বিবিসি বাংলা : | সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আবারো ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে এবং এ নিয়ে চলতি মাসেই মোট তিনটি ভূমিকম্প অনুভূত হলো বাংলাদেশে। ঢাকায় আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ২ এবং এর উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইলের একটি এলাকায়। যদিও উৎপত্তিস্থল নিয়ে বিভ্রান্তিও রয়েছে। কারণ মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস বলছে এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর ঘোড়াশাল এলাকায়। ভারতের আবহাওয়া দফতরের তথ্যও বলছে, এর উৎপত্তিস্থল টাঙ্গাইল। কিন্তু দুটোর যেখানেই হোক-উভয় স্থানই রাজধানী ঢাকার কাছে। ভূমিকম্প বিষয়ক গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ভূমিকম্পের সম্ভাব্য দুটি উৎসই ঢাকার দেড়শ কিলোমিটারের মধ্যে এবং এ ছাড়া ঢাকার পাশ্ববর্তী কয়েকটি এলাকায় ভূমিকম্পের ইতিহাসও আছে। বিশেষ করে সিলেট এবং চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, এসব এলাকায় বড় ধরণের ভূমিকম্প হলে সেটাই হবে ঢাকার জন্য বড় বিপর্যয়ের কারণ হবে বলে তিনি মনে করেন।
ঢাকার কাছে ভূমিকম্প নতুন নয় : বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে মাঝে মধ্যেই যেসব ভূকম্পনগুলো অনুভূত হয়, যার উৎস সাধারণভাবে বাংলাদেশের বাইরে এবং এই শহর থেকে ২০০/৩০০ কিলোমিটার দূরে। অনেকগুলো ভূমিকম্পের মূল কেন্দ্র ছিল পূর্ব দিকে মিয়ানমার অথবা ভারতের মিজোরাম, মনিপুর এবং উত্তরে আসাম, নেপাল কিম্বা ভুটানে। কিন্তু এর মধ্যেই অনেক ছোট-বড় ভূমিকম্প হয়েছে যার উৎসস্থল ছিল ঢাকার কাছাকাছি এলাকাগুলোতেই। অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, যে গত ১৫ কিংবা ২০ বছরের মধ্যে এমন কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে যেগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার আশেপাশের কয়েকটি জেলা, যার মধ্যে আছে নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ এলাকা। এর মধ্যে শক্তিশালী ভূমিকম্প হিসেবে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জে ৫.১ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের কথাই বলে থাকেন গবেষকরা।
এছাড়া ফরিদপুর থেকেই গত দেড় দশকের মধ্যে অন্তত দু’বার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। তিন বছর আগে, ২০২০ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের ১২ কিলোমিটার পূর্বে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এছাড়া ২০০৮ সালে টাঙ্গাইলের নাগরপুরে এবং ২০১৯ সালে মির্জাপুরে চার মাত্রার নিচে ভূমিকম্প হয়েছে বলে বলছে আর্থকোয়েকট্র্যাক। এছাড়া চলতি বছরের মে মাসেই ৪ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার দোহার থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে। এই ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ভূপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি থাকায় তখনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন গবেষকরা। ওই একই স্থান হতে ২০১২ সালের ১৮ই মার্চ ৪.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। আখতার বলছেন টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্ট ভূমিকম্পের একটি উৎস। ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল বিশেষ করেন টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ের লালমাটি থেকে যমুনার পললভূমি, যেটা ঢাকার কাছে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত, এই পুরো ৭০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই ফল্ট। আর সম্প্রতি গত মাসেই আরো যে দুটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল যেগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট অঞ্চলের সীমান্ত এলাকায়।
কতটা ঝুঁকি কোথায়, ঢাকার কত কাছে : বিশেষজ্ঞদের মতে পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ট আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি হয়েছে, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। সারা পৃথিবীতে এরকম বড় সাতটি প্লেট এবং অসংখ্য ছোট ছোট সাব-প্লেট রয়েছে। এগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে বা একটি অন্যদিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন ভূ-তত্ত্বের মাঝে ইলাস্টিক এনার্জি শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে। সেটা যখন শিলার ধারণ ক্ষমতার পেরিয়ে যায়, তখন সেই শক্তি কোনো বিদ্যমান বা নতুন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন ভূ-পৃষ্টে কম্পন তৈরি হয়, সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্প। যেসব স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ একটি গবেষণা করেছিল এবং সে গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত অঞ্চল, যেখানে দুটো প্লেটের সংযোগস্থল। এখানে একটি প্লেট আরেকটার নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। সেটি হলো ইন্ডিয়া প্লেট বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ থেকে কিশোরগঞ্জের হাওড় হয়ে মেঘনা নদী হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর বরাবর ওই প্লেটটি তলিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘গবেষণা বলছে এই সাবডাকশান জোনই হলো ভূমিকম্পের উৎস স্থল। আমাদের গবেষণা দেখা গেছে এই সাবডাকশান জোনে যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চয় হয়ে আছে তার মাত্রা ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রা পর্যন্ত। সাধারণত বড় ধরণের ভূমিকম্পগুলো এমন জোনেই হয়। যেটা চিলি, আলাস্কা বা জাপানেও দেখা যায়।’
বাংলাদেশ অঞ্চলে ভূমিকম্পের আরেকটি উৎস হলো ডাউকি ফল্ট, যেটি শেরপুর থেকে শুরু জাফলং হয়ে ভারতের করিমগঞ্জ থেকে বিস্তৃত। বিশেষ করে এর পশ্চিমাংশ আরেকটা ভূমিকম্পের উৎস। আখতার বলেন, আর বাংলাদেশকে ঘিরে ভূমিকম্পের এ দুটি উৎস কাছাকাছি হলেও সাবডাকশান জোনটিই হলো ভয়ংকর। ‘এগুলো ঢাকা থেকে ৭০-১৫০ কিলোমিটার দূরে। যে কারণে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সেটাতেই ঢাকার অবস্থা খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে,’ বলছিলেন সৈয়দ হুমায়ুন আখতার। এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি এবং এখানকার ভবনগুলোর প্রযুক্তিগত দুর্বলতা অনেক বেশি। ‘কারণ শহর গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত উপায়ে এবং সরকারের প্রস্তুতি ও জনসচেতনতার অভাব প্রকট। অর্থাৎ ঝুঁকির তীব্রতা বাড়াতে যা যা দরকার সবই ঢাকায় বিদ্যমান। এ কারণেই মনে হচ্ছে ভূমিকম্পগুলো ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছে।’
সূত্র : বিবিসি বাংলা
Posted ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh