সেতারা কবির সেতু | বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১
আমরা যখন তিস্তা ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে তখন আকাশে ছিল পূর্ণিমার চাঁদ, হালকা শীতল বাতাস আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছিল। নদীর পানিগুলো কল,কল শব্দ করে বইয়ে চলছিল। তখন বার, বার বলতে ইচ্ছে করছিল-
মন এক গভীর সমুদ্র
রং তার নীল গাঢ় নীল
সারাদিন ভেসে, ভেসে চলে
মেঘেদের সাথে কত মিল।
গতবছরের ১৩ নভেম্বর আমরা বিরামপুর থেকে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার উদ্দেশ্যে রওনা হই। যাবো জয়শ্রী রানী আপুর বাসায়। আপু ডিমলাতে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আপু ডিলামর উপজেলা নির্বাহি অফিসার। আমরা রওনা দেই সকাল ১০ টার দিকে। একটি প্রাইভেট গাড়িতে কবির, আমি, রাকিন আর রাহাত। ড্রাইভার পুরনো দিনের বাংলা গান দিয়েছেন। আমি জানালার গ্লাসটা হালকা খুলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনছি। বাতাসে চুলগুলো বার, বার আমার মুখে পড়ছে। মিষ্টি রোদে হালকা বাতাস ভালোই লাগছিল। কিন্তু রাস্তা এতোই খারাপ যে বেশিক্ষণ চোখ বন্ধ করে গান উপভোগ করতে পারলাম না। চোখ খুলে গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখি পুরো রাস্তায় কাজ চলছে। রাস্তা বড় করা হচ্ছে। জার্নির কষ্ট হলেও দেখে ভালোই লাগলো একসময় বাংলাদেশের সব রাস্তাগুলো হবে আধুনিক।
যাইহোক, দুপুর ২.৩০ মিনিটে আমরা ডিমলায় আপুর বাংলাতো পৌঁছালাম। সবাই ফ্রেস হয়ে গেলাম খাবার টেবিলে। আপু আর সায়নী তখনো না খেয়ে আছে। একসাথে খাবো বলে। খাবার টেবিলে দেখি আপু অনেক কিছু রান্না করেছেন। আমাদের পছন্দের সবকিছুই ছিল। সবাই তৃপ্তি করে খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে বিকেলে ঘুরতে বের হলাম। চালকের দায়িত্বে ছিল রেজাউল ভাই। বেশ মজার মানুষ। সারাটাক্ষণ সবাইকে হাসিখুশিতে রাখেন। অবশ্য গাড়িও চালান দারুণ দক্ষতার সাথে। প্রথমে আমরা গেলাম নীলসাগর দেখতে।
নীলসাগর একটি ঐতিহাসিক দিঘি, যা বর্তমানে নীলফামারী জেলা সদর থেকে উত্তর-পশ্চিম কোণে ১৪ কিমিঃ দূরত্বে গোড়গ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত৷। মনে করা হয়, ঐতিহাসিক বৈদিক রাজা বিরাট এই দিঘি খনন করেন এবং তা বিরাট দিঘি হিসাবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে বিন্না দিঘি নামেও পরিচিতি পায়। স্বাধীনতার পর নীলসাগর নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে এবং বর্তমানে এখানে ব্যাপক সংস্কার করে ভ্রমণ পিপাসুদের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতি বছর শীত মৌসুমে অসংখ্য অতিথি পাখির সমাগম ঘটে।
নীলসাগর দেখা শেষ করে আমরা রওনা হলাম তিস্তা ব্যারেজ দেখার জন্য। তিস্তা ব্রীজে পৌঁছাতে আমাদের প্রায় রাত সারে আটটা বেজে যায়। বাংলাদেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্পের তিস্তা ব্যারেজ লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলাধীন গড্ডিমারী ইউনিয়নের দোয়ানী এবং পার্শ্ববর্তী নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলাধীন খালিসা চাপানী ইউনিয়নের ডালিয়া- এর মধ্যবর্তী স্থানে তিস্তা নদীর উপর নির্মিত। ভারতের উত্তর সিকিমের পার্বত্য এলাকায় তিস্তার উৎপত্তি। বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে নীলফামারী জেলা দিয়ে। এ নদী বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের সব কয়টি জেলা অর্থাৎ নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার ওপর দিয়ে প্রবহমান। আশির দশকে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে তিস্তা নদীর ওপর গড়ে তোলা হয় বাঁধ। যাকে বলা হয় তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প। এ ব্যারেজটি তৈরির ফলে নীলফামারি, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার বিশাল এলাকা সেচ সুবিধার আওতায় এসেছে।
নদীর মাঝখানে ব্যারেজ। যান্ত্রিক গেট। টানা ৪৪টি গেট একনাগাড়ে। এর আরেক পাশে আছে আরও আটটি গেট। খালে পানি নেওয়ার জন্য। অনেকগুলোই খোলা। তিস্তা নদীর পানিকে নিয়ন্ত্রণ করে, পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় সেচের কাজে লাগানো হয় এই ব্যারেজ দিয়ে। লোহা-লক্কড়, কংক্রিটের বিশাল বিশাল সব কাঠামো। নদীর দুপাশে গড়ে তোলা হয়েছে সবুজ বেষ্টনী।
তিস্তা ব্যারেজকে ঘিরে তিস্তার পাড় সেজে উঠেছে অপরূপ সাজে। সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে বেশ কয়টি পিকনিক স্পট। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ দলবেঁধে এখানে এসে পিকনিক করে। বর্ষাকালে তিস্তা যথেষ্টই ভরা ও খরস্রোতা থাকে। খালটাও দেখার মতো। বিকেলে অনেকেই আসে বেড়াতে। ব্যারেজের পাশে পিচ ঢালা কালো রাস্তা দু’পাশ কাশফুলে ঢাকা। অপুরূপ সে দৃশ্য। পিচঢালা সরু পথ ধরে চলতে চলতে মনে হবে এই পথ যেন শেষ না হয়। সবকিছু মিলিয়ে এটি দেখার মত একটি জায়গা। রাত প্রায় দশটার দিকে আমরা ডিমলা উপজেলাতে যাই। আপুর অফিসে সবাই কিছুক্ষণ বসি। এরপর সবাই মিলে যাই অফিসার্স ক্লাবে। আমরা ছাড়াও সেখানে আরও কিছু অফিসার ছিলেন। সবাই ক্যারাম খেললাম। বাচ্চারা টেবিল টেনিস খেললো। খেলা শেষে সবাই যখন ক্লান্ত তখনই আমাদের জন্য আসলো বিভিন্ন নাস্তা। নাস্তা শেষ করে সবাই চা পান করলাম। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে চলে আসলাম বাংলোতে। সবাই খুব ক্লান্ত। ফ্রেশ হয়ে ঘুমাতে গেলাম।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হালকা শীতল বাতাসের সাথে মিষ্টি রোদে বাংলোর চারপাশে হাঁটছি। গাছে, গাছে বাহারি ফুল, পাখিদের কিচির মিচির, পানির ফোয়ারা আর লেকে মাছদের লুকোচুরি খেলা দেখে মনে হলো তারা যেন আমাকে সকালের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। ঠিক তখনই ফেতর থেকে ডাক আসলো নাস্তা করার। নাস্তার পর্ব শেষ করে রেডি হলাম তিনবিঘা করিডর দেখতে যাবার জন্য।
তিনবিঘা করিডর হলো একটি স্বতন্ত্র ভূমি। যা ভারতের মালিকানাধীন তিনবিঘা জায়গার মধ্যে অবস্থিত। এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার এবং বাংলাদেশের লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার সীমান্তে অবস্থিত। লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার সীমান্তবর্তী ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ছিটমহল ছিল দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা। এ ছিটমহলের সাথে তৎকালীন পাকিস্তানের মূল ভূখন্ডের যোগাযোগের জন্য একটি প্যাসেজ ডোর এর ব্যবস্হা রাখা হয়েছিল। যা বর্তমানে তিন বিঘা করিডর নামে পরিচিত। ২০১১ সালের আগ পর্যন্ত তিন বিঘা করিডর ২৪ ঘন্টা খোলা ছিল না। ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যার ফলে বাংলাদেশীদের যাতায়াতের জন্য বর্তমানে ২৪ ঘন্টা খোলা রাখা হয় তিন বিঘা করিডর। ২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে দহগ্রাম আঙ্গরপোতা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আমি খুবই অবাক হয়েছি এটা দেখে যে, দুইপাশে বাংলাদেশের অংশ আর মাঝখানের প্যাসেজটুকু ভারতের। প্যাসেজের একদিকে পাটগ্রাম আর অন্যদিকে দহগ্রাম আঙ্গরপোতা। প্যাসেজ ব্যবহার করেই মানুষ এপার থেকে ওপার যায়। আমরা যখন দহগ্রাম আঙ্গরপোতা যাই তখন দেখি মাঝখান দিয়ে মেঠ পথ। দুইপাশে ধানক্ষেত আর চা বাগান। ধানক্ষেত আর চা বাগানগুলো লাগালাগি করে আছে। বাংলাদেশের অংশে ধানক্ষেত আর ভারতের অংশে চা বাগান। এই দৃশ্য সত্যি
মনোমুগ্ধকর। দহগ্রাম আঙ্গরপোতায় বসবাসকারী মানুষের সাথে কথা বলেছি। তাদের সুখ, দুঃখের কথা শুনেছি। সবাই একটি বিষয়ে বেশ খুশি। ২৪ ঘন্টা প্যাসেজ খোলা থাকার কারনে তারা যেকোন সময় এপার থেকে ওপার যেতে পারে। দেখা শেষ হলে আমরা বাংলোর উদ্দেশ্য রওনা দেই। বাংলোতে পৌঁছাতে আমাদের বিকেল হয়। ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে আমরা একটু রেস্ট নিচ্ছিলাম। সেদিন ছিল দিপাবলী। আপু দিপাবলীর আয়োজন করছিলেন। আবার আমাদের জন্য নাস্তাও রেডি করছেন। আবার দেখি অনেকেই অনেক কাজ নিয়ে এসেছে। সেগুলোও দেখছেন। আমি খুব অবাক হয়ে এই মহীয়সী নারীকে দেখছিলাম। একজন মানুষের কতো গুণ তাই ভাবছিলাম।
রাতে আমরা রওনা হলাম বাসায় আসার জন্য। ডিমলা থেকে গাড়ি নিয়ে বিরামপুর। গাড়িতে পুরনো দিনের গানগুলো বাজাতে বললাম। গাড়ির গ্লাস একটু খুলে দিলাম। জোছনা রাত, চারপাশটা নীরব, গাড়ি চলছে, ঠান্ডা বাতাস আমাদের ছুয়ে যাচ্ছে। গাড়িতে গান বাজছে এই পথ যদি না শেষ হয়……..। সেই গানের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে আমরাও সবাই বললাম এই পথ যদি না শেষ হয়……..।।
Posted ৮:৩১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh