মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ | ৫ চৈত্র ১৪৩০

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

সেই সব মানুষ দাও

ডা. এস এম শহীদুল্লাহ   |   বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০

সেই সব মানুষ দাও

একটি চীনা প্রবাদ দিয়ে শুরু করছি
“যদি এক বছরের জন্য পরিকল্পনা করতে চাও
তবে শস্য রোপন কর।
যদি ত্রিশ বছরের জন্য পরিকল্পনা করতে চাও
তবে বৃক্ষ রোপন কর।
যদি একশ বছরের পরিকল্পনা করতে চাও
তবে মানুষ রোপন কর।”

যাঁরা স্কুল প্রতিষ্ঠা করছেন তাঁরা এই প্রবাদ না জানলেও নিঃসন্দেহে তাঁরা প্রবাদ পুরুষ। তাঁদের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ সালাম। স্কুল প্রতিষ্ঠালগ্নের সামাজিক চিত্র আমার ধারণাতীত। তবে কবি শেখ সাদীর বাণী দিয়ে বর্তমান সামাজিক অবস্থার পূর্বাভাস তুলে ধরা যেতে পারে-“এমন একদিন আসবে যেদিন মুর্খরা উদ্ভট আদেশ জারি করে দেশ শাসন করবে। নির্বোধেরা তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য গর্ব অনুভব করবে। পন্ডিতেরা তাদের পান্ডিত্যের জন্য অনুশোচনা বোধ করবেন। দুর্নীতি পরায়ণরা তাদের দুর্নীতির জন্যে উল্লাসে নৃত্য করবে।”-এহেন পরিস্থিতিতে সততা আর মানবতা আজ প্রায় নির্বাসিত। মিথ্যার দাপটে সত্য উধাও। বিলাস আর ভোগবাদীতার মানবিক চেতনা লোপ পাচ্ছে ক্রমাগত। সৌন্দর্য চেতনা কেবল পোশাকী চাকচিক্যতায় মনন আর মানসিকতার চর্চা প্রায় নির্বাসিত। মানুষকে মাপা হচ্ছে অর্থের মানদন্ডে। সমাজে প্রকৃত খাঁটি ও ভাল মানুষের পথ চলা কন্টকাকীর্ণ। সত্য প্রিয় মানুষেরা প্রতিনিয়ত হোচট খাচ্ছে এবং মুখ থুবড়ে পরেছে; কিন্তু মুখ থুবড়ে পরলে তো চলবেনা। কারণ মনে রাখতে হবে,
সমাজ ধ্বংস হয় না অসৎ লোকের কর্মকান্ডে, সমাজ ধ্বংস হয় সৎ লোকের নিষ্ক্রিয়তায়।”


তাই সামাজিক দায়বদ্ধতা ও ঋণ পরিশোধ করার মানসে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারকে হয়ে উঠতে হবে বিদ্যালয়, সেখানেই তো শুরু হয় প্রথমের ও প্রথম শিক্ষা; আর সেই শিক্ষা শুরু করতে হবে একেবারে জীবনের প্রথম থেকে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “ছেলে মানুষ করতে হবে ছেলে বেলাতেই, না হলে ছেলে মানুষ হবে না, ছেলেই থেকে যাবে।” প্রাচীনকালে এই মহাদেশে গুরুগৃহে শিক্ষার প্রচলন ছিল। সেই শিক্ষা কেবল পাঠ্য বইয়ের শিক্ষা নয়, পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠার শিক্ষা। যেখানে আরুসি উদ্দালক গুরুর আদেশে ক্ষেতের ধারে নিজে শুয়ে পড়ে জলস্রোত থেকে শস্য রক্ষা করেছিলেন। সেইজন্যই কবি বলেছেন,
“পুথিগত বিদ্যা, পরহস্তে ধন
নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন।”

তাই আমাদেরকে মনে রাখতে হবে জর্জ হারবার্টের অমিয় বাণী -“One father is more than a hundred school master”-অর্থাৎ একজন পিতা/অভিভাবক শত স্কুল মাস্টারের চেয়েও বেশি। কতগুলো প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষায় ভালো করানো স্কুলের অঙ্গীকার হতে পারে না। এমনকি শিক্ষার্থীকে শেখানোও শিক্ষকের দায়িত্ব নয়। শিক্ষকের দায়িত্ব হলো, শিক্ষার্থীকে শেখানোর পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া। শিক্ষক জ্ঞানার্জনের নিয়মনীতি ও পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিবেন। তাই শিক্ষকগণকে আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের একটি আবেদনময়ী চিঠির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।


মাননীয় মহাশয়,
আমার পুত্রকে জ্ঞানার্জনের জন্য আপনার কাছে পাঠালাম। তাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন, এটাই আমার বিশেষ দাবী। আমার পুত্রকে অবশ্যই শিখাবেন-সব মানুষই সত্যনিষ্ঠ নয়। তাকে এও শিখাবেন কিভাবে পরাজয়কে মেনে নিতে হয় এবং কিভাবে বিজয়োল্লাস উপভোগ করতে হয়। হিংসা থেকে দূরে থাকার শিক্ষাও তাকে দিবেন। যদি পারেন নীরব হাসির গোপন সৌন্দর্য তাকে শিখাবেন। সে যেন আগেভাগেই এ কথা বুঝতে শিখে যারা পীড়নকারী তাদেরকেই সহজে কাবু করা যায়। বইয়ের মাঝে কি রহস্য লুকিয়ে আছে তাও তাকে বুঝতে শিখাবেন। আমার পুত্রকে শিখাবেন, বিদ্যালয়ে নকল করার চেয়ে অকৃতকার্য হওয়া বেশি সম্মানজনক। নিজের উপর তার যেন সুমহান আস্থা থাকে, এমনকি সবাই যদি সেটাকে ভুলও মনে করে। তাকে শিখাবেন ভদ্র লোকের প্রতি ভদ্র আচরণ করতে আর কঠোরদেও প্রতি কঠোর হতে।

আমার পুত্র যেন এ শক্তি পায় হুজুগে মাতাল জনতার পদাঙ্ক অনুসরণ না করার। সে যেন সবার কথা শোনে এবং তা সত্যের পর্দায় ছেঁকে শুধু ভালটাই গ্রহণ করে এ শিক্ষাও তাকে দিবেন। সে যেন শিখে দুঃখের মাঝে কিভাবে হাসতে হয়। আবার কান্নার মাঝে লজ্জা নেই একথাও তাকে বুঝতে শিখাবেন। যারা নির্দয়, নির্মম তাদের যেন ঘৃণা করতে শিখে আর অতিরিক্ত আরাম আয়েশ থেকে সাবধান থাকে। আমার পুত্রের প্রতি সদয় আচরন করবেন, কিন্তু সোহাগ করবেন না। কেননা আগুনে পুড়েই ইস্পাত খাঁটি হয়। আমার সন্তানের যেন অধৈর্য হওয়ার সাহস না থাকে, থাকে যেন তার সাহসী হওয়ার ধৈর্য্য। তাকে এ শিক্ষাও দিবেন-নিজের প্রতি তার যেন সুমহান আস্থা থাকে; আর তখনই তার সুমহান আস্থা থাকবে মানব জাতির প্রতি। ইতি আপনার বিশ্বস্থ আব্রাহাম লিংকন।


একজন শিক্ষকের মধ্যে নানান গুনের সমাহার থাকতে হয়, না হলে ভালো শিক্ষক হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। আদর্শ, মূল্যবোধ, ভালো মাপের পড়াশোনা, উদারতা, মমতা, বড় দৃষ্টিভঙ্গি, এসব গুণ এর মধ্যে পরে। কিন্তু যে গুণটি না থাকলে তিনি শিক্ষক নামের যোগ্যই হয়ে ওঠেন না, তা হল সুন্দর এ নান্দনিক কথা বলার স্বত:স্ফূর্ত সপারগতা। চমৎকার কথার মুগ্ধ মোহাবেশ রচনা করে সামনে-বসা ছাত্রদের প্রজ্বলিত করতে হয় তাঁকে। পড়ানোর বিষয়গুলোকে সাবলীল প্রাঞ্জল ও জীবন শোভন ভাবে ছাত্রদের রক্তে সঞ্চারিত করতে হয়। প্রতিটি শিক্ষকই শেষ বিচারে একজন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, যিনি কথার ইন্দ্রজাল দিয়ে ছাত্রদের হৃদয়কে তাঁর পিছনে নৃত্যগীতমুখর আনন্দে টেনে দিয়ে যেতে পারেন। আমি মনে করি, একজন শিক্ষকের জীবনে কথার ভূমিকা তাঁর জানার ভূমিকার চাইতে বড় এবং ছাত্রদের জীবনের দিক নির্দেশক হিসেবে তাঁর ভূমিকার চেয়ে কম নয়। এটা স্কুল-কলেজ পর্যায়ে কেবল নয়, বিশ্ববিদ্যালয় সমন্ধেও কম বেশি সত্য। শিক্ষক জ্ঞানের ভিক্ষা দাতা নন, তিনি জ্ঞানের জগতে আসতে চাওয়া ছাত্রদের আহ্বানকারী, নাকিব। উজ্জ্বল, অসাধারণ শব্দের অমিত শক্তি ছাড়া কি দিয়ে তিনি সেই জগতে ছাত্রদের ডাক দিবেন? তাদের হৃদয়কে উদ্বুদ্ধ করবেন? ধরা যাক একজন শিক্ষকের কথা -যিনি জানেন অনেক। নিজের বিষয় সমন্ধে জ্ঞান তাঁর গভীর। কিন্তু তাঁর বিষয়কে , ঐ বিষয়ের বৈভব ও মহিমাকে তিনি ছাত্রদের চোখের সামনে অনিন্দ্যভাবে তুলে ধরতে পারেন না। ফলে তাঁর বক্তৃতা ছাত্রদের কাছে বিরস মনে হয়, শুনলে বিরক্তি আর একঘেয়েমিতে তাদের মাথা ধরে ওঠে। এমন শিক্ষক কি ছাত্রদের মনোজগতে কোনো সুদূর প্রসারী স্বপ্ন জাগাতে বা প্রভাব ফেলতে পারেন? অন্যদিকে একজন শিক্ষক যদি বিষয় জ্ঞানের গভীরতায় তাঁর চেয়ে অপ্রতুলও হন কিন্তু তার থাকে বাচনিক প্রতিভার দুর্লভ শক্তি-অনবদ্য, চমকপ্রদ, মনোরঞ্জনকারী কথার সপারগতা, যদি ছাত্রের স্বপ্নকে প্রজ্জ্বলিত করতে পারেন-তবে এদের দু’জনের মধ্যে কাকে শিক্ষক হিসেবে ভালো বলব আমরা? দ্বিতীয়জনকে নয় কি? এই জন্য আমার ধারণা শিক্ষক হিসেবে যোগ্যতা-বিচারের সময় তাদের জ্ঞান বা শিক্ষাগত যোগ্যতার আগে তাদের সুন্দর বাচন ভঙ্গি, উপস্থাপনার চমৎকারিত্ব এবং হৃদয় জয় করার ক্ষমতার ওপর জোর দেওয়া উচিত।
দয়া করে ছাত্রছাত্রীদেরকে পরীক্ষার্থী বানাবেন না, শিক্ষার্থী বানাবেন। পরিশেষে গিলবার্ট এর ডায়রীর পাতায় লিখে রাখা তার অন্তর্নিহিত চাওয়া প্রার্থনা গাঁথা দিয়ে শেষ করতে চাই-
“প্রভু আমাদের মানুষ দাও
এসময় দাবী করে শক্তিশালী মন, মহান হৃদয়,
সত্যিকার বিশ্বাস এবং প্রকৃত হাত।
সেইসব মানুষ দাও, যাদেও হত্যা করতে পারে না গভীর লোভ।
সেইসব মানুষ দাও
যাদের সম্মানবোধ আছে।
সেইসব মানুষ দাও
যারা মিথ্যা বলবে না।
ন্যায় বিচার দেশকে শাসন করুক
এবং সৎ সাহস আমাদের প্রয়োজন পূরণ করুক।”

লেখক : এস, এম শহীদুল্লাহ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও মেডিকেল এডভাইজার, আলোক হেলথ কেয়ার লিমিটেড, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল ও মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।

advertisement

Posted ১০:৫২ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

গল্প : দুই বোন
গল্প : দুই বোন

(6091 বার পঠিত)

স্মরণে যাতনা
স্মরণে যাতনা

(1286 বার পঠিত)

মানব পাচার কেন
মানব পাচার কেন

(1142 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.