ঢাকা : | বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১
আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি। পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবস। এই দিনে ঘটেছিল নৃশংস সেই ঘটনা। রক্তে ভেসে গিয়েছিল পিলখানা। পিলখানাজুড়ে গুলি, রক্ত ও লাশ। উত্তাপ ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা দেশে। আজকের দিনে বর্তমান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি (তৎকালীন নাম বিডিআর) সদর দপ্তরে ৫৭ জন কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। জিম্মি করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের। ১১ বছর আগের নির্মম, নৃশংস সেই ঘটনা এখনো কাঁদায় নিহতদের পরিবারের সদস্যদের। দিনটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে বিজিবি।
পিলখানায় নারকীয় হত্যার ঘটনায় দায়ের করা হয় দুটি মামলা। এর মধ্যে সেনা কর্মকর্তাদের নিহতের ঘটনায় করা হয় হত্যা মামলা। অপরটি হয় বিস্ফোরক আইনে। পিলখানা ট্র্যাজেডির বিষয়ে দায়ের করা হত্যা মামলায় ২০১৩ সালে ঢাকার আদালত ১৫২ বিডিআর জওয়ানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় ১৬১ জনকে। সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদÐসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পান আরো ২৫৬ জন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৮ জন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা। ২০১৭ সালে হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জওয়ানকে মৃত্যুদÐ প্রদান করেন। যাবজ্জীবন দেয়া হয় ১৮৫ জনকে। বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয় আরো ২০০ জনকে। খালাস পান ৪৫ জন। পিলখানা হত্যা মামলায় হাই কোর্টের রায়ের পর পেরিয়ে গেছে তিন বছর; কিন্তু চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য সর্বোচ্চ আদালতে এ বছরের মধ্যে আপিল শুনানি শুরু করা যাবে কি না, তা নিয়ে এখনও সংশয়ে আইনজীবীরা।এদিকে এক যুগ আগের ওই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার এখনও বিচারিক আদালতেই ঝুলে আছে।
সীমান্ত রক্ষী বাহিনীতে বিদ্রোহের মধ্যে পিলখানায় অর্ধ শতাধিক সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাÐের মামলার ২০১৭ সালে দেওয়া রায়ে হাই কোর্ট ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে এবং ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদÐ দেয়। তিন থেকে ১০ বছরের সাজা হয় ২২৮ জনের। আসামিদের মধ্যে ২০৩ জন আসামির পক্ষে এখন পর্যন্ত ৪৮টি আপিল ও লিভ টু আপিল দয়ের করা হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতে। অন্যদিকে হাই কোর্টের রায়ে যারা খালাস পেয়েছেন এবং মৃত্যুদÐাদেশের পরিবর্তে যাদের যাবজ্জীবন হয়েছে, সে রকম ৮৩ আসামির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদÐ চেয়ে ২০টি লিভটু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। সব মিলিয়ে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুই পক্ষের ৭১টি আপিল ও লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টি লিভ টু আপিল, অর্থাৎ আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন। আর ৩২টি সরাসরি আপিল।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন বলছেন, আপিল দায়ের সম্পন্ন হলে তারপর রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আপিল শুনানির জন্য আবেদন করা হবে। এ বছরের শেষ দিকে আপিল শুনানি শুরু হতে পারে বলে তিনি আশা করছেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম বলছেন, চলতি বছর আপিল শুনানি শুরু করা যাবে বলে তার মনে হচ্ছে না। ২০০৯ সালের ফেব্রæয়ারিতে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিডিআরে বিদ্রোহ দেখা দেয়। সে বিদ্রোহে সে বছরের ২৫ ফেব্রæয়ারি ঢাকার পিলখানায় বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহী জওয়ানদের হাতে মারা যান ৫৭ সেনা কর্মকর্তা।রক্তাক্ত সেই বিদ্রোহে বেসামরিক ব্যক্তিসহ মোট ৭৪ জন প্রাণ হারান। ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে জওয়ানদের বিদ্রোহ। সেই প্রেক্ষাপটে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর নাম পরে বদলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) রাখা হয়। বিডিআরে বিদ্রোহের ৫৭টি মামলার বিচার বাহিনীর নিজস্ব আদালতে শেষ হয়। সেখানে ছয় হাজার জওয়ানের কারাদÐ হয়। বিদ্রোহের বিচারের পর পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের মামলার বিচার শুরু হয় সাধারণ আদালতে। ঢাকার জজ আদালত ২০১৩ সালে দেওয়া রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। এছাড়া ২৫৬ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়।
এরপর হাই কোর্টের রায় হয় ২০১৭ সালে। সেখানে বলা হয়, ওই ঘটনা ছিল রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক-সামাজিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র। শুধু তাই নয়, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি দক্ষ, প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসেরও চেষ্টা। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলেও ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি তোলার খরচ, অনুলিপি পাওয়ার প্রক্রিয়া, আপিলের পেপারবুক তৈরি, আদালতে সেই পেপারবুক রাখার স্থান, চূড়ান্ত বিচারের সময়সহ বিচারিক প্রক্রিয়ার নানা কারণে আপিল শুনানি শুরু হতে দেরি হচ্ছে বলে আইনজীবীরা জানান। অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন বলেন, গত বছর ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ২০টি লিভ টু আপিল করেছেন। এর মধ্যে হাই কোর্টের রায়ে খালাস পাওয়া ৭৫ জনের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন পাওয়া ৮ জনের শাস্তি বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। “৮৩ আসামির ব্যাপারে এই ২০টি লিভ টু আপিল করতে আমাদের খরচ হয়েছে ২৭ লাখ টাকা। আমার মনে হয় সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় ফৌজদারি আপিল।” বিচারিক আদালতের রায়, হাই কোর্টের রায়, এফআইআর, অভিযোগপত্র মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার পৃষ্ঠার আপিল জমা দিতে হয়েছে বলে জানান রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা।
রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় বিশেষ বেঞ্চ গঠনের আবেদন করবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “নিয়মিত যে বেঞ্চ আছে সেখানেই এর বিচার হবে। সবগুলো ফাইল হলে শুনানির তারিখ নির্ধারণের জন্য আমরা যাব। “সুপ্রিম কোর্ট রুলস অনুযায়ী তারিখ নির্ধারণের জন্য আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করতে হয়। আমরা সে আবেদনটি তখন করব।” অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আমাদের প্রত্যাশা থাকবে হাই কোর্ট বিভাগ যে রায় দিয়েছে তা আপিলে বিভাগেও বহাল থাকবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়েছে হাই কোর্টের রায় ঠিক হয়নি, আমরা সেটি দেখাব। এই কারণে আপিল করা হয়েছে। আশা করি এ বছরের শেষের দিকে এর শুনানি শুরু হতে পারে।” থরে থরে সাজানো পিলখানা হত্যামামলার আপিলের পেপারবুক।থরে থরে সাজানো পিলখানা হত্যামামলার আপিলের পেপারবুক।অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রথম আপিল ফাইল করতে তাদের প্রায় ১৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সেখানে ৯ আসামির পক্ষে আপিল করা হয়েছে। “ওই আপিলটা ফাইল করার পর অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করেছিলাম। সেখানে আমরা বলেছিলাম পেপারবুক জমা দিয়ে প্রথম যে আপিলটা ফাইল করা হয়েছে, সেটি ব্যবহার করেই যেন বাকি আসামিরা আপিল ফাইল করতে পারেন। প্রধান বিচারপতি আমাদের আবেদনটা মঞ্জুর করেছেন। মঞ্জুর করার পর আবেদন জমা দিয়ে আপিল ফাইল করা হয়েছে। এটাকে ‘মেমো অব আপিল’ বলে।” এ আইনজীবী জানান, হাই কোর্ট যাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে এবং মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাদের যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে, তারা আপিল বিভাগে সরাসরি আপিল করতে পারবেন।
আর বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া যে আসামিদের দÐ হাই কোর্ট বহাল রেখেছে, তারা সরাসরি আপিল করতে পারবেন না। লিভ টু আপিল অর্থাৎ আপিলের অনুমতি চেয়ে প্রথমে আবেদন করতে হবে। আপিল বিভাগ সে আবেদন মঞ্জুর করলে তারা আপিল করতে পারবেন। ২০৩ জন আসামির পক্ষে যে ৪৮টি আপিল দায়ের করা হয়েছে, তার মধ্যে ৩০টি সরাসরি আপিল। বাকি ১৮টি লিভ টু আপিল। প্রথম আপিল দায়েরের পর বাকি ৪৭টি আপিল, লিভ টু আপিল দায়েরের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটির জন্য ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে লেগেছে বলে জানান আইনজীবী আমিনুল। সুপ্রিম কোর্ট রুলস অনুযায়ী হাই কোর্টের রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি সংগ্রহ করার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল দায়ের করতে হয়। সেই সময় বহু আগেই পেরিয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে যারা এখনও আপিল করেননি, তাদের আপিল করার সুযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে আমিনুল ইসলাম বলেন, বিলম্ব মার্জনার আবেদন করে তারা আপিল বা লিভটু আপিল ফাইল করতে পারবেন। এর পরের ধাপ জানিয়ে তিনি বলেন, “আপিল শুনানির ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকে প্রত্যেকটা আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিতে হবে। এখন যারা লিভ টু আপিল ফাইল করেছেন তাদের সেই লিভ টু আপিল গ্রহণ করলে তাদেরও সারসংক্ষেপ জমা দিতে হবে। তবে বাস্তবতার নিরিখে বলতে পারি, এই বছর আপিল শুনানি শুরু হবে বলে মনে হয় না।”
পিলখানায় বিদ্রোহের ঘটনা যেমন পুরো বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল, এক মামলায় এত আসামির সর্বোচ্চ সাজার আদেশও ছিল নজিরবিহীন। ওই ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার মধ্যে বিচারিক আদালত ও হাই কোর্টে হত্যা মামলার রায় হলেও ১২ বছরেও শেষ হয়নি বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলার বিচার। বিস্ফোরক আইনের মামলায় এক হাজার ১ হাজার ৩৪৫ জন সাক্ষীর মধ্যে এই ১১ বছরে নেওয়া হয়েছে মাত্র ১৪৬ জনের সাক্ষ্য। দুই মামলার আসামি হওয়ায় হত্যা মামলায় খালাস পেয়েও ২৭৮ জন মুক্তি পাননি।
Posted ৭:১২ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh