মোহাম্মদ আজাদ : | বৃহস্পতিবার, ০৮ এপ্রিল ২০২১
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ৬ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী মৃতের সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে তিন মাসেই মৃত্যু হয়েছে ১০ লাখ মানুষের। এর আগে এক বছরে অর্থ্যাৎ ১২ মাসে মারা গেছে ২০ লাখ মানুষ। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে পোনে ৬ লাখ মানুষের, যা বিশ্বে করোনায় মৃতদের ১৯ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী প্রতিদিনই বাড়ছে করোনার সংক্রমণ, বাড়ছে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যাও। নতুন ভ্যারিয়েন্টে ঝুঁকি বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। চলছে ভ্যাকসিন কার্যক্রমও। করোনায় সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ব্রাজিল ও ভারত। যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া করোনার নতুন ধরন এ ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। লকডাউন ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি না মানায় পরিস্থিতি বেশি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। রয়টার্সের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, করোনায় মৃতের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ব্রাজিল। প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে প্রতি চারটি মৃত্যুর মধ্যে একটি হচ্ছে এই দেশে। ব্রাজিলের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও)। দেশটির স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশারও সমালোচনা করেছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন গত মঙ্গলবার মেরিল্যান্ডের এক ভ্যাকসিন কেন্দ্র পরিদর্শনকালে আগামী ১৯ এপ্রিলের মধ্যে সকল প্রাপ্ত বয়স্কদের ভ্যাকসিন দেয়া সম্পন্ন করা নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি তার শততম কর্মদিবসের মধ্যে ২০ কোটি আমেরিকানের ভ্যাকসন গ্রহণ হয়েছে দেখতে চান। আগামী ৩০ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার ১০০ দিন পূর্ণ হবে। ফেডারেল সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বিভিন্ন এজেন্সিকে ২০৯.৯ মিলিযন ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হয়েছে।
গত সোমবার পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ১৯ শতাংশ লোককে দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেয়ার কাজ শেষ হয়েছে। সিডিসি বলেছে যে যুক্তরাষ্ট্রে এখন প্রতিদিন গড়ে ৬৪ হাজার লোক নতুন করে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। গত দুই সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে ১৮ শতাংশ। মৃত্যু হার কমলেও এখ নপর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ৮ শ’ লোক মারা যাচ্ছে। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) জানিয়েছে, সপ্তাহান্তে ২৪ ঘণ্টায় ৪০ লাখের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে, যা রেকর্ড। সিডিসির তথ্য থেকে জানা যায়, এখন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে প্রতিদিন ৩০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ পুরোপুরি টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। সম্প্রতি দেশে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধিকে উদ্বেগজনক হিসেবে দেখা হচ্ছে। সংক্রামণব্যাধি ও মহামারি বিশেষজ্ঞ সিএনএনকে বলেন, ‘আমি মনে করি, সামনে আমাদের আরও কয়েকটি খারাপ সপ্তাহ আসছে। গত বছরের মহামারির প্রবণতা থেকে বলা যায়, ইউরোপে মহামারি শুরুর তিন থেকে চার সপ্তাহ পর যুক্তরাষ্ট্রে এর ঢেউ লাগে।’
দ্রুততার সঙ্গে কোভিড ১৯ ভ্যাকসিন দেয়া সম্পন্ন করার জন্য নিউইয়র্ক সিটিতে একটি ভ্রাম্যমান ভ্যাকসিন সেবা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। গতকাল বুধবার থেকে ব্রুকলিনের সানসেট পার্কে একটি ভ্রাম্যমান ভ্যাকসিন সেবা দান কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এই ভ্রাম্যমান সেবাদান কেন্দ্র থেকে দৈনিক দু’শ ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া সম্ভব হবে। ভ্রাম্যমান ভ্যাকসিন কেন্দ্রে ইংরেজি ছাড়াও স্পেনিশ, ম্যান্ডারিন ও ক্যান্টনিজ ভাষায় কথা বলার সুযোগ থাকবে। গত মঙ্গলবার সিটি মেয়র বিল ডি ব্লাজিও ভ্যাকসিন সেবা আরো দ্রুত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি জানান ইতোমধ্যে ৪.৬ মিলিযন নিউইয়র্কারের ভ্যাকসিন দেয়া সম্পন্ন হয়েছে, যা কেন্টাকি স্টেটের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। তিনি বলেন যে এখন থেকে ৭৫ থেকে তদুর্ধ বয়সের যে কেউ কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া যে কোন ভ্যাকসিন দান কেন্দ্রে গিয়ে ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে পারবেন। এরই মধ্যে গত ৬ এপ্রিল থেকে ১৬ বছর থেকে তদুর্ধ বয়সীদের ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়েছে।
স্বাস্থ্য সংস্থার মহামারিবিদ মারিয়া ভ্যান কারখোভ বলেন, এই মুহূর্তে ব্রাজিলের অবস্থা খুবই ভয়াবহ।দেশটির অনেক হাসপাতালের আইসিইউয়ের ৯০ ভাগের বেশি পরিপূর্ণ হয়ে আছে রোগীতে। ব্রাজিলের পর ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে ভারতে। যুক্তরাষ্ট্রের পর এই দেশেই গত ৫ এপ্রিলই এক দিনে এক লাখের বেশি মানুষের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া ইউরোপীয় অঞ্চলের ৫১টি দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। ইউরোপে মৃত্যুর ৬০ ভাগই ঘটেছে যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানিতে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।
৫০ স্টেটেই ছড়িয়ে গেছে ‘ইউকে’ ভ্যারিয়েন্ট : যুক্তরাজ্য থেকে সর্বপ্রথম ছড়ানো কেন্ট স্ট্রেইন খ্যাত ই.১.১.৭ ভ্যারিয়েন্ট যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যেই ছড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে ইউএস সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)। সিডিসি জানিয়েছে, গত ৫ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের ১৫ হাজার বাসিন্দা এই স্ট্রেইনে আক্রান্ত রয়েছেন। ব্রিটেন থেকে ছড়ানো এই ভ্যারিয়েন্ট সাধারণ ভাইরাস থেকে আরো দ্রুত ছড়াতে পারে আরো অধিক প্রাণঘাতী বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ফ্লোরিডাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাসিন্দা নতুন এই স্ট্রেইনে আক্রান্ত রয়েছে। এখন পর্যন্ত ফ্লোরিডায় ৩ হাজার ১৯২ জন বাসিন্দা কেন্ট স্ট্রেইনে আক্রান্ত রয়েছে। এরপরই আক্রান্তের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মিশিগান- ১ হাজার ৬৪৯ জন। সাম্প্রতিক সময়ে মিশিগানের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পিছনে এই কেন্ট স্ট্রেইনের ভূমিকা রয়েছে বলেও জানা গেছে। কেন্ট ভ্যারিয়েন্ট ছাড়াও আরো দুইটি ভ্যারিয়েন্ট আছে যেগুলো সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠছে বলে জানিয়েছে সিডিসি। সিডিসি জানিয়েছে, সম্প্রতি ওয়াশিংটন ডিসিসহ আরো ৩২টি অঙ্গরাজ্যে ৩৭৪ জন বাসিন্দার শরীরে সাউথ আফ্রিকা থেকে ছড়ানো ভ্যারিয়েন্ট ই.১.৩৫১ শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া আরো ২৫টি অঙ্গরাজ্যে ২৮৯ জনের শরীরে ব্রাজিলের ভ্যারিয়েন্ট চ.১ এর অস্তিত্ব শনাক্ত হয়েছে।
করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের মুখে যুক্তরাষ্ট্র : যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমশ করোনাভাইরাসের চতুর্থ ঢেউ ঢুকতে শুরু করেছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন দেশটির শীর্ষ মহামারি বিশেষজ্ঞ মাইকেল ওস্টারহল্ম। অন্য বিশেষজ্ঞরাও একই সুরে কথা বলছেন। তাঁরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে করোনার টিকা কর্মসূচি বেশ ভালোভাবে হচ্ছে। কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণ মানুষ এখনো সুরক্ষিত নয় এবং যুক্তরাষ্ট্রে করোনার আরেকটি ঢেউ শুরু হতে পারে। সম্প্রতি মিনেসোটা ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজ রিসার্চ অ্যান্ড পলিসির (সিআইডিআরএপি) পরিচালক মাইকেল ওস্টারহল্ম মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে এই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন বলে মার্কিন সাময়িকী স্লেট-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এনবিসির মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে মাইকেল ওস্টারহল্ম আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘করোনা নিয়ে সারা বিশ্ব তটস্থ হয়ে আছে। আমরা এখন করোনার চতুর্থ ঢেউ শুরুর দ্বারপ্রান্তে রয়েছি। আগামী কয়েক সপ্তাহে সারা বিশ্বেই করোনার সংক্রমণ ভয়াবহভাবে বেড়ে যাবে। এই বাস্তবতা দ্রুত মার্কিনদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে। আমরা অতটা ভয়াবহ রূপ এখনো দেখিনি।’ মাইকেল ওস্টারহল্ম বলেন, এর আগের ঢেউয়ে সারা দেশে যা হয়েছিল, এবারও তার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। এরই মাঝে ৩ এপ্রিল মিশিগান অঙ্গরাজ্যে একদিনে ৮ হাজার ৪০০ জন করোনায় সংক্রমিত শনাক্ত হয়েছে। এটা মূলত সবার জন্য সতর্ক হওয়ার একটি সংকেত।
Posted ১২:০৩ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৮ এপ্রিল ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh