বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ০৫ নভেম্বর ২০২০
বীর মুক্তিযোদ্ধা, অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র, বিএনপির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল গত ৪ নভেম্বর, বুধবার । তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিএনপি দেশে বিশেষ কর্মসূচি পালন করেছে। এদিকে সাদেক হোসেন খোকা স্মৃতি সংসদ, নিউইয়র্ক, গত বুধবার আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।
সাদেক হোসেন খোকার দোয়া মাহফিলে কান্নার রোল : ঢাকার সাবেক মেয়র ও বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তার রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া মাহাফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৪ নভেম্বর (বুধবার) বিকেলে রাজধানীর ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব মাঠে এই মিলাদের আয়োজন করা হয়েছিল। এতে পরলোকগত নেতার জন্য খতমে কোরআন ও মোনাজাতের মাধ্যমে দোয়া প্রার্থনা করা হয়। সাদেক হোসেন খোকার বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন তার বাবা জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। মৃত্যুর বছর পেরিয়ে গেলেও যে মেয়র খোকার জনপ্রিয়তা কমেনি তার প্রমান মেলে মোনাজাতে। ব্রাদার্স ক্লাব মাঠে যেন কান্নার রোল পড়ে যায়। কিছুক্ষণের জন্য ভারি হয়ে যায় ব্রাদার্সের আশপাশ। মিলাদে মরহুম সাদেকে হোসেন খোকার আত্মীয় স্বজন, রাজনৈতিক সহকর্মীসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তার ভক্ত-অনুরাগীরা এসে অংশ নেন।এর আগে বেলা ১১ টায় তার কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও কবর জিয়ারত করেছেন তার পরিবার, আত্মীয় স্বজন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।২০১৯ সালের ৪ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা কমান্ডার থেকে জননেতা হয়ে সাধারণ মানুষের প্রিয় খোকা ভাই।
জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। ছিনিয়ে এনেছেন যিনি জয়। সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা হেরে যান মরণ ব্যাধি ক্যান্সারের কাছে। গত বছর ৪ নভেম্বর প্রত্যুষ ২টা ৫০ মিনিটে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন সাদেক হোসেন খোকা। এর আগে ১৮ অক্টোবর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে মেমোরিয়াল স্নোয়ান হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২০১৪ এর মে মাস থেকে ২০১৯ এর নভেম্বর। টানা পাঁচ বছর ধরে চলছিল তাঁর ক্যান্সার চিকিৎসা। এ সময়ে অনেকবার তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। আবার হয়ে উঠেছেন সুস্থ। এভাবেই চলছিল। বিশ্বখ্যাত ক্যান্সার হাসপাতাল ম্যাহাটানের মেমোরিয়াল স্নোয়ান ক্যাটারিং সেন্টার থেকেই বরাবর চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। চিকিৎসকরাও চেষ্টা করেছেন প্রাণপণ। কিন্তু শেষ চেষ্টাতেও বাঁচানো যায়নি তাকে। কিডনি থেকে তার দেহে ক্যান্সারের সূত্রপাত। আমেরিকা আসার কয়েক বছর আগে সিঙ্গাপুরে তার একটি কিডনি অপসারণ করা হয়। অপর কিডনি ছাড়াও দেহের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ক্যান্সার। তার ফুসফুসে ক্যান্সারের বিস্তৃতির বিষয়টি সনাক্ত হলে তার মৃত্যুর এক সপ্তাহ পূর্বে ফুসফুসে সার্জারি করা হয়। এরপর থেকে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে অতিদ্রুত। শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট বেড়ে যায়। এ কষ্ট তিনি আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুর খবর নিউইয়র্কে শোকের ছায়া নেমে আসে । তার প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রকাশ মূর্ত হয়ে উঠে কয়েক ঘন্টার নোটিশে তার নামাজে জানাজায়। নিউইয়র্কে কোন বাংলাদেশীর জানাজায় এতো লোক সমাগম আগে আর কখনো হয়নি। স্মরণকালের সর্ববৃহৎ এ জানাজা প্রবাসী বাংলাদেশীদের মনে দাগ কেটেছে, যা জাগরুক থাকবে দীর্ঘ দিন। তার অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী দেশের মাটিতে বাবা-মার কবরের পাশে দাফন করা হয় মহান এ নেতাকে।
অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার নামাজে জানাজা ৪ নভেম্বর এশা’র পর জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে (জেএমসি) অনুষ্ঠিত হয়। দলমত নির্বিশেষে পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ জানাজায় অংশ নেন।জানাজা শেষে মরহুম সাদেক হোসেন খোকার মুখ শেষবারের মতো দেখার জন্য উপস্থিত প্রবাসীরা ভিড় করেন। ৫ নভেম্বর সাদেক হোসেন খোকার মরদেহ বাংলাদেশে পাঠানো হয়ে।
এক নজরে খোকা : সাদেক হোসেন খোকা ১৯৫২ সালের ১২ মে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৯১ সালে তিনি সূত্রাপুর-কোতোয়ালি আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং তিনি তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পরে তিনি ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে ২৫ এপ্রিল তিনি ঢাকার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১১ সালের ২৯ নবেম্বর পর্যন্ত টানা নয় বছরের বেশি সময় মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন অবিভক্ত ঢাকার শেষ নির্বাচিত মেয়র। বিদেশে থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালে তার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি আর পাসপোর্ট পাননি। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খোকা দেশে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করে গিয়েছিলেন বলে বিএনপি নেতারা জানান। সাদেক হোসেন খোকা ২০১৪ সালের ১৪ মে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান । সম্প্রতি তার শারীরিক অবস্থার অনেক অবনতি ঘটে। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে ও ২ ছেলে রেখে গেছেন। মুক্তিযোদ্ধা খোকা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ থেকে বিএনপিতে এসেছিলেন শুরুতেই। ব্রাদার্স ইউনিয়নের সূত্রে বিএনপির ঢাকা মহানগরের সাবেক সভাপতি খোকার ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও পরিচিত রয়েছে।
গেরিলা থেকে জননেতা : ছিলেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের দুর্ধষ গেরিলা। স্বাধীন বাংলাদেশে হলেন রাজনৈতিক নেতা। রাজপথ থেকে ফুটপাত সর্বত্রই ছিল তার পদচারণা। মিছিলে, সংগ্রামে ছিল তার সমান বিচরণ। তাকে অনুসরণ করে হাজারো কর্মী ঝড় তুলত রাজপথে। আন্দোলনের পাশাপাশি সরকার পরিচালনা কিংবা জাতীয় সংসদেও ছিল তার সমান বিচরণ। নিজ দলের পাশাপাশি বিরোধী শিবিরেও ছিল তার সমান জনপ্রিয়তা। এ কারণে রাজনীতিতে ভিন্নমত থাকলেও বাঙালি এবং জাতীয় ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে। তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলীর মতো জাতীয় নেতাদের নামে রাজধানীর সড়কের নামকরণ করেছিলেন তিনি। এ কাজে নিজ দলের বিরোধিতাও পাত্তা দেননি।
ভোটের মাঠে তাকে মোকাবেলা করা ছিল কঠিন থেকে কঠিনতর। জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে তার উদাহরণ ছিল বিরল। আর এ কারণেই একাধিকবার ঢাকা থেকে সাংসদ এবং অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। ছিলেন সরকারের মন্ত্রীও। রাজনীতির অঙ্গনের এই দাপুটে পুরুষ সাদেক হোসেন খোকা। আর তিনি জনতার অধিকার নিয়ে কথা বলবেন না। গরম করবেন না রাজনীতির মাঠ। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ¡বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় পরিবারের অন্য কাউকে না জানিয়েই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। মেলাঘরের ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষে ঢাকায় অপারেশনের ফাঁকে গোপনে একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি। ১৯৭১-এর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন নেতা রুহুল আমীন এবং গোপীবাগের মাসুদসহ বেশ কয়েকজন মিলে প্রথমে তারা যান নরসিংদীর শিবপুরে। ওখানে কয়েক দিন অবস্থানের পর যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে আগরতলার পৌঁছলে তাদের রিসিভ করেন শহীদুল্লাহ খান বাদল। সেখান থেকে প্রথমে বটতলার সিপিএম অফিসে গিয়ে মেননের সঙ্গে দেখা করে চলে যান দুই নম্বর সেক্টরে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছিলেন সেই সেক্টরের কমান্ডার। পরবর্তীতে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। দুই নম্বর সেক্টরের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের নাম ছিল ‘মেলাঘর’।
প্রশিক্ষণ শেষে একটি গেরিলা গ্রুপের কমান্ডার হিসেবে ঢাকায় আসেন সাদেক হোসেন খোকা। ঢাকা বিমানবাহিনীর রিক্রুটিং অফিস, বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়িসহ বেশ কয়েকটা সফল অপারেশনের নেতৃত্ব দেন তিনি। যুদ্ধের ৯ মাসই প্রতিদিন একাধিক সফল অপারেশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে বামপন্থি রাজনীতি ছেড়ে আশির দশকে জিয়াউর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিএনপির রাজনীতি শুরু করেন খোকা। সামরিক স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীর রাজপথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন খোকা। গেরিলা যোদ্ধা থেকে সফল জননেতায় পরিণত হন তিনি।
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার চেষ্টা হলেও তা প্রতিরোধ করে ঢাকাবাসীর আস্তা অর্জন করেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-৭ আসনে শেখ হাসিনাকে পরাজিত করে তিনি সবাইকে চমকে দেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ঢাকার আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতে বিএনপি প্রার্থী পরাজিত হলেও একমাত্র তিনিই নির্বাচিত হন।
২০০১ সালের নির্বাচনে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রীর দায়িত্ব পান সাদেক হোসেন খোকা। ওই সময় পুরান ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিতে নিজস্ব বলয় তৈরির পাশাপাশি প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডে দলকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।২০০২ সালের ২৫ এপ্রিলের নির্বাচনে তিনি অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। পাশাপাশি খোকাকে সভাপতি ও আবদুস সালামকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাকা মহানগরের মেয়র ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালের ১৪ মে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যান তিনি। এরপর থেকে সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। গতকাল চিরতরে নিভে যায় তার জীবন প্রদীপ।তার মরদেহ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলে তার কফিন গ্রহণ করবেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। এরপর বেলা ১১টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।এরপর জুরাইন কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় ।
Posted ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৫ নভেম্বর ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh