বাংলাদেশ অনলাইন : | শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪
২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমি প্রতিমন্ত্রী থেকে পূর্ণমন্ত্রী থাকার ৯ বছরে সাইফুজ্জামান চৌধুরী অবৈধভাবে অর্জিত টাকা বিদেশে পাচার করে স্বনামে ও তার স্ত্রী রুকমীলা জামানের নামে যুক্তরাজ্যসহ তিনটি দেশে ৫৮০টি বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্টের মালিক বনেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অপরাধলব্ধ টাকা বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে দেশ থেকে পাচার করেছেন। লেয়ারিংয়ের আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন দেশে সম্পদ কেনার মাধ্যমে ইন্টিগ্রেশন সম্পন্ন করেছেন তিনি। সাইফুজ্জামানের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠলে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির একজন উপপরিচালক, একজন সহকারী ও উপসহকারী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা নিয়ে ৩ সদস্য বিশিষ্ট অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়।
অনুসন্ধানকারী টিমের বিশ্বস্ত সূত্র ও প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্য মতে, সাইফুজ্জামান ও তার স্ত্রী রকমীলার যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও আরব আমিরাতে ৫৮০টি বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট ও সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া যায়। দেশগুলোর ল্যান্ড রেজিস্ট্রিতে এসবের সত্যতা মিলেছে। সম্প্রতি সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রী রুকমীলা জামানের মালিকানাধীন স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তিসমূহ ক্রোক বা অবরুদ্ধকরণের লক্ষ্যে আবেদন করেন অনুসন্ধান টিমের প্রধান দুদকের উপপরিচালক রাম প্রসাদ মন্ডল। আবেদনটির ওপর আদালতে শুনানি করেন দুদকের প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর। এরপর ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ আস সামছ জগলুল হোসেনের আদালত দুদকের আবেদনটি মঞ্জুর করে সাবেক এই মন্ত্রীর সম্পত্তি ক্রোক ও ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ/অবরুদ্ধের আদেশ দেন।
সাইফুজ্জামান ও তার স্ত্রী রুকমীলার নামে যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি এবং যুক্তরাষ্ট্রে-৯টিসহ অন্যান্য দেশেও বাড়ী/অ্যাপার্টমেন্ট/জমিসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদ রয়েছে। আবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী এর বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করা হয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্রমতে, প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করে তার নিজ এবং তার স্ত্রী রুকমীলা জামানের নামে যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি যুক্তরাষ্ট্রে ৯টিসহ অন্যান্য দেশেও বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/জমিসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট দেশের ল্যান্ড রেজিস্ট্রি ও প্রাপ্ত অন্যান্য তথ্যাদি/রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়। প্রাপ্ত রেকর্ডপত্রে দেখা যায় এই সম্পদসমূহ তার নিজ ও পরিবারের নামে ২০১৫ হতে ২০২৪ সালের মধ্যে কিনেছেন। এই সময়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
এর আগে, তিনি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান/পরিচালক ছিলেন। তার স্ত্রী রুকমীলা জামান গত ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান ছিলেন। এই ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। বাংলাদেশে তার ও তার পরিবারের সদস্যদের নামীয় আয়কর নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিদেশি এসব সম্পদ অর্জনের বিষয়টি বাংলাদেশের আয়কর নথিতে উল্লেখ করেননি। তিনি বাংলাদেশের আইন মোতাবেক বিদেশে সম্পদ অর্জনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ হতে অর্থ প্রেরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করেননি বলে জানা যায়। এছাড়া, সাইফুজ্জামান চৌধুরী তার নির্বাচনী হলফনামায় বিদেশে সম্পদ অর্জনের তথ্য প্রদান করেননি।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী সরকারের প্রতিমন্ত্রী/মন্ত্রী থাকাকালে ও ইউসিবি ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান/পরিচালক এবং তার স্ত্রী রুকমীলা জামানের চেয়ারম্যান হিসাবে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অপরাধলব্ধ অর্থ অর্জন করে তা স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রুপান্তর করে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহারপূর্বক বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে লেয়ারিংয়ের আশ্রয়ে যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণিত সম্পদ ক্রয়ের মাধ্যমে ইন্টিগ্রেশন সম্পন্ন করেন। অনুরূপভাবে তিনি ও তার স্ত্রী রুকমীলা জামান সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ব্যাংকে ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাব খুলে হিসাবসমূহের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ লেনদেন করেছেন।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রীর নামীয় বর্ণিত পাচারকৃত সম্পদসমূহ দেশে ফেরত আনার উদ্দেশ্যে অবিলম্বে ক্রোক/অবরুদ্ধ করা অত্যাবশ্যক। এই দুইজনের পরিবার/নির্ভরশীল ব্যক্তিদের নামে অন্য কোন স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ পাওয়া গেলে তা আইনের আওতায় আনা হবে।
দুদকের আবেদনটিতে সাইফুজ্জামানের মালিকানাধীন স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তিগুলো ক্রোক বা অবরুদ্ধকরণের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে আদেশ প্রদানের কথা বলা হয়। এক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের স্থাবর সম্পদের ক্ষেত্রে দেশটির এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ল্যান্ড ডিপার্টমেন্ট, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট রেজিস্টার, নিউ ইয়র্ক ও ফ্লোরিডাকে প্রয়োজনীয় আদেশ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবের ক্ষেত্রে দুবাই ইসলামিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, জনতা ব্যাংক পিএলসি ব্যাংলাদেশের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, টিডি ব্যাংক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ারম্যান বা অন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদানের কথা বলা হয়। এছাড়া একইদিন সংস্থাটির আরেকটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত চট্টগ্রামে থাকা তাদের দুটি অ্যাপার্টমেন্ট ক্রোকের আদেশ দেন।
গত ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে, যার প্রতিফলন হলফনামায় নেই। মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনও বিদেশে সক্রিয়ভাবে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছে। যে সকল কোম্পানির মোট সম্পদ মূল্য প্রায় ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।”
সরকার জানতে চাইলে তার নাম এবং এ বিষয়ে সব তথ্য ও তথ্যসূত্র দেওয়া হবে বলে জানালেও পরে ইফতেখারুজ্জামান বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে সেই ‘মন্ত্রীর’ নাম জানান। তিনি হলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান। পরে বিষয়টি স্বীকারও করেছেন সাইফুজ্জামান।
এ ছাড়া, ২০১৩ সালে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্থাবর সম্পত্তি ছিল দুই কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এখন তার নামে সম্পত্তি আছে ১০ কোটি ৯ লাখ টাকার। ১০ বছরে স্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে ৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এই সময়ে তার স্ত্রীর অস্থাবর সম্পত্তিও বেড়েছে ১২ গুণের বেশি। সাইফুজ্জামান চৌধুরী চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনের সংসদ সদস্য। একই আসন থেকে এবারও আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) গুলশানে ইউসিবি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে ব্যাংকের দেড় শতাধিক শেয়ারধারী। ওই সময় তারা বিভিন্ন ফেস্টুন প্রদর্শন করে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ‘বিদেশে অর্থ পাচার’ এবং ব্যাংকটির নানা অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করেন।
ইউসিবির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বাবা চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী। শুরু থেকে ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এম এ হাসেম। তারা বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত উভয় পরিবারের সদস্যরাই ব্যাংকটিতে যুক্ত ছিলেন ও নেতৃত্ব দেন।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে পারটেক্স গ্রুপের সদস্যদের ইউসিবি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। ব্যাংকটির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেন সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুকমিলা জামান। তবে রুখমিলা জামান যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় ব্যাংকটি মূলত সাইফুজ্জামান চৌধুরী পরিচালনা করেন, এমনটাই জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। তাদের অভিযোগ, ২০১৭ সাল থেকে ব্যাংকটিকে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ‘অবাধ লুটপাট, আর্থিক দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচার’ করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০১৭ সালে ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল এক হাজার ৭৯২ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সাল শেষে বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।
তথ্যসূত্র : ঢাকা পোস্ট
Posted ১২:০০ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh