সেতারা কবির সেতু | বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০
বাংলাদেশের উত্তর -পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারী অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ নৃগোষ্ঠী সাঁওতাল। ২০১১ সালে ১৫ তম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩ এর (ক) নংঃ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। উত্তরে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় জেলাসমূহে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর বসবাস। দিনাজপুর জেলার ধানজুরি গ্রামে কিছু সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বসবাস করে। দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের ধানঝুড়ি মিশনের একটু পশ্চিম দিকে এই গ্রামটি অবস্থিত। সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর জীবন ব্যবস্হা সম্পর্কে জানার জন্য আমি কথা বলি ধানজুরি গ্রামের বাসিন্দা বার্নাড মারডির সাথে। বার্নাডের আদি গোষ্ঠী ছিল সাঁওতাল। পরবর্তীতে তারা খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। বার্নাড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকল্যাণ বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকুরির জন্য সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছে।
বার্নাড ও আমার আলোচনার উঠে আসা বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হলো :
সমাজ ব্যবস্থাঃ সাঁওতাল গ্রামের বিশেষ ৫ জনকে নিয়ে গঠিত হয় গ্রাম পঞ্চায়েত। তারা হলেন, মাঝি হাড়াম, পরাণিক,জগমাঝি, গোডেৎ এবং নায়েকে। মাঝি হাড়াম হচ্ছেন গ্রাম প্রধান। শুধু বিচার কাজ করেন না মাঝি হাড়াম। সেই সাথে গ্রামের সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু তিনি। তার সহায়ক হিসেবে বাকি পদগুলোর সৃষ্টি। স্হানীয় সমস্যাগুলো সমাধান করা হয় মূলত গ্রাম পঞ্চায়েতে।
গোত্র সংখ্যা : সাঁওতাল জনগোষ্ঠী মূলত ১২ টি গোত্রে বিভক্ত। গোত্রগুলো হলো – কিস্কু,হাঁসদা,মূর্মূ, হেমব্রম, মারণ্ডি, সোরেন, টুডু, বাস্কি, গুয়াসোরেন, বেসরা, পাউরিয়া এবং চোঁড়ে। পূর্বে বেশ কিছু উপগোত্রের কথা শোনা গেলেও বর্তমানে বাংলাদেশে এই ১২ টি গোত্রই রয়েছে। একই গোত্রের মধ্যে বিবাহ কখনই হয় না।
ধর্ম ও ভাষা : সাঁওতালদের নিজস্ব ধর্ম ও ভাষা রয়েছে। সাঁওতালদের ভাষায় দেবতাকে বলা হয় ” বোংগা”। এদের প্রধান দেবতা হচ্ছে ” সূর্য দেব “। সাঁওতালদের গৃহ দেবতার নাম ” আবগে বোংগা “। সাঁওতালদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ” সোহরাই “। এই উৎসবে মেয়েরা দলবদ্ধভাবে নাচে। এই উৎসব ৫ দিন পর্যন্ত হয়ে থাকে। এছাড়াও সাঁওতালদের মধ্যে অনেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীতে বিশ্বাসী হয়। সাঁওতাল জনগোষ্ঠী যখন নিজেদের সাথে কথা বলে তখন তার সাঁওতালি ভাষা ব্যবহার করে। তবে তারা সবাই প্রায় বাংলা ভাষা বলতে পারে এবং যারা শিক্ষিত তারা ইংরেজি ভাষাও বলতে পারে।
শিক্ষা : বর্তমানে সাঁওতালরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। বিদেশি বিভিন্ন মিশন আসে সাঁওতাল গ্রামগুলোতে কাজ করার জন্য। এই মিশনগুলো বাচ্চাদের লেখাপড়া শিখানোর জন্য বিভিন্ন স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। সাঁওতাল শিশুরা সাধারণত এই সকল স্কুলেই পড়ালেখা শুরু করে। তবে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো তারা তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেষ করায়। সাঁওতাল মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের শিক্ষার হার বেশি।
বিবাহ : সাঁওতাল জনগোষ্ঠীরা নিকট আত্নীয় স্বজনদের মধ্যে কখনোই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় না। তাদের বিয়ে হয় দুটি আলাদা গোত্রের মধ্যে। সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মধ্যেও যৌতুক প্রথা রয়েছে তবে তা খুবই নগন্য। তাদের ভাষায় যৌতুককে বলা হয় ” গনং”। যখন ছেলে পক্ষ মেয়েকে দেখতে যায় এবং উভয়ের পছন্দ হলে ছেলেপক্ষ মেয়েকে ১১ টাকা দেয়। আর বিয়ের সময় ১ টাকা দেয়। এই মোট ১২ টাকা ছেলে মেয়েকে যৌতুক হিসেবে দেয়। প্রাচীন কাল থেকে এখন পর্যন্ত বিয়ের এই রীতি চলে আসছে। বিয়ের সময় বর কনেকে সিঁদুর পরিয়ে দেয়।
পেশা : সাঁওতালদের প্রধান পেশা কৃষি। সাঁওতালদের নারী, পুরুষ সবাই মাঠে কাজ করে। নিজেদের জমিতে কাজ করার পাশাপাশি সাঁওতাল নারী, পুরুষ অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। সাঁওতাল নারীরা ধান রোপন করা থেকে শুরু করে ধান কাটা পর্যন্ত সবকাজই করে। এছাড়াও মাটি কাটার শ্রমিক, দিনমজুর হিসেবে তারা কাজ করে।
খাবার : সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মাছ, মাংশ,সবজি, ভাত প্রধান খাবার। তারা বনবিড়াল, বেজি, খাট্টাসের মাংশ খায়। আবার অনেকেই গরুর মাংস খায়। শুকর তাদের প্রধান খাবার। তাদের কোন অনুষ্ঠানে তারা শুকর জবাই করে। চুয়ানি এক ধরনের নেশার দ্রব্য। এটি তারা নিজেরাই তৈরি করে। এটি তাদের কাছে প্রিয়।
পোশাক ও ঘরবাড়ি :
সাঁওতাল মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হচ্ছে panci parhat. এটি দুটি অংশে বিভক্ত। কোমড় থেকে নিচে একটি অংশ আর কোমরের উপর থেকে গলা পর্যন্ত একটি অংশ। সাধারণত উৎসবে তারা এই পোশাক পরে। পুরুষদের পোশাকের নাম হচ্ছে গধৎশযরহ. অর্থাৎ ধুতি ও গেঞ্জি। তবে বর্তমানে নারীরা শাড়ি আর পুরুষরা শার্ট,প্যান্ট পরে।
সাঁওতালদের ঘরবাড়ি হয় খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। তাদের অধিকাংশের বাড়িই মাটির। গরুর গোবর ও ছাই দিয়ে তারা তাদের বাড়িঘর প্রলেপ দেয়। তাদের বাড়ির দেওয়ালে তারা নিজেরাই নকসা করে।
সাঁওতালদের জমি দখল :
সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর জমি স্থানীয় প্রভাবশালীরা জোড় করে পূর্ব থেকেই দখল করে আসছে। যা এখনো চলমান। মূলত অসচেতনতা এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হওয়ার কারনেই স্হানীয়রা তাদের জমি দখল করছে। তবে বর্তমানে অনেক সাঁওতাল জনগোষ্ঠী শিক্ষিত হওয়ার জন্য তারা তাদের নিজেদের জমি জমার বিষয়ে সচেতন হয়েছে। এরপরও তারা যখন স্হানীয় প্রভাবশালীদের সাথে লড়াই করতে পারে না তখন তারা একটি মীমাংসায় যায় এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও কম দামে প্রভাবশালীদের কাছে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
ধর্মান্তরিত হওয়া : ভালো ভাবে বেঁচে থাকার আশায় অনেক সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বর্তমানে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করছে। দিন, দিন তাদের ধর্মান্তরিত হওয়ার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তবে তাদেরকে ধর্মান্তরিত করতে কোন মিশনারী বাধ্য করে না বা জোর করে না। তারা উন্নত জীবনের আশায় স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়। আবার কারোও পূর্ব পুরুষরা যদি সাঁওতাল থেকে খ্রিষ্টান হয় সেই ক্ষেত্রে পরবর্তী প্রজন্মও খ্রিষ্টান হয়।
মৃত্যু : সাঁওতালদের কেও মারা গেলে এখন সাধারণত পোড়ানো হয় না। তাদেরকে কবর দেওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে তারা একটি প্রথা অনুসারে কবর দেয়। মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখার পূর্বে তারা একটি জীবন্ত মুরগির চোখে লোহা ঢুকিয়ে দিয়ে সেই মুরগিকে কবরে রাখে। তারপর মৃত ব্যক্তিকে কবরে শুয়ে দিয়ে মাটি দেয়। প্রাচীন কাল থেকে এখন পর্যন্ত তারা এই প্রথা অনুসরণ করে আসছে।
Posted ২:১৯ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh