মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ | ৫ চৈত্র ১৪৩০

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

বাংলাদেশির রসুইঘরে মাতোয়ারা যখন বিশ্ব

বাংলাদেশ রিপোর্ট :   |   বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১

বাংলাদেশির রসুইঘরে মাতোয়ারা যখন বিশ্ব

কিশোয়ার চৌধুরী নূপুর

অস্ট্রেলিয়াতে চলছে ‘মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া’ নামে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় রিয়েলিটি শো। সেখানে দেশটির বিভিন্ন প্রান্তের সেরা রাঁধুনিরা বিভিন্ন ধাপ পার করে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য একের পর এক সুস্বাদু এবং মুখরোচক পদ রান্না করে চলেছেন। আর সেখানেই অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রতিযোগী কিশোয়ার চৌধুরী নূপুর। আজ বাংলাদেশির রসুইঘরে মাতোয়ারা যখন বিশ্ব তখন মনে পড়লো বেগম রোকেয়ার ‘রসনা-পূজা’ প্রবন্ধটি, সেখানে তিনি ভারতবর্ষের মুসলমান সমাজের রসনা পূজার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। সেখানে তিনি রসনা পূজার কারণ এবং রসনা পূজার ফলে যেসব ভোগান্তি হয় তারও উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি রন্ধনশালার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। তার ভাষায় ‘কাহারও বাড়ি গেলে দেখিবে চালের উপর খড় নাই, ঘরখানার চারিদিকে আবর্জনাময়, বসিবার একটু স্থান নাই, মাথার উপর (চালে) মাকড়সার জাল ঝুলিতেছে -এইরূপ তো হীন অবস্থা। কিন্তু জলখাবার সময় দেখিবে অতি উৎকৃষ্ট পরোটা, কোর্মা, কাবাব উপস্থিত – আমাদের সাতদিনের খাবার খরচ তাঁহার একদিনে ব্যয় হয়।’

এছাড়া রন্ধনশালার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন ‘দ্বারদেশে পচা কাদা; হংস, কুক্কুট ইত্যাদি সেই (পচা ফেনমিশ্রিত) কাদা ঘাঁটিতেছে, তাহার দুর্গন্ধে আপনার ঘ্রাণেন্দ্রিয় ত্রাহি ত্রাহি করিবে। কিন্তু পশ্চাদপদ হইবেন না – কোনমতে ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিবেন কেহ বাটনা বাটিতেছে, কেহ কুটনা কুটিতেছে, কেহ কেওড়া বা গোলাপজলে জাফরান ভিজাইতেছে। এখানকার সুগন্ধ এতই আনন্দপ্রদ (ওহারঃরহম) যে ব্রাহ্মণের পৈতা ছিঁড়িতে ইচ্ছা হইবে।’


সৈয়দ মুজতবা আলীর অন্যতম সেরা রম্যগল্প ‘রসগোল্লা’। এ গল্পের রম্য বিষয়বস্তুর সঙ্গে আরও একটা বিষয় লক্ষণীয়, সেটা হচ্ছে রসগোল্লার স্বাদ। এ স্বাদ এতই মনোহরী যে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন মানুষকে কাবু করতে সক্ষম। সৈয়দ সৈয়দ মুজতবা আলী তার প্রবন্ধ-বিচিত্রা গ্রন্থে লিখেছেন: ‘তখনকার দিনে (মুঘল আমলে) পান খাওয়ার খুব রেওয়াজ ছিল। পূর্ববঙ্গে সাচি ও অন্যান্য প্রকার পান ও সুপারি পর্যাপ্ত পাওয়া যেত। কিন্তু পানের মশলা আসত বিদেশ থেকে। বিহার থেকে আসত বিখ্যাত জনকপুরী। সাচি পানের এত চাহিদা ছিল যে ঢাকার সাচি পানের জন্য আলাদা বাজার বসেছিল। এ বাজারের নাম ছিল সাচিপান দরিয়া।’

মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার ফেইসবুক পেইজমাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার ফেইসবুক পেইজঅন্যদিকে মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান অনূদিত জেমস টেলর এর ‘কোম্পানি আমলে ঢাকা’ বই থেকে জানা যায় তখন ঢাকায় ‘তাম্বলী সম্প্রদায়’ নামে এক পেশাজীবী শ্রেণির কথা যারা পান-সুপারি বিক্রির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশে তাম্বুল বা পানকে সাধারণত খাওয়ার পর পরিবেশন করার চল আছে। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই মোটামুটি কমবেশি পান খান, বিশেষ করে উৎসবের খানাদানা শেষে পান পরিবেশন বাংলাদেশের অনেক পুরনো ঐতিহ্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পানের অনেক মসলা যোগ হয়েছে, কিন্তু পানের চাহিদা রয়ে গেছে। বয়স্ক যাদের পান চিবোনোর মতো দাঁত নেই তারাও হামানদিস্তা বা শিলপাটাতে ছেঁচে পান খান। কিন্তু পান তাদের খেতেই হবে।


ফিরে আসি ‘মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া’ রিয়েলিটি শোতে যাতে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রতিযোগী কিশোয়ার চৌধুরী নূপুর। অবশ্য এ শোতে এ প্রথম কোন বাংলাদেশির অংশগ্রহণ নয়, এর আগেও ২০১৭ সালে প্রচারিত নবম আসরে রাশেদুল হাসান নামে এক বাংলাদেশি-অস্ট্রেলিয়ান অংশ নেন। তিনি নির্বাচিত হন সেরা ২৪-এর জন্য। তবে প্রথম পর্বেই শেষ হয়ে যায় রাশেদুল হাসানের মাস্টারশেফের যাত্রা। নানা অভিজ্ঞতা আর কিছু স্মৃতি নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি।

রিয়েলিটি শো এর একটি মুহূর্তরিয়েলিটি শো এর একটি মুহূর্তএবারের মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার ত্রয়োদশ আসরের প্রতিযোগী বাংলাদেশি বংশদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরীর বিশেষত্ব হচ্ছে তিনি শুরু থেকেই বাংলাদেশের সব ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন করে চলেছেন। তাকে এ প্রতিযোগিতার শুরুতে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো এ প্রতিযোগিতা থেকে তার প্রত্যাশা কী? তিনি বলেছিলেন, তিনি অস্ট্রেলিয়াতে বাংলাদেশের খাবারের প্রচলন করতে চান আর বাংলাদেশি খাবারের উপর একটা বই লিখতে চান যাতে করে সহজেই যে কেউ বাংলা খাবার তৈরি করতে পারেন। এরপর তিনি একে একে বাংলাদেশের সব খাবার রান্না করে গেছেন যার মধ্যে আছে ফুচকা, চটপটি, সমুচা, আলুর দম আর তেঁতুলের চাটনির মিশেল, খিচুড়ি, বেগুন ভর্তা, মাছ ভাজা, নিরামিশের প্ল্যাটার, খাসির রেজালা ও পরোটা, ক্রোসাঁ উইদ অ্যা ক্যালকাটা টুইস্ট।


সব শেষে রোববার সেমিফাইনালের সার্ভিস চ্যালেঞ্জে তিনি রান্না করেছিলেন স্ট্রাটার হিসেবে কিংফিশ, মেইন মেন্যু হিসেবে ছিলো গোট নিহারি আর ডেজার্ট হিসেবে ছিলো দ্য বেঙ্গল আফটার মিন্ট। মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার এবারের ফিনালেতে উঠার লড়াই ছিলো এ ‘সার্ভিস চ্যালেঞ্জ’। এ চ্যালেঞ্জে বিচারকদের পাশাপাশি রেস্তোরাঁয় আসা অতিথিদেরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রান্না করে খাওয়াতে হয়েছিলো। এ ‘সার্ভিস চ্যালেঞ্জ’ মোটেই সহজ ছিল না। তিনজন প্রতিযোগীকেই এমন তিনটি পদ রাঁধতে হবে যা তাদের নিজস্ব ইউনিক খাবারকে তুলে ধরবে। খাওয়াতে হবে ২৩ জন গ্রাহক, ২০ জন অতিথি আর প্রতিযোগিতার তিন বিচারককে। আর এ সবকিছুই করতে হবে মাত্র ঘণ্টা সময়ের মধ্যে।

মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার ফেইসবুক পেইজমাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার ফেইসবুক পেইজকিশোয়ারের মেইন কোর্স ছিল নেহারি, যার আসল স্বাদ পেতে হলে সেটাকে সারারাত ধরে চুলার অল্প আঁচে জ্বালাতে হয়। কিন্তু এ স্বল্প সময়েই কিশোয়ার রান্না করেন মজাদার নেহারি। উনি বলেছিলেন, এটি তার বাবার শেখানো রেসিপি। খাবার শেষে ডেজার্ট। সেখানেই কিশোয়ার তার উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে তৈরি করেন পানের সঙ্গে আইসক্রিমের মিশেলে এক অদ্ভুত রিফ্রেসিং ডেজার্ট। এটাকে উনি নাম দিয়েছেন ‘দ্য বেঙ্গলি আফটার ডিনার মিন্ট’। এটা মুখে দিয়েই বিচারকদের মুখোভঙ্গিতে ফুটে ওঠে অদ্ভুত সব ভঙ্গিমা। উনার পান খেয়ে বিচারক মেলিসা বলেন, ‘এটা কিশোয়ারের প্রেমপত্র বাংলাদেশের জন্য’।

এভাবেই অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের মেলবোর্নের বাসিন্দা, দুই সন্তানের মা কিশোয়ার (বাকি অংশ ২৬ পাতায়)
বাংলাদেশির রসুইঘরে মাতোয়ারা যখন বিশ্ব

চৌধুরী পৌঁছে যান এ শো এর ফাইনালে। এটা নিয়ে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সব বয়সী বাংলাদেশিদের মধ্যে উত্তেজনা কাজ করছে। সবাই প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন কিশোয়ারকে। এমনকি বাংলাদেশ থেকেও পাচ্ছেন শুভেচ্ছা বাণী। কিশোয়ার এ প্রতিযোগিতায় যে কারণে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সেটা হচ্ছে উনি প্রত্যেকটা রেসিপি রান্না করার পর বলেছেন সেই রেসিপিটা উনি বাংলাদেশের কার কাছ থেকে পেয়েছেন। সেখানে যেমন একদিকে এসেছে উনার বাবা-মায়ের নাম, অন্যদিকে এসেছে বাংলাদেশের রাস্তার খাবারের কথাও। অবশ্য উনার রাস্তার খাবার টেস্ট করে বিচারকরা বলেছেন এটাই যদি রাস্তার খাবার হয় তাহলে আমি প্রতিদিনই রাস্তার খাবার খেতে চাই।

মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার প্রতিযোগিরামাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার প্রতিযোগিরাআর কিশোয়ার যতবারই বাংলাদেশের নাম বলেন উনার গলা ধরে আসে। চোখ হয়ে যায় অশ্রুসিক্ত। এটা ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব ভালো লেগেছে। তাই উনাকে টিভির পর্দায় যতবারই বাংলাদেশ নামটা উচ্চারণ করতে শুনি ততবারই আমাদেরও গলা ধরে আসে। আসলে এ অবারিত আবেগটাই তো আমাদের সম্বল। সামর্থ না থাকা সত্ত্বেও জীবনে চলার পথে একধাপ এগিয়ে দেয় এ আবেগ। শুরু করেছিলাম রসনা পূজা, রন্ধনশালার পরিবেশ এবং বিদেশে আমাদের মিষ্টির কদর দিয়ে। সেখানে ফিরে আসি। অবশেষে আমাদের পরিশ্রমী বাঙালি মায়েদের বাটনা-বাটা, কুটনা-কুটার একটা আন্তর্জাতিক অর্জন পেতে যাচ্ছি আমরা। রান্নাঘরের পরিশ্রমকে আমরা সাধারণত স্বীকৃতি দিতে চাই না। সেদিক দিয়ে চিন্তা করলে এটা অবশ্যই অনেক বড় একটা অর্জন। আমাদের ডেজার্টের কথা এখন জানে সারা বিশ্ব। কিশোয়ার চৌধুরী যেন বাংলাদেশকেই এগিয়ে নিয়ে চলেছেন বিশ্বের দরবারে।

এ লেখা যখন প্রকাশিত হচ্ছে তখন ফাইনালে কিশোয়ার একটা চমৎকার ব্যাপার ঘটিয়ে ফেলেছেন। পান্তা ভাতের সঙ্গে আলুভর্তা আর শুকনা মরিচ পোড়া। সঙ্গে ছিলো ইলিশের বিকল্প হিসেবে সার্ডিন মাছ আর একেবারে খাঁটি পেঁয়াজ, ধনেপাতার বাংলাদেশি সালাদ। এ খাবার তৈরি করে কিশোয়ার বলেন, এটা কখনোই কোন রেস্তোরাঁতে পাওয়া যাবে না। এ সহজ খাবার বিচারকরা পরম তৃপ্তি সহকারে খেয়েছেন এবং বলেছেন এটা খুবই সাধারণ হলেও অনেক শক্তিশালী একটা খাবার।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected] সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!

advertisement

Posted ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

কাঁঠাল সমাচার
কাঁঠাল সমাচার

(1377 বার পঠিত)

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.