মিজানুর রহমান পলাশ | রবিবার, ২১ জুন ২০২০
মেজর জেনারেল পদে ডা. সুসানে গীতিকে র্যাঙ্ক ব্যাজ পরিয়ে দেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. সামছুল হক। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) তথ্য মতে, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী মেজর জেনারেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নে যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন সেনাবাহিনীতে নারী অফিসারকে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি প্রদানের মাধ্যমে সেই পদক্ষেপের আরও একটি নতুন দিগন্তের সূচনা হলো।
ডা. সুসানে গীতি ১৯৮৫ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নারী চিকিৎসক হিসেবে ক্যাপ্টেন পদে যোগ দেন। তিনি ১৯৯৬ সালে প্রথম নারী হিসেবে হেমাটোলজিতে এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশন এবং বিভিন্ন সামরিক হাসপাতালে প্যাথলজি বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত।
নারী ট্রেন চালকের কর্মক্ষেত্রে যোগদান রেলের দীর্ঘ ইতিহাসে খুব বেশি দিনের নয়। এশিয়ার প্রথম নারী ট্রেন চালক ভারতের মুমতাজ, ১৯৮৯ সালে। বাংলাদেশ রেলওয়েতে সালমা খাতুন প্রথম নারী ট্রেন চালক হিসেবে এর ২৫ বছর পর যুক্ত হন। এ দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে নরসিংদীর মেয়ে সালমা বেগম, নড়াইলের লোহাগড়ার মেয়ে কৃষ্ণা, কুমিল্লার মেয়ে রেহানা আবেদিন, দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মেয়ে নাছরিন আক্তার, চট্টগ্রামের মেয়ে উম্মে সালমাসহ আরও প্রায় ১৫ জন নারী ট্রেন চালক হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়েতে যুক্ত আছেন। তারা প্রত্যেকে চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে ট্রেন চালানোকে দারুণ উপভোগ করছেন। আরও কয়েক নারী বাংলাদেশ রেলওয়েতে ট্রেন চালক হিসেবে যুক্ত হবেন। বাংলাদেশে নারীদের ট্রেন চালকের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় আসার মূল অনুপ্রেরণাকারী কিন্তু সালমা খাতুন।
বর্তমানে নারীরা অফিস-বাসা সবক্ষেত্রেই সমান পারদর্শী। অন্যান্য চ্যালেঞ্জিং পেশায়ও বর্তমানে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। জিডি পাইলট পেশায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে ২০১৪ সালে প্রথম সামরিক নারী বৈমানিক তামান্না-ই-লুৎফী ‘বেল-২০৬’ হেলিকপ্টারে সফলভাবে একক উড্ডয়নের সক্ষমতা অর্জন করেন। নারীর অগ্রযাত্রায় তার এ সাফল্য সমগ্র দেশ ও জাতির জন্য এক নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সশস্ত্র বাহিনীতে নারী কর্মকর্তা নিয়োগের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে প্রথমবারের মতো (জিডি পাইলট) নারী বৈমানিক নিয়োগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার উড্ডয়ন করে দু’জন নারী বৈমানিক ফ্লাইং অফিসার নাইমা হক ও পাইলট অফিসার তামান্না-ই-লুৎফী। ২০১৪ সালে বাণিজ্যিক জাহাজে নারী নাবিক হিসেবে ১৩ জন প্রথম যোগদান করেন। সশস্ত্র বাহিনীতে বিভিন্ন শাখায় প্রায় এক হাজার নারী কর্মকর্তা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন।
চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশের নারী সদস্যরা মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে নিজস্ব স্থান দখল করে নিয়েছেন। একসময় এ পেশায় নারীরা আসতে চাইত না, এখন সময় পাল্টেছে। নারী হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে প্রথম অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করেছেন রৌশন আরা বেগম। তিনি রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) প্রাপ্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি প্রথম নারী পুলিশ সুপার হিসেবে মুন্সীগঞ্জ জেলায় দায়িত্ব পালন করেন। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা যায়, পুলিশে নারী পুলিশের অভিষেক ১৯৭৪ সালে। মাত্র সাতজন এসআই আর সাতজন কনস্টেবল নিয়ে এর যাত্রা শুরু হলেও আজ পুলিশ বাহিনীতে ১৩ হাজার ৩৯১ জন নারী সদস্য বিভিন্ন শাখায় রয়েছেন। পুলিশ সদর দফতরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন নারী পুলিশ। ডিএমপিসহ পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থেকে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদায় অসংখ্য নারী। শান্তি রক্ষা মিশনেও পুলিশের নারী সদস্যরা মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে নিজস্ব স্থান করে নিয়েছেন। নারী সদস্যরা যেভাবে এগিয়েছে তাতে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না যেদিন দেশের পুলিশ প্রধান (আইজিপি) হবেন একজন নারী। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পুরুষের পাশাপাশি এগিয়ে আছেন নারীরা। পুলিশ বাহিনীতে নারী সার্জেন্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু ২০১৪ সালে ৮ জন নারী সার্জেন্ট নিয়োগের মধ্য দিয়ে। চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে সাংবাদিকতায়ও নারীরা দক্ষতার সঙ্গে সংবাদ কাভার করে মিডিয়ায় সংবাদ ও তথ্যপ্রবাহ জনগণের সামনে নিয়ে আসছে। নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ নূরজাহান বেগমের হাত ধরে মূলত বাঙালি নারীদের সাংবাদিকতা জগতে প্রবেশ। বর্তমানে মোট নারী সাংবাদিকের সংখ্যা ৩১০ জন, যা মোট সাংবাদিকের ১৩ শতাংশ। এক যুগ আগের এ সংখ্যা ছিল হাতে গোনা দু-একজন। একসময় আইন পেশায় নারীরা আসতই না কিন্তু এখন বিভিন্ন বারে দেখা যায় নারীদের সংখ্যা অনেক এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক এখন নারী।
জীবনের তাগিদে, নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিতের সুফল হিসেবে নারীরা রাইড শেয়ারিংয়ের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশা বেছে নিচ্ছেন। অনেক নারী চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে রাইড শেয়ারিং করে বাড়তি উপার্জন করছে। বেছে নিচ্ছে বাড়তি আয়ের পথ। শিক্ষকতা, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পদে ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নারীর অংশগ্রহণ পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা সফলতার সঙ্গে এসব সেক্টরে নিজেদের মেধা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, মোট সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে ২৭ শতাংশ নারী। ২০১২ সালে ছিল ২১ শতাংশ। একাদশ জাতীয় সংসদে সরাসরি নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য সংখ্যা ২২ জন এবং সংরক্ষিত আসনে ৫০ জন নারী। মোট ৭২ জন নারী সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে। কর্মক্ষেত্রে নারীরা এখনও সমস্যার কিছু সম্মুখীন হচ্ছেন তাবে তা পূর্বের তুলনায় অনেক কম। পুরোপুরি এ সমস্যার সমাধন করতে হলে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। কর্মজীবী নারীদের চিন্তার বড় একটি বিষয় হচ্ছে অফিসে থাকা অবস্থায় সন্তানদের দেখাশোনার ব্যাপারটি। দিন দিন চাকরিজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে সরকারিভাবে বিভাগীয় শহর এমনকি জেলা শহরগুলোতেও ডে-কেয়ার স্থাপন করা হচ্ছে। হাসপাতাল এবং অফিসগুলোতে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। কিছু প্রতিকূলতা তো থাকবেই। তার মধ্য দিয়েও নারী বিশ্ব দরবারে তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে বারবার। নারীর চোখে আজ সমুদ্র জয়ের স্বপ্ন। নারীর চোখে আজ মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন। প্রথম নারী হিসেবে বাংলাদেশের নিশাত মজুমদার এভারেস্ট জয়ের স্বপ্নও পূরণ করেছেন। নারী অগ্রদূতের প্রতীক বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, নারী কোন জড়ো বস্তু নয় যে বাক্স বন্দী করে রাখতে হবে।
তারাও মানুষ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার, সংসদ উপনেতার দায়িত্বেও নারীরা সমাসীন। এই সরকারের সময়েই সুপ্রিম কোর্টে বিচারক হিসেবে এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নারীদের দায়িত্ব পালন শুরু হয়। নারীর ক্ষমতায়নের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, তা অব্যাহত থাকবেই। জীবন ও পেশায় নারীর এ আত্মবিশ্বাসী অংশীদারিত্ব যেমন অন্য নারীকে উদ্দীপ্ত ও প্রত্যয়ী করে তুলবে তেমনি তার এ নিজস্ব অবদান দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সমৃদ্ধির পথে, অগ্রগতির পথে।
Posted ৯:১৭ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২১ জুন ২০২০
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh