিয়ে কি, কি করবে এটা নিয়ে তার কতো পরিকল্পনা। আমি আপার মাটির ব্যাংকের মুখটা চাকু দিয়ে একটু বড় করলাম। যাতে ঝাঁকি দিলেই কয়েন বেরিয়ে আসতে পারে। এভাবে আপা ব্যাংকে কয়েন জমা করতো আর আমি সেই কয়েন নীরবে বের করে নিতাম। কিন্তু কথায় আছে, চোরের দশ দিন আর সাধুর একদিন। একদিন আপনার হাতে ধরা পড়লাম। সেদিন আপা যে মারটা দিয়েছিল তা এখনো মনে আছে।
বড় হয়েছি যৌথ পরিবারে। আব্বা কোন খাবার আনলে মা সাথে, সাথে সবাইকে ভাগ করে দিতেন। কারন রেখে দিলে কে, কখন খেয়ে নিতো তা টেরই পাওয়া যেত না। ভাগে আমাকে যা দেওয়া হতো তা আমি বিলম্ব না করে তৎক্ষনাৎ খেয়ে ফেলতাম। কিন্তু আপা কিছু অংশ খেয়ে বাকিট রেখে দিতো। যা আপা এখনো করে। আপার সেই রেখে দেওয়া খাবারটা আর আপার পেটে যেত না আমার জন্য বরাদ্দ থাকতো। শুধু আপা কেন, বড় ভাই, মা, আব্বা সবার ক্ষেত্রেই আমি এই কাজ করতাম। যার জন্য সবার কাছে কতো বকা শুনতাম।
আপা আব্বার খুবই আহ্লাদী মেয়ে। আমিও কম আদরের না। তবে আমার মনে হতো আমার থেকে আব্বা আপাকে বেশি ভালোবাসে। আপার বিয়ের হওয়ার প্রথম দিকে আপা শ্বশুর বাড়িতে ১ মাস থাকলে আমাদের বাড়িতে ১৫ দিন থাকতো। বিয়ের সময় আব্বা আপার শ্বশুরকে আগেই বলে দিয়েছিলো মেয়েটা ছেড়ে আমি বেশি দিন থাকতো পারিনা। বিয়ের পর আপা একবার আমাদের বাড়িতে এলো। বিকেল বেলা আমি আমার ঘরে আছি। হঠাৎ আমার নাম ধরে উচ্চ স্বরে আব্বা আমাকে ডাকছে। আমি আব্বার ঘরে ডুকতেই আপা কাঁদতে, কাঁদতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আব্বা আমাকে কাছে ডেকে পাশে নিয়ে বললো, তুই কি বলেছিস মা তোর বোনকে। দেখ, সে কত্তো কান্নাকাটি করছে এখানে আর থাকবে না জামাইকে ফোন দিয়েছে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আমি মনে করার চেষ্টা করছি আমার কোন কথায় আপা আবার রাগ করলো। আব্বাকে বললাম, আব্বা আমারতো মনে পড়ছে না আমি তাকে কি বলেছি। এবার আব্বা আমার হাত দুটি ধরে বললো, দেখ মা তোর বোন একটু আহ্লাদী বেশি, একটু কম বোঝে কিন্তু মনটা খুব সরল। তুই একটু গিয়ে ওর সাথে কথা বল। ও যেন চলে না যায়। আব্বার ঘর থেকে আপার ঘরে আসছি আর চিন্তা করছি বেশি আহ্লাদী হওয়া ভালো না। আপার ঘরের দরজায় এসে জিজ্ঞেস করলাম আপা ফিতরে আসি। আমাকে দেখে আপা মুখটা ঘুরিয়ে নিলো। দেখি আপা সব কাপড় গুছে ব্যাগে রাখছে। আমি বুঝতে পারলাম আপা খুব অভিমান করেছে। আপাকে মানাতে হবে। তবে আমি এটা জানি আপার প্রশংসা করলেই আপার সব রাগ শেষ হয়।
আমি আপাকে বললাম, আপা তোর হাতে যাদু আছে। তোর রান্না এতো মজাদার হয় কিভাবে বলতো। আহা! একবার খেলে সেই স্বাদ আর ভোলা যায় না। আপা এবার একটু নরম হয়েছে। আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার কোন রান্নাটা তোর বেশি ভালো লাগে বলনা। সেটা কাল রান্না করবো, আর কে,কে আমার রান্নার প্রশংসা করে। আবার গল্পের মাঝে দুঃখ করে বলে, আমার বিয়ে হয়েছে বলে আমি কি পর হয়েছি তোদের। এবার শ্বশুর বাড়িতে গেলে আর আসবো না। তখন তোরা বুঝবি। আমি আপাকে স্বাভাবিক করার জন্য বলি, তুই না থাকলে এই বাড়ির শোভা থাকে না। তুই না থাকলেও আব্বা, মা, ভাই, দাদী সবাই তোর নাম নিতেই থাকে। আমি সামনে ঘোরাঘুরি করলেও আমাকে যেন কেও চোখেই দেখে না। তৎক্ষনাৎ আপার উত্তর, আমি জানি সবাই আমাকে কত্তো ভালোবাসে। তাইতো আমি দূরে থাকতে পারিনা বেশিদিন।
এখন আমিও বড় হয়েছি, বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে। আপাও আগের থেকে এখন অনেক পরিনত হয়েছে। কিন্ত দুই বোনের রাগ, অভিমান, ভালোবাসার কোন পরিবর্তন হয়নি। ডিসেম্বরে আপা ঢাকায় এসেছিল। মাকে নিষেধ করেছিল আগেই আমাকে না জানাতে। কারন আপা আমাকে সারপ্রাইজ দিবে। আপা যখন বাসায় আসে আমি তখন বাজার করতে গিয়েছিলাম হাতিরপুলে। বাসায় এসে দরজায় নক করতেই আপা দরজা খুলে দিয়ে বলে আমাকে দেখে তুই অবাক হসনি। কিছুক্ষণ মুচকি হেঁসে আমি বললাম, হুম খুব অবাক হয়েছি। কিন্তু দুই বোন একসাথে সর্বোচ্চ দুই দিন খুব ভালো থাকি। তারপরই শুরু হয়, মান – অভিমান, ঝগড়া – ঝাটি তারপর মিটমাট।
আপা বরাবরই স্পষ্টভাষী। কোন অন্যায় দেখলে সহ্য করতে পারে না। তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমি উল্টো। একটু নীরব থাকি। যে অন্যায় করেছে তাকে উপলব্ধি করার সময় দিয়ে সংশোধনের সুযোগ দেয়। যার যেই বিষয়টি ভালো লাগে না, আপা তার মুখের উপরই বলে দেয়। এজন্য অনেকেই আপাকে ভুল বোঝে। কিন্তু আমি জানি আপার মনটা নরম। রাগ বা অভিমান করলেও সামনে গেলেই সব ভুলে যায়।
মানুষ দুই ধরনের সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। একটি রক্তের সম্পর্ক আর একটি আত্নার সম্পর্ক। রক্তের সম্পর্কগুলো যেন রক্তের সাথে রক্তের বন্ধন। আর আত্নার সম্পর্কগুলো যেন আত্নার সাথে আত্নার যোগাযোগ।
আমার মনে হয় রক্তের সম্পর্কগুলো হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে আত্নার সম্পর্ক। না বলা কথা তারা জানতে পারে। চোখের চাহনি দেখে মনের অব্যক্ত কথা তারা শুনতে পায়। জীবন, জীবিকা আর প্রয়োজনের তাগিদে রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলো আজ বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করে। কেও দেশের এ প্রান্তে, কেও দেশের অন্য প্রান্তে আবার কেও দেশের বাহিরে। দূরে থাকলেও এ বন্ধন অটুট, এ ভালোবাসা চিরন্তন।
Posted ১১:২০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৮ অক্টোবর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh