বাংলাদেশ রিপোর্ট : | বৃহস্পতিবার, ০৭ জানুয়ারি ২০২১
অস্ত্রধারী ট্রাম্প সমর্থকরা ক্যাপিটল হিল দখল করে।
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিজয়কে প্রতিহত করার সকল চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গতকাল ৬ জানুয়ারী বুধবার ইলেক্টোরাল ভোটের সার্টিফিকেশনের দিনে তার সমর্থকদের দিয়ে নজীরবিহীন নাশকতা চালিয়ে ক্যাপিটল হিল দখল করে। ট্রাম্পের উস্কানিতে তাদের সন্ত্রাসে কংগ্রেসের সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যা ৬ টায় কারফিউ বলবৎ করার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন শুরু হয় রাত ৮টায়। শুরুতেই বক্তব্য রাখেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এবং সিনেটের রিপাবলিকান মেজরিটি লিডার ম্যাককনেল মিচ ও ডেমোক্র্যাট দলীয় সিনেট লিডার চাক শুমার। তাদের বক্তব্যের পর পুণরায় ইলেক্ট্রোরাল ভোট গণনা শুরু হয়। নেতৃবৃন্দ ক্যাপিটল হিলের এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সংবিধান সমুন্নত রাখার প্রতিশ্রুতি দেন।
এবং ট্রাম্পের সমালোচনা করে তার শাস্তি দাবি করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কোন রাজনৈতিক দলের বিক্ষোভকারীদের দ্বারা এভাবে রাজধানী ওয়াশিংটনে ক্যাপিটল হিল খ্যাত কংগ্রেস ভবন দখল, ভাংচুর বা তছনছ করার ঘটনা ঘটেনি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গতকাল বিকেলে “স্টপ দ্য স্টিল” (চুরি বন্ধ করো) নামে এক সমাবেশে তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেয়ার এক ঘন্টা পর তারা উচ্ছৃংখলতা প্রদর্শন করে ক্যাপিটল হিলে প্রবেশ করে। ওই সময় কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানরা জো বাইডেনের প্রেসিডেন্ট পদে সার্টিফিকেশন দেয়ার আগে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। ট্রাম্প সমর্থকদের তান্ডবে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন স্থগিত করতে হয়। কংগ্রেসম্যানরা, যে য়েখানে পারেন আশ্রয় নেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, যিনি পদাধিকারবলে সিনেটের চেয়ারম্যান এবং যৌথ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছিলেন, ইউএস সিক্রেট সার্ভিসের সদস্যরা তাকে ক্যাপিটল হিল থেকে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে নেয়। হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি এবং নবনির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিসকেও নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়। বিপদের আশংকায় কংগ্রেসম্যানদের কাছে সরবরাহ করা হয় গ্যাস মাস্ক ।
এই তান্ডবের সময় কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা গেছে এবং ক্যাপিটলের হিলের অভ্যন্তরে এক নারী বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। আর বাকি তিনজন মারাত্মক আহত হওয়ার পর মারা যান বলে খবর পাওয়া গেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিলম্বিত উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিকেল চারটার পর টেলিভিশনে আবির্ভূত হয়ে তার সমর্থকদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার আহবান জানান। তিনি বলেন, ‘যারা ইউএস ক্যাপিটলে গেছেন তাদের আমি সকলকে আহবান জানাচ্ছি শান্ত থাকার জন্য। কোন সহিংসতা নয়, মনে রাখবেন, আমরা আইন-শৃংখলার দল। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন।” এর আগে বিকেলে তিনি তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেন যে আমরা কিছুতেই নির্বাচনী ফলাফল মেনে নেব না। ওয়াশিংটন ডিসির মেয়র সন্ধ্যা ছয়টা থেকে বৃস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সেখানে কারফিউ এর ঘোষণা দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান হয়েছে যে, ইতোমধ্যে ওয়াশিংটন ডিসিতে ন্যাশনাল গার্ডের ১,১০০ সদস্যকে মোতায়েন করা হয়েছে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য। ডিসি’র মেয়র মরিয়েল ব্রাউজার এর অনুরোধে এসব ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদেরকে ডিসি আরমোরি থেকে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রয়োজনে ন্যাশনাল গার্ডের আরো সদস্য পাঠানো হতে পারে বলে আভাস দেয়া হয়েছে। পেন্টাগনের প্রধান মুখপাত্র জনাথন হফম্যান বলেছেন, ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়েছে, যারা জাষ্টিস ডিপার্টমেন্টের অধীনে তাদের দায়িত্ব পালন করবে।
তাদেরকে ফেডারেল আইন প্রয়োগকারীদের সহযোগিতার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। তার কথায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, টাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটল হিল দখল ও বিশৃংখলা সৃষ্টির ঘটনায় পেন্টাগন সরাসরি সেনা মোতায়েন করতে অনিচ্ছুক বলেই ন্যাশনাল গার্ডকে পাঠানো হয়েছে। পেন্টাগন চায় যে ওয়াশিংটন ডিসির স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পুলিশ এবং অন্যান্য বেসামরিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ক্যাপিটল হিলে উদ্ভুত পরিস্থিতি দমনে কাজে নিয়োগ করুক এবং তারা তাদের সহায়তার জন্য ন্যাশনাল গার্ডকে পাশে পাবে। কিন্তু ন্যাশনাল গার্ড পুরো পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব গ্রহণ করবে না বা মুখ্য ভূীমকা পালন করবে না।
চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে ও সন্ত্রাসের আশঙ্কায় ক্যাপিটল হিল থেকে কংগ্রেসম্যানদের সরিয়ে নেয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে আমেরিকান গণতন্ত্রের মূল চেতনা বিনষ্ট হয়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তিভূমি হিসেবে বিবেচিত আমেরিকার রাজধানীকে কংগ্রেসের অধিবেশন চলাকালে বিক্ষোভকারীদের প্রবেশ ও অধিবেশন বন্ধ করে দেয়ার ঘটনার পাশাপাশি এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধিবেশনে ভবন ঘিরে নিরাপত্তার কঠোরতা না থাকা, এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে মর্মে পর্যাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য না থাকায় পুরো ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা শুরু হয়েছে এরই মধ্যে। বেলা সোয়া দুইটার সময় হাউজ ও সিনেট যৌথ অধিবেশনে বক্তৃতা শুরু করার কিছু সময় পর ট্রাম্প সমর্থক একদল বিক্ষোভকারী ক্যাপিটল হিলে প্রবেশ করে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেয়ার পক্ষে শ্লোগান উচ্চারণ করতে থাকে। তাদের অনেকের হাতে ট্রাম্প লেখা ব্যানার ও পতাকা ছিল। নিরাপত্তা রক্ষীরা বিক্ষোভকারীদের প্রবেশ ঠেকাতে কোন কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া দলে দলে বিক্ষোভকারী ভেতরে প্রবেশ করে। তারা অনেক কাচ ভেঙে ফেলে, ছাদে আরোহণের জন্য মই বহন করে এবং বিক্ষোভের এক পর্যায়ে মই বেয়ে কয়েকজনকে নিচে নামতেও দেখা যায়। কিছু সময়ের জন্য সিনেটর ও হাউজ মেম্বাররা চেম্বার কক্ষে আটকা ছিলেন। চেম্বার কক্ষে প্রবেশের জন্য বিক্ষোভকারীরা নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে ঠেলাধাক্কায় লিপ্ত হয় এবং অন্তত একজন ট্রাম্প সমর্থককে হাউজ চেম্বারে স্পিকারের আসনের কাছে গিয়ে ট্রাম্পের পক্ষে তার সমর্থনের ঘোষণা দিতে দেখা গেছে।
ট্রাম্প সমর্থকরা নিরাপত্তা বলয় ভেঙে ক্যাপিটল হিলে প্রবেশের আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউজের দক্ষিণে এলিপসে উস্কানিমূলক বক্তব্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের প্রতি আহবান জানান ইলেক্টোরাল ভোট পাল্টে দেয়ার ব্যবস্থা করতে। সাংবিধানিকভাবে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ইলেক্টোরাল ভোটে সাটিফাই করার প্রক্রিয়া নজরদারির করার জন্য দায়িত্বশীল। ট্রাম্প তার বক্তৃতায় বলেন, ‘আমি আশা করি মাইক সঠিক কাজটিই করতে যাচ্ছেন। আমি তাই আশা করি। কারণ মাইক পেন্স যদি সঠিক কাজ করেন তাহলে আমরা নির্বাচনে জিতে যাব।” তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশের একজন শীর্ষ সাংবিধানিক আইনজীবী আমাকে বলেছেন যে, মি: পেন্সের নিরঙ্কুশ অধিকার রয়েছে নির্বাচনের ফলাফল ছুঁড়ে ফেলা র ।”
কিন্তু ট্রাম্প যতই উস্কানি দেন না কেন, নির্বাচনের ফলাফল এত সহজে পাল্টে দেয়ার কোন উপায় নেই এবং ট্রাম্প যা দাবী করছিলেন তার কোন দৃষ্টান্তও নেই যে ভাইস পেসিডেন্টের পক্ষে অলৌকিক কিছু করা সম্ভব। কিন্তু ট্রাম্প বলে আসছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর চেয়ে বাজে নির্বাচন হযেছে। অতএব নির্বাচনের ফলাফলে তাকেই বিজয়ী হতে হবে। কিন্তু বুধবার বিকেলে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এক সাহসী বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাপে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কংগ্রেসনাল সার্টিফিকেশনের পথে বাধা সৃষ্টিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন যে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তার একক কর্তৃত্ব বা এখতিয়ার নেই। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, কংগ্রেসে কিংবা বাইরে এ ধরনের বিশৃঙ্খলায় বাইডেনের জয় ঘোষণা কিছুটা বিলম্বিত হবে, ফলে কোনো পরিবর্তন হবে না। এই ষড়যন্ত্র ২০ জানুয়ারি বাইডেনের শপথ আটকাতে পারবে না। তবে এটি মার্কিন গণতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগের। শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে গণতান্ত্রিক বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের গর্ব করার মতো যে ঐতিহ্য ছিল তা হুমকিতে পড়েছে। একই সঙ্গে ঝুঁকিতে পড়েছে গণতান্ত্রিক বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বও।
Posted ৮:৫৪ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৭ জানুয়ারি ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh