আহবাব চৌধুরী খোকন | বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারি ২০২১
থরে থরে সাজানো সবুজ ঝাউবন ও আকা বাকা পাহাড় পল্লীর নিভৃত নগরী কক্সবাজার পৃথিবীর বৃহত্তম সমুহ সৈকতের জন্য বিখ্যাত । ১২০ কিলোমিটারের সমুদ্র সৈকতকে ঘিরে স্থাপিত দর্শনীয় স্থান গুলো এবং সেই সাথে এখানকার পরিবেশিত বৈচিত্রময় খাবার দাবার ও স্থানীয় ভাবে তৈরী বিভিন্ন রকমের বাহারি জিনিষপত্র যে কাউকে আকৃষ্ট করবে সন্ধেহ নেই। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে অসংখ্য সমুদ্র সৈকত দেখার সুযোগ আমার হয়েছে । কোন সমুদ্র সৈকতে দ্বিতীয় বার যাওয়ার ইচ্ছা হয়নি। কিন্তু কক্সবাজারই ব্যতিক্রম । যতবারই গিয়েছি মনে হয়েছে দেখা শেষ হয়নি এখনো। এখানকার বিশেষত্ব হচ্ছে সমুদ্র সৈকত যতটা না সুন্দর এর চারিপাশের দৃশ্যাবলী এর চেয়েও নয়না ভিরাম। আর তাই প্রতি বছর দেশ বিদেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক ছুটে আসেন এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে। জনশ্রুতি আছে যে কক্সবাজারের আদি নাম ছিল পালংকী। ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স নামের এক কর্মকর্তা ১৭৯৯ সালে এখানে একটি বাজার স্থাপন করেন । তার নাম অনুসারে এই স্থানটি পরবর্তীতে কক্সবাজার হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। কক্সবাজারে রয়েছে ৫টি নদী ও ৫টি দ্বীপ । নদী গুলো হচ্ছে মাতামুহুরী, বাঁকখালী, রেজু, কোহালিয়া ও নাফনদী এবং দ্বীপ গুলো হচ্ছে মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিন। এই নদী ও দ্বীপ গুলোই মূলত একাকার হয়ে এখানকার চারিপাশেকে করে তোলেছে অপরূপ।
ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দুরত্ব গাড়ীতে ২৪৫ মাইল । গাড়ীতে করে সময় লাগে ১০ ঘন্টা । বছর দুয়েক আগে জুলাই মাসে ২০১৮ সালে তিন দিনের জন্য ঘুরতে গিয়েছিলাম ছবির মত সুন্দর এই এলাকাটি । রাত ১০ টায় ঢাকার মালিবাগ বাস স্টেশন থেকে গ্রীন লাইন বাসে করে রওয়ানা হলাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে । সাথে আমাদের দুই ভাইয়ের পুরো পরিবার । দেশে গ্রীন লাইনের সুপরিসর বাস গুলো ভ্রমনের জন্য খুবই আরামদায়ক । বৃহদাকার এই কোচ গুলো যখন দেশের রাস্তা দিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায় বুঝাই যায় না । আমার তিন ভাতিজি সানজিদা, নোজা,নোহা এবং মেয়ে রাইদা ও আকিদা খুব আনন্দিত । তাদের আগ্রহের কারণেই মূলত এয়াত্রায় কক্সবাজার যাওয়া । বাসে আমাদের সিট গুলো ছিল সামনের সারিতে । য়থাসময়ে বাসা যাত্রা শুরু করলে আমরা রাস্তার দুই দিকের দৃশ্যাবলী অবলোকন করতে করতে ছুটে চললাম নির্দিষ্ট গন্তব্যে । গাড়ীর সিডিতে পরিবেশিত সুরের মূর্ছনা ও আলো আদারের ঘুমের ঘোরে কেঠে যায় কয়েক ঘন্টা । এক সময়ে বাস এসে থামে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে । এখানে রয়েছে আধা ঘন্টা যাত্রা বিরতি সাথে কমপ্লিমেন্টারী ডিনার। ঝকঝকে তকতকে একটি রেষ্টেরেন্টে খুলে রাখা হয়েছে রেষ্টেরেন্ট ব্যাফে । এখানে গরম ,ঠান্ডা খাবার ও পানীয় পরিবেশিত হচ্ছে । রেষ্টুরেন্টে খাবারের মান এবং ব্যবস্থাপনা দেখে ভালো লাগলো । গাড়ী আবারো যাত্রা শুরু করলো কক্সবাজারের উদ্দেশে । এখান থেকে রওয়ানা দিয়ে মধ্য খানে আরেকটি বিরতি দিয়ে সকাল ৮টায় আমরা এসে পৌছি কক্সবাজার শহরে । এখান থেকে টেক্সি ভাড়া করে রওয়ানা হলাম আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে । আগেই রাত্রী যাপনের জন্য বুকিং দিয়ে রাখা ছিল ইন্টারন্যাশনাল সীগাল হোটেল । থ্রী স্টার হোটেল সীগাল সমুদ্র সৈকতে পাশ্বে অবস্থিত । হোটেলের সামনেই রয়েছে তাদের নিজস্ব সমুদ্র সৈকত এবং পেছনে বিশাল পুল। প্রথম যথন উদ্বোধন হয় ২০০২ সালে একবার উটেছিলাম এই হোটেলে। কিন্তু এর পর বেশ কয়েক বার কক্সবাজার এলেও সীগালে থাকা হয়নি । কারণ কক্সবাজারে আমরা আশক্ত হয়ে পড়েছি ঝাউবন রেষ্টেরেন্ট এর খাবারে । ঝাউবন রেষ্টেরেন্ট এখান থেকে কিছুটা দুরে অবস্থিত । ফলে আমরা বেশীর ভাগ সময়েই থেকেছি সায়মন হোটেলে । একবার অবশ্য নিরিবিলি হোটেলেও থেকেছি ।
সিগাল সকালের নাস্তা সেরে ভেবেছিলাম লম্বা একটা ঘুম দেবো । কিন্তু আমার মেয়ে ও ভাতিজির জন্য তা আর হয়নি । হোটেলে পৌছেই তারা ব্যস্থ হয়ে পড়েছে পুলে যেতে । শীগালের পুল খুবই সুন্দর । পুলের উপরে পাশ্চাত্য স্টাইলে খুলে রেখেছে অপেন বার । এতে পর্যটকরা ঘন্টার পর ঘন্টা পুলের পানিতে সাঁতার কাটছে আর পান করছে তাদের ঠান্ডা পানিও ।
দুপুরে যখন নামলাম সমুদ্র সৈকতে জোয়ারের পানিতে তখন পুরো এলাকা টইতম্বুর । বাচ্চারা খুব উপভোগ করেছে এই সময়টা । তবে বিপত্তি ঘটলো আমার জন্য । আমি আমার ছেলেকে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম । সে পরিস্কার পানি পেয়ে শুরু করে দিয়েছে দৌড়াদৌড়ি । সমুদ্রের ডেউ বুঝি খেলা শুরু করেছে তিন বছরের রাইয়ানের সাথে । একটু পর পর আসছে বিশাল বিশাল ঢেউ আর ভাসিয়ে নিচ্ছে সবাইকে । এটাই হল এই সমুদ্র সৈকতের বিশেষত্ব । এত অশান্ত এবং স্বচ্ছ সমুদ্র সৈকত আমি খুব কম পেয়েছি । বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক গুলো সমুদ্র সৈকত রয়েছে । বেশীর ভাগই মৃত এবং শান্ত । এটা যে সমুদ্র বুঝার উপায় নেই । নেই কোন গর্জন এবং হু হু বাতাস । বিকালে গিয়ে দেখি জমে উটছে সমুদ্র সৈকত । একখানা রাজকীয় চেয়ার ভাড়া করে বসে পড়লাম এখানে । ভেবেছিলাম সূর্যাস্ত দেখবো । কিন্তু কিছু কিছু বিড়ম্বনা দেখে বিরক্ত হলাম । একদিকে আছে ক্যামেরাম্যানদের উপদ্রপ আর অন্য দিকে হকার । পেয়ে গেলাম স্থানীয় কিছু শিশু শিল্পি । তাদেরকে কাছে ঢেকে নিয়ে গোল হয়ে বসে পড়লাম আমরা । বাচ্চা দুই শিল্পি নেঁচে নেঁচে পরিবেশন করলো চাটগায়ের বিখ্যাত সেই গান
“মধু হই হই বিষ হাওয়াইলা
হন হারনে ভালবাসার দাম ন দিলা ……’’
রাত বাড়ার সাথে সাথে সময়ও গনিয়ে আসছে । প্রাণবন্ত এই আসর থেকে উটতে মন চাচ্ছিল না ।
রাতে আমাদের গন্তব্য ছিল বার্মিজ মার্কেট । কক্সবাজারের বার্মিজ মার্কেট বৈচিত্রময়তায় পরিপূর্ণ কেনাকাটার জন্য বিখ্যাত একটি অত্যাধুনিক মল। এই মার্কেটের সকল পণ্যই স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত ,দৃষ্টিনন্দন এবং দামে সস্থা। তবে এইবার কক্সবাজারে কমলগন্জের হেলালকে থুব মিছ করেছি । এর আগে যতবার কক্সবাজার এসেছিলাম হেলাল ছিল আমাদের গাইড। হেলাল এক সময় কক্সবাজারের বাসিন্দা ছিল । ফলে এখানকার ভাষা এবং নাড়ী নক্ষত্র তার নখদর্পনে । সে থাকলে দরদাম কিংবা চেনা জানার জন্য কোন চিন্তা করতে হয় না । এর আগে আমরা যতবার এসেছি কেনা কাঠার কাজ সে করেছে । ফলে আমরা নির্ভয়ে চলাফেরা করেছি । যাহোক বার্মিজ মার্কেটে কেনাকাঠা সেরে রেষ্টেরেন্ট ঝাউবনে রাতের ডিনার শেষ করে আমরা যখন হোটেলের রোমে ফিরে আসি তখন গড়িতে রাত ১ টা । পরের দিন সকালে আমরা দেখতে গেলাম ময়েশখালীর আদিনাথ মন্দির । ময়েশখালী বাংলাদেশের এক বিস্থির্ণ দ্বীপ । ময়েশখালী পানের জন্য বিখ্যাত। গানের একটি বিখ্যাত চরণ মনে পড়ছে ।
“যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম মইশাইল্যা পানের খিলি তারে বানাই খাওইতাম। ”আদিনাথ মন্দিরে যাওয়া এক ধরনের এডভাঞ্চার । সমুদ্রের উপর দিয়ে প্রায় তিন মাইল জায়গা স্পিটবোর্ড দিয়ে পার হতে হয় তার পর আবার মাইল দুয়েক রিক্সা কিংবা বেবিটেক্সি রাইডের পর আপনি দেখা পাবেন আদিনাথ মন্দিরের । এটি মহেশখালী দ্বীপের একটি বিশাল উচু পাহাোড়ের উপর অবস্থিত । পাহাড় থেকে সমুদ্র অবলোকন করা যায় অবলিলায় । আদিনাথ মন্দিরের স্পিটবোর্ড ভ্রমন স্মরণ রাখার মত একটি এডভেঞ্চার । পানির ঢেউযের মধ্যে দ্রুত গতিতে স্পিটবোর্ড যখন এগিয়ে যায় তখন মনে হয়এই বুঝি ডুবে যাচ্ছি । তবে ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে এভাবে ভ্রমন আসলেই বিপগজনক । আদিনাথ মন্দির থেকে ফিরে দুপুরের লাঞ্চ খেয়ে চলে আসি সুমিং পুলে । এই সুমিং পুলেটি আকারে যেমন বিশাল পানিও তেমনি খুব পরিস্কার । এখানে সন্ধ্যা অবদি পানির মাঝে সাতার কেঠে থুব চমৎকার একটা সময় অতিবাহিত করলাম । তবে এবার সীগালে এসে মনে হল পুরো হোটেলটি হয়ে পড়েছে সুটিং স্পট । এক সাথে অনেক গুলো ছবির সুটিংয়ের দৃশ্য চোখে পড়লো। এখানকার বাহিরের পরিবেশ খুবই নৈশর্গিক । তাই সম্ভবত ছবি নির্মাতারা এই স্পটটিকে বেছে নিয়েছে শুটিংয়ের জন্য ।
কক্সবাজার এলে ভালো লাগে সমুদ্র সৈকতের চেয়ারে বসে ছোট ছোট কাপে কফি পান করতে । সমুদ্র সৈকতের কফির স্বাদই আলাদা। এখানে এলে অবলোকন করা যায় দিগন্তজোড়া বিস্তীর্ণ বালুচর, সারি সারি ঝাউগাছ,পাল তোলা নৌকা, ট্রলার,স্কুডারের শব্দ এবং হাজারো পর্যটকদের কোলাহল । সন্ধ্যা হলে ঝমে উটে গানের আসর। চায়ের পেয়ালা ঝড় তোলা শিশু বাউলদের কন্ঠে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় কখনো রাধা রমন, কখনো হাসন রাজা , কখনো লালন, আব্বাস উদ্দিন কিংবা কখনো চাটগায়ের শেফালী গুশের কালজয়ী গান । কক্সবাজারে অনেক প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আজগবি মসজিদ। এটি ১৬০০-১৭০০ খৃস্টাব্দে শাহ সুজার আমলে তৈরি করা হয়েছিল। এই শহরে রয়েছে দেশের বৃহত্তম লাইভ ফিশ একুরিয়াম রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড। নগরীর ঝাউতলায় ৮০ একর জায়গার উপর প্রতিষ্টিত এই ফিস একুরিয়ামে ৬০ প্রজাতির দূর্লভ মাছ রয়েছে । একুরিযামটি এমন ভাবে তৈরী করা হয়েছে এর ভিতর দিয়ে হাটলে মনে যেন আপনি সাগরের মধ্যে হাটছেন আর আপনার মাথার উপর দিয়ে ভাসছে মাছ । হাটার সময় গায়ে লেগে যেতে পারে কাঁকড়া, কচ্ছপ, কুঁচিয়া ইত্যাদি সমুদ্র তলদেশের নানা কীটপতঙ্গ। শহর পরিভ্রমনের জন্য রয়েছ টমটম (ঘোড়ার গাড়ী) সার্ভিস। পরদিন রাত ১০ টার গ্রীন লাইন বাসে চেপে আমরা রওয়ানা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে । আর এভাবেই সমাপ্ত হল আমাদের কক্সবাজারের সফর ।
লেখক- কলাম লেখক ও সংগঠক , নিউইয়র্ক ।
Posted ৯:২৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারি ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh