ক্রীড়া ডেস্ক : | রবিবার, ২১ জুন ২০২০
জেমস ক্লিভল্যান্ড ওয়েন্স। দুনিয়া চেনে জেসি ওয়েন্স নামে। যে নাম শুনলেই মনে পড়ে ১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিক। কিন্তু সেই বছরই যে ওয়েন্স ১০০ মিটার স্প্রিন্টে রেকর্ড গড়েছিলেন, তা কেউ মনে রাখেননি। চিকাগোর স্ট্যাগ ফিল্ডে ২০ জুন তিনি ১০.২ সেকেন্ড সময় নিয়ে রেকর্ড গড়েন। এই পারফরম্যান্সের কারণেই ওয়েন্সকে বর্ণবাদী আমেরিকা অলিম্পিক দলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। আসলে আমেরিকার হাতে বিকল্পও ছিল না। হিটলারের জাত্যভিমানে আঘাত করতে হলে ওয়েন্সকে তাদের লাগতই।
জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলার ভেবেছিলেন, ১৯৩৬ সালের অলিম্পিক্সে তার দেশের অ্যাথলিটদের সামনে কেউ দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু এক কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাথলিট প্রবল প্রতাপশালী একনায়কের সব হিসাব পাল্টে দিয়েছিলেন। ৩ আগস্ট, ১৯৩৬, ১০০ মিটার দৌড়ে জেসি প্রথম হন। পরের দিন লং জাম্পে প্রথম। তারও পরের দিন ২০০ মিটার স্প্রিন্টে জেসি আবার অন্যদের পেছনে ফেলেন। এর কয়েক দিন পর ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে চতুর্থ সোনার মেডেলটি জেতেন জেসি। একটা অলিম্পিক্সে চারটি স্বর্ণপদক। সেই কীর্তিও গড়েছে কি না এক কালো মানুষ এই ক্ষেভে হিটলার কারও সঙ্গে হাত মেলাননি। তাতে ওয়েন্সের কোনো দুঃখ ছিল না। পরে বলেছিলেন, ‘হিটলার হাত না মেলালে কী হবে, হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আমার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন।’ বার্লিন অলিম্পিকে জেসি ওয়েন্স যে বিশ্বমানের রেকর্ড গড়েন তা টিকে ছিল ৪৮ বছর। ১৯৮৪ সালে সেই রেকর্ড ভেঙেছিলেন কার্ল লুইস।
১৯১৩ সালে আলাবামায় জন্ম জেসির। বাবা-মায়ের ১০ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। জেসির পিতামহ ছিলেন ক্রীতদাস। বাবা কাজ করতেন মুদির দোকানে। আর্থিক অনটনে পরিবারকে সাহায্য করতে ওয়েন্স জুতার দোকানে কাজ শুরু করেন। সঙ্গে মুদিখানার জিনিস পৌঁছে দিতেন বাড়ি বাড়ি। এই করতে করতেই পায়ের জোর টের পেয়েছিলেন ওয়েন্স।
দৌড়ের প্রতি আলাদা টানের শুরুও তখনই। দৌড়াতে ভালোবাসতেন জেসি। এটা বুঝতে পেরেছিলেন ক্লিভল্যান্ডের ইস্ট টেকনিক্যাল হাইস্কুলের শিক্ষক। স্কুলে পড়াকালীন তার প্রতিভা নজর কেড়েছিলেন সবার। শিক্ষকের উৎসাহে নিজেকে শুধু তৈরিই করলেন না শিকাগোয় ন্যাশনাল হাইস্কুল চ্যাম্পিয়নশিপে লং জাম্প ও ১০০ ইয়ার্ড ড্যাশে বিশ্বরেকর্ডও গড়লেন ওয়েন্স। ১৯৩৫ সালে মিশিগানে বিগ টেন মিট কনফারেন্সের সময়ও ওয়েন্স তিনটি বিশ্বরেকর্ড করেন।
জেসি ওয়েন্স সব কীর্তি ছাপিয়ে গিয়েছিলেন অলিম্পিকের ইতিহাসে সেরা ৪৫ মিনিট উপহার দিয়ে। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে চারটি স্বর্ণ জয় করে ইতিহাস গড়েছিলেন। কিন্তু জেসি ওয়েন্সের গল্প সেখানেই থামেনি। পরে বর্ণবৈষম্যবিরোধী লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি। ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাসে জেসির বীরত্বগাথাও এখন কিংবদন্তি। লং জাম্পে বব বিমনের ২৩ বছরের রেকর্ড ভেঙে অলিম্পিক সোনাজয়ী মাইকেল অ্যান্টনি পাওয়েল একবার বলেছিলেন, ‘অলিম্পিকে আমার সেরা তিন হলো জেসি ওয়েন্স, কার্ল লুইস, উসাইন বোল্ট। প্রথম দুজন স্প্রিন্টের সঙ্গে জাম্পটাও দিত। অলরাউন্ড অ্যাথলিট। বোল্টের চেহারাটা লং জাম্পের উপযোগী হলেও ও ওই ইভেন্টটা বাদ দিয়েছে। ও লং জাম্পে নামলে হয়তো আমার রেকর্ড ভেঙে দিত। হয়তো ৯ মিটারের গণ্ডিও টপকে যেত। কিন্তু দক্ষতা আর বর্ণবাদবিরোধী প্রভাব বিবেচনায় নিলে ওয়েন্স অতুলনীয়।’
মার্কিন চিত্রপরিচালক স্টিফেন হপকিন্স মনে করতেন জেসি ওয়েন্সের বর্ণময় জীবনকে সেলুলয়েডে ধরা সম্ভব নয়। ‘মাত্র দুই ঘণ্টার ফ্রেমে জেসির জীবনকে পুরোপুরি বন্দী করা অসম্ভর। ১৯৩৪-৩৬ সালের মধ্যে ট্যালেন্টেড অ্যাথলিট থেকে বিশ্বচ্যাম্পিয়নে পরিণত হন জেসি। এই সময়ে সাফল্যকে না হয় ধরা গেল। কিন্তু কালোদের দুনিয়ায় তার নাটকীয় আবেদন কিভাবে ধরবেন? সে সময়ই ইউরোপজুড়ে হিটলারের হাত ধরে ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ফ্যাসিবাদী ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন ওয়েন্স।’
ওয়েন্স যখন উৎকর্ষের চূড়ায় পৌঁছান তখন আমেরিকায় বর্ণবাদ খুব প্রবল। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও সাদা চামড়ার অহং ঘোচেনি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলেও ব্ল্যাক আমেরিকান জেসিকে শ্বেতাঙ্গদের ক্যাম্পে থাকতে দেওয়া হতো না। অ্যাথলেটিক টিমের সঙ্গে কোথাও গেলে তাকে থাকতে হতো ‘ব্ল্যাক অনলি’ হোটেলে। খেতে হতো ‘ব্ল্যাক অনলি’ রেস্টুরেন্টে। কোনো বৃত্তিও পাননি। পড়াশোনার খরচ চালাতেন বাইরে কাজ করে। চুপিসারে পেছনের দরজা দিয়ে পাবলিক বাসে উঠে আলাদা সিটে বসতেন। ওয়েন্স এসব অপমানের শোধ তুলেছিলেন বার্লিনে। হিটলারের চোখের সামনে স্বর্ণপদক জিতে শ্বেতাঙ্গদের প্রত্যাঘাত করেছিলেন। সভ্যতাও শিখিয়েছিলেন।
Posted ২:৫৩ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২১ জুন ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh