বিশেষ প্রতিবেদন : | শনিবার, ০৭ আগস্ট ২০২১
দেশের বাইরে প্রবাসী বাংলাদেশীদের রয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের কমিউনিটি। নিউইয়র্ক সহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য এবং শহরে যেখানে বাংলাদেশীদের বসবাস সেখানেই বাংলাদেশী আমেরিকান কমিউনিটির অস্থিত্ব বিদ্যমান। কিন্তু কমিউনিটির মূলমন্ত্র ‘কমন ইউনিটি’ নেই কোথাও। সর্বত্রই কি ছোট কি বড় প্রতিটি কমিউনিটিতেই লেগে আছে কলহ, কোন্দল, বিভাজন, হানাহানি, মামলা মোকদ্দমা।কমিউনিটি হলো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসরত একটি জনগোষ্ঠি, যাদের রয়েছে অভিন্ন স্বার্থ। আর এ স্বার্থ হতে পারে জাতীয়, ভৌগলিক, সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ভাষা ভিত্তিক।
আবার বিভিন্ন রাজ্য ও ছোট বড় শহরে বসবাসকারীদেরকে এলাকা ভিত্তিক কমিউনিটি হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। সে হিসেবে নিউইয়র্কের বাংলাদেশী আমেরিকান কমিউনিটিকে ক্ষুদ্রাকারে চিহ্নিত করতে গিয়ে বলা হয় জ্যামাইকা বা জ্যাকসন হাইটসে বসবাসকারী বাংলাদেশী কমিউনিটি। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী আমেরিকান কমিউনিটির কলেবর মোটেও ছোট নয়। ইতোমধ্যেই এর সদস্য সংখ্যা মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। শুধুমাত্র নিউইয়র্ক সিটিতেই বাংলাদেশী আমেরিকান কমিউনিটির সদস্য সংখ্যা তিন লক্ষাধিক। নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটির প্রায় শতভাগ মানুষের ভাষা বাংলা। সিংহভাগ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস এক। উপরন্তু এদের জাতীয় পরিচয় অভিন্ন।
পৌর বা সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় এমন একটি কমিউনিটির স্বার্থ ও উদ্দেশ্য হওয়ার কথা ছিলো এক ও অভিন্ন। পারস্পরিক সম্পর্ক, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের বন্ধন হবার কথা ছিলো দৃঢ়। কমিউনিটির বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থপরতা পরিহার করে একে দাঁড়াবে অপরের পাশে। নিজেদের অধিকার আদায় ও সংরক্ষণে কাজ করবে ঐক্যবদ্ধভাবে। জলাঞ্জলী দিবে নিজ স্বার্থ। কমিউনিটিকে গড়ে তুলবে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে। কিন্তু কার্যত তা হচ্ছে না। কিন্তু এই অভিন্ন স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার জন্য যে ধরণের ঐক্য ও কল্যাণধর্মী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও যোগ্য ত্যাগী নেতৃত্বের প্রয়োজন কমিউনিটিতে তা এখনো গড়ে উঠেনি। ফলে বাংলাদেশের জাতীয় অনুষ্ঠানাদি ঐক্যবদ্ধভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। অনৈক্যের কারণে একই দিনক্ষণে একই সংগঠন একাধিক অনুষ্ঠান আয়োজন করছে। এসব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত জনপ্রতিনিধি ও সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানালে তারা প্রায়শই বিব্রত বোধ করেন। তাছাড়া নিজেদের কমিউনিটির বিভক্তি ও দুর্বলতার দিকটাও তাদের নিকট স্পষ্ট হয়ে উঠে।
মহামারি করোনাকালে নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ধারণা করা হয়েছিলো নূতন স্বাভাবিকতায় পরিবর্তন আসবে মানুষের আচার আচরণ ও স্বভাব চরিত্রে। কমিউনিটিতে সহানুভূতির বাতাস বইবে। কিন্তু না তা হয়নি। কমিউনিটিতে আনন্দ উৎসবের মাত্রা আরো বেড়ে গেছে। মহামারিতে গোটা পৃথিবী বদলে গেলেও আমাদের মাঝে কোন পরিবর্তন আসেনি।
চরম নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে বাংলাদেশী কমিউনিটি। এ সংকট শুধু নিউইয়র্কে নয়। গোটা বাংলাদেশী আমেরিকান সমাজেই এর বিস্তার ঘটেছে। যোগ্য নেতৃত্ব হীনতার কারণে কমিউনিটির অভ্যন্তরীন সমস্যা নিরসনে ব্যর্থতার পাশাপাশি আমেরিকান রাজনীতির মূলধারায় বাংলাদেশীরা পারছে না নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে। অথচ বিশ্বের যেকোন অভিবাসী কমিউনিটির চেয়ে সংগঠন ও নেতৃত্ব প্রিয়তার দিক থেকে বাংলাদেশীরা এগিয়ে রয়েছে শতগুণ। নিউইয়র্কেই বাংলাদেশীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আঞ্চলিক, রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, পেশাজীবী, স্বেচ্ছাসেবীসহ সংগঠন আছে তিন শতাধিক। তারপরও প্রতিমাসেই নূতন দু’একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করছে কমিউনিটিতে। আবার প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলো মামুলি অভিযোগে ভেঙ্গে হচ্ছে খন্ড-বিখন্ড। নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বিভেদ-বিদ্বেষ, হাঙ্গামা, মামলা-মোকাদ্দমা। নেতৃত্বের লড়াই-কোন্দল, ব্যক্তিগত ইগো, রাজনৈতিক বিরোধ, আঞ্চলিকতা ও আর্থিক লেন-দেন সহ নানা কারণে সংগঠনগুলো ভেঙ্গে হচ্ছে খান খান। বাংলাদেশীদের দ্বারা পরিচালিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও লেগেছে বিভক্তির ঢেউ। অনেক মসজিদ, মন্দির, গির্জার পরিচালনা কমিটির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিয়ে চলছে মামলা-মোকদ্দমা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনে বিভক্তির মূল কারণ নেতৃত্ব।
বাংলাদেশে কোন সংগঠনে নেতৃত্ব লাভের ক্ষেত্রে এখনো যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার নূন্যতম বাছ-বিচার করা হয়। প্রবাসে পরিচিতি সঙ্কটের কারণে সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই রাতারাতি নেতা বনে যেতে চান। ফলে সংগঠনের কর্মকান্ডে সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতিকে বড় করে দেখে বিভেদ বিভক্তির পথে হাঁটতে শুরু করেন তারা। গড়ে তোলেন পাল্টা সংগঠন। আর এসব সংগঠনে শত সহস্র নেতার পদচারণা ঘটলেও যোগ্য নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কমিউনিটি। নূতন প্রজন্মের সাথে স্পষ্ট হচ্ছে ব্যবধান। কমিউনিটির শিক্ষিত, যোগ্য ব্যক্তিরাও এব্যাপারে থাকছেন নির্লিপ্ত। কমিউনিটিতে ঘটমান বিভিন্ন কর্মকান্ডের সিংহভাগই অমূলক ও অপ্রয়োজনীয়। এসব নিয়ে নূতন প্রজন্ম এবং সাধারণ প্রবাসীদের মাঝে নেই কোন আগ্রহ আবেদন। স্বদেশী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নূতন প্রজন্মের মাঝে উজ্জীবিত রাখার শ্লোগান বা দোহাই দিয়ে প্রায়শই আনন্দানুষ্ঠান হচ্ছে ঘটা করে। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানার ও ব্যক্তি উদ্যোগে আয়োজিত এসব অনুষ্ঠানে কমিউনিটির মুখচেনা কতিপয় ব্যক্তি ছাড়া সার্বজনীন কোন অংশগ্রহণ নেই।
নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটিতে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং তাদের কল্যাণ সাধনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ সোসাইটি। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হতে চললেও সংগঠনটি অদ্যাবধি পৌছতে পারেনি তার অভিস্ট লক্ষ্যে। যোগ্য নেতৃত্ব এবং সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করতে না পারায় বাংলাদেশ সোসাইটি আজ অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিশেষ করে সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মামলার জালে জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশ সোসাইটি। নিজের গাঁটের অর্থ ব্যয় করে ভোটার বানানোর অনৈতিক প্রক্রিয়া এবং তাদের ভোটে নেতৃত্ব লাভের বিষয়টি এখন আদালতে গড়িয়েছে।
কোথায় নেই বিভক্তি? সাংবাদিকদের রয়েছে একাধিক প্রেসক্লাব। পেশাজীবী চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন এবার দ্বিধাবিভক্তভাবে করেছে বার্ষিক সম্মেলন। উত্তর আমেরিকায় বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে ঐক্য, সম্প্রীতি ও সৌহাদ্য ধরে রাখার প্রত্যেয়ে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ফেডারেশন অব বাংলাদেশী এসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকা-ফোবানা এখন বিভক্তির কারণে ম্রিয়মান। প্রথম দিকে ফোবানার ব্যানারে বার কয়েক “বাংলাদেশ সম্মেলন” যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠিত হলেও নেতৃত্বের কোন্দলে সংগঠনটি এখন বহুধা বিভক্ত।
অপরদিকে আমেরিকান মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশী কমিউনিটি যতোটা না এগুতে পারছে তার চেয়ে বেশী পিছিয়ে পড়ছে। গত ২২ জুনের ডেমোক্র্যটিক প্রাইমারীতে বিভক্তির নুতন মাত্রা পরিলক্ষিত হয়েছে। কে ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান এটা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। বিবেচ্য বিষয় যারা ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান তারা কতোটা ঐক্যবদ্ধ থেকে নিজেদের কমিউনিটিকে মূলধারায় উপস্থাপন করতে পারছে। নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য বাংলাদেশী কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব কতোটা শক্তিশালী তা প্রমাণ করার জন্য সঠিক ও সময়োপযোগী কোন উদ্যোগ নেই। সিটি কাউন্সিল, স্টেট এ্যাসেম্বলী বা স্টেট সিনেট সহ স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচনে বাংলাদেশী কমিউনিটির কেউ কেউ প্রার্থীও হচ্ছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় হোম ওয়ার্ক বা নিজের যোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনায় না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করার বিষয়টি খেলো হয়ে যাচ্ছে। অনেকে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে গিয়ে ঔষধি বৃক্ষের মতো একবার নির্বাচনে অংশ নিয়েই ঝরে পড়ছেন রাজনীতির ময়দান থেকে। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে কেউ একজন প্রার্থী হলে তার বিপরীতে চলে যাচ্ছেন আরেকজন।
রাজনীতিতে প্রার্থী নির্বাচনের বিষয়টি অবশ্যই একান্ত নিজস্ব। তারপরও বাংলাদেশী কমিউনিটির বৃহত্তর স্বার্থে সবাই মিলে একজন যোগ্য প্রার্থী বাছাই করে তাকে সামনের দিকে এগিয়ে দিলে জয়লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। কমিউনিটি সতর্ক ও সচেতন হলে অবশ্যই এর মধ্য থেকেই আরো প্রতিভান যোগ্য নেতৃত্ব বেড়িয়ে আসবে। এখন বাংলাদেশী কমিউনিটিতে নেতৃত্বের যে সংকট বিরাজ করছে এ সংকট কাটিয়ে উঠতে কাউকে না কাউকে কোথাও না কোথাও কিছুটা ছাড় দিতে হবে। কমিউনিটির সব পর্যায়ে যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিতে হবে একটি সুন্দর ও সম্ভাবনাময় কমিউনিটি এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থেই।
Posted ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৭ আগস্ট ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh