জাফর আহমাদ : | বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪
হাকীম ইবনে হিযাম রা: হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সা: এর কাছে কিছু চাইলাম। তিনি আমাকে দিলেন। আমি তাঁর কাছে আবার চাইলাম। তিনি আমাকে দিলেন। আমি তাঁর কাছে আবার চাইলাম। তিনি আমাকে দিলেন। এরপর বললেন: এ ধন-সম্পদ সুফইয়ানের বর্ণনামতে নবী সা: বললেন: হে হাকীম! এ মাল সবুজ ও সুমিষ্ট। যে লোক তা খুশি মনে গ্রহণ করবে, তার জন্য তাতে বরকত দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি তা লালসা নিয়ে গ্রহণ করবে,তার জন্য তাতে বরকত দেয়া হবে না। বরং সে ঔ ব্যক্তির মত যে খায়, কিন্তু তৃপ্ত না। আর উপরের(দাতার) হাত নিচের(গ্রহীতার) হাত থেকে শ্রেষ্ট।(বুখারী: ৬৪৪১,১৪৭২, কিতাবুর রিকাক, বাবু কাউলিন নাবী সা:… পরিচ্ছদ: নবী সা: এর বাণী: এ সম্পদ সবুজ ও সুমিষ্ট। আল্লাহ তা’আলার বাণী: মানুষের কাছে সুশোভিত করা হয়েছে নারী, সন্তান, স্তুপীকৃত স্বর্ণ ও রোপ্যভান্ডার, চিহ্নযুক্ত অম্বরাজি, গৃহপালিত পশু এবং শস্যক্ষেত্র, এসব পার্থিব জীবনের সম্পদ।(সুরা আলে ইমারান:১৪) উমার রা: বলেন, হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য যেসব জিনিস মনোহর করে দিয়েছেন, তজ্জন্য খুশি না হয়ে পারি না। হে আল্লাহ! অবশ্যই অমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি, যেন আমি এগুলোকে সঠিকভাবে ব্যয় করতে পারি।
আ: প্র: ৫৯৯১, ইফা:৫৯৯৭)
আনাস ইবনে মালিক রা: হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সা: বলেন: যদি বনী আদমের স্বর্ণ ভরা একটা উপত্যকা থাকে, তথাপি সে তার জন্য দুটি উপত্যকা হওয়ার কামনা করবে। তার মুখ মাটি ব্যতিত অন্য কিছুতেই ভরবে না। তবে যে ব্যক্তি তওবা করবে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন।(বুখারী: ৬৪৩৯, কিতাবুর রিকাক, বাবু মা ইউত্তাকা মিন ফিতনাতিল মালি, আধু;প্র:৫৯৯০, ইফা:৫৯৯৬)
ইবনে আব্বাস রা: বলেন। আমি নবী সা: কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন: বনী আদমের জন্য যদি এ উপত্যকা পরিমাণ ধনমাল থাকে, তবু সে আরো ঐ পরিমান সম্পদের জন্য লালায়িত থাকবে। বনী আদমের চোখ মাটি ছাড়া আর কিছুতেই ভরবে না। তবে যে তওবা করবে আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন।
ইবনে আব্বাস রা: বলেন, সুতরাং আমি জানি না-এটি কুরআনের অন্তর্গত কি না। তিনি বলেন, আমি ইবনে যুবাইরকে এটা মিম্বরের উপর বলতে শুনেছি।(বুখারী: ৬৪৩৭, ৬৪৩৬ কিতাবুর রিকাক, বাবু মা ইউত্তাকা মিন ফিতনাতিল মালি, আধু.প্র:৫৯৮৮, ইফা:৫৯৯৪)
আব্বাস ইবনে সাহল ইবনে সাদ রা: থেকে বর্ণনা করেন। আমি ইবনে যুবায়র রা: কে মক্কায় মিম্বরের উপর তার খুতবার মধ্যে বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন: হে লোকেরা! নবী সা: বলতেন, যদি বনী আদমকে স্বর্ণে ভরা এক উপত্যকা মাল দেয়া হয়, তথাপিও সে দ্বিতীয়টার জন্য লালায়িত হয়ে থাকবে। আর তাকে দ্বিতীয়টি যদি দেয়া হয়, তাহলে সে তৃতীয়টার জন্য লালায়িত থাকবে। বনী আদমের পেট মাটি ছাড়া ভরতে পারে না। তবে যে তওবা করবে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন।(বুখারী:৬৪৩৮,কিতাবুর রিকাক, বাবু মা ইউত্তাকা মিন ফিতনাতিল মালি, আধু.প্র:৫৯৮৯, ইফা:৫৯৯৫)
একই অধ্যায়ের চারটি হাদীস উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে এই যে, বনী আদমের তিনটি অঙ্গ যথা: চোখ, মুখ ও পেটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ তিনটিই হচ্ছে পৃথিবীকে ভোগ করতে গিয়ে মানুষ ধোঁকায় পড়ার মাধ্যম। কাজেই আদম সন্তানকে এ তিনটি অঙ্গের ব্যাপাওে খুবই সতর্ক থাকতে হবে।
লালসা কোন মু’মিন-মুসলমান তো দুরের কথা সাধারণ কোন মানুষেরও বৈশিষ্ট্য বা স্বভাব হতে পারে না।,বরং এটি নিকৃষ্ট এক জীব কুকুরের বৈশিষ্ট্য। মানুষের মধ্যে যারা প্রবৃত্তির লালসার সামনে নতজানু হয় এবং প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়, এ ধরণের লোভী লালসার অধিকারী লোকদেরকে আল্লাহ তা’আলা অত্যন্ত ঘৃণিত প্রাণীর সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“আমি চাইলে ঐ আয়াতগুলোর সাহায্যে তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করতাম কিন্তু সে তো দুনিয়ার প্রতিই ঝুঁকে রইল এবং নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করলো। কাজেই তার অবস্থা হয়ে গেলো কুকুরের মতো, তার ওপর আক্রমণ করলেও সে জিভ ঝুলিয়ে রাখে আর আক্রমণ না করলেও জিভ ঝুলিয়ে রাখে। যারা আমার আয়াতকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে তাদের দৃষ্টান্ত এটাই। তুমি এ কাহিনী তাদেরকে শুনাতে থাকো, হয়তো তারা কিছু চিন্তা-ভাবনা করবে।”(আরাফ-১৭৬)
কুকুর হলো, উগ্র লালসা ও অতৃপ্ত কামনার এক প্রাণী। তার এই লালসা ও কামনার জন্য জিভটি সর্বদা ঝুলে থাকে এবং এ ঝুলন্ত জিভ থেকে অনবরত লালসার লালা টপকে পড়তে থাকে। চলাফেরার পথে তার নাক সব সময় মাটি শুকতে থাকে, হয়তো কোথাও কোন খাবারের গন্ধ পাওয়া যাবে এ আশায়। তার গায়ে কেউ কোন পাথর ছুঁড়ে মারলেও তার ভূল ভাঙ্গবে না। বরং তার মনে সন্দেহ জাগে, যে জিনিষটি তাকে মারা হয়েছে সেটি হয়তো কোন হাড় বা রুটির টুকরা হবে।
পেট পূজারী লোভী কুকুর একবার লাফিয়ে দৌড়ে গিয়ে সেই নিক্ষিপ্ত পাথরটিও কামড়ে ধরে। পথিক তার দিকে দৃষ্টি না দিলেও দেখা যাবে সে লোভ-লালসার প্রতিমূর্তি হয়ে বিরাট আশায় বুক বেঁধে জিভ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে হাপাচ্ছে। সে তার পেটের দৃষ্টি দিয়ে সারা দুনিয়াকে দেখে। কোথাও যদি কোন বড় ধরণের মরা গরু পড়ে থাকে, কয়েকটি কুকুরের পেট ভরার জন্য সেটি যতেষ্ট হলেও একটি কুকুর তার মধ্যে থেকে কেবলমাত্র তার নিজের অংশটি নিয়েও ক্ষান্ত হবে না বরং সেই সম্পূর্ণ লাশটি নিজের একার জন্যে আগলে রাখার চেষ্টা করবে এবং অন্য কাউকে তাঁর ধারে কাছেও ঘেষতে দেবে না। শূকণ বা অন্য যে কোন প্রাণী কাছে এলে, সেগুলোর প্রতি সে তেড়ে যায়।
পেটের লালসার পর যদি দ্বিতীয় কোন বস্তু তার ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে তাহলে সেটি হচ্ছে যৌন লালসা। সারা শরীরের মধ্যে কেবলমাত্র লজ্জাস্থানটিই তার কাছে আকর্ষনীয় এবং সেটিরই সে ঘ্রান নিতে ও তাকেই চাটতে থাকে। কাজেই এখানে এ উপমা দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ কথাটি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা যে, দুনিয়া পূজারী ব্যক্তি যখন জ্ঞান ও ঈমানের বাঁধন ছিড়ে ফেলে প্রবৃত্তির অন্ধ লালসার কাছে আত্মসমর্পন করে এগিয়ে চলতে থাকে তার অবস্থা পেট ও যৌনাংগ সর্বস্ব কুকুরের মত হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
আমাদের সামনে দুরের ও কাছের অসংখ্য উদাহরণ বিদ্যমান রয়েছে। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর ছোট্ট এই দেশটির উগ্র লালসার প্রাণীগুলোর লুটপাট দেখেছেন। ইদানিং এদের অতৃপ্ত মনোবাসনার আচরণও দেখেছেন। এদের একজন বিদেশে ৩৬০টি বাড়ী ক্রয় করেও পরিতৃপ্ত নয়। কানাডার বেগম পাড়া, আমেরিকার অভিজাত এলাকায় ফ্লাট, সিঙ্গাপুরের বহুতল বাণিজ্যিক ভবন, সুইস ব্যাংকে পাহাড় পরিমাণ জমাস্থিতি, আমেরিকায় হাজার হাজার কোটির ডলার, দুবাইয়ে আলীসান বাড়ী-ঘর এর পরও এরা তুপ্ত নয়। আরো আরো অধিকতর লুটপাটের সুবিধার জন্য সাধারণ মানুষের ওপর তাদের দমন-পীড়নের নিষ্ঠুরতাও দেখেছেন। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ইতিহাসে কালো অধ্যায়ে স্থান পাবে। এখানে লক্ষ্য করেছেন সরকার দলীয় নেতা, নেত্রী, প্রশাসনের আমলা, পুলিশ ও বিভিন্ন বিভাগের পিয়ন থেকে নিয়ে সর্বোচ্চ ব্যক্তির দুর্নীতি। যা সিনেমাটিক গল্প কাহিনীকেও হার মানায়। সম্পদ আহরনের একেক জনের প্রকাশিত ধারাবাহিক সিরিজ দেখে শরীরে শিহরন সৃষ্টি করে। এদের মধ্যে একজন যেমন এমন আছেন যে, এয়াতিম শিশুদের জন্য দৈনন্দিন বরাদ্দকৃত খাদ্যটুকু মেরে দিয়ে পঁচা ও বাসিযুক্ত খাবার পরিবেশন করতো। তেমনি এমনও ছিল যে, পাবলিক টয়লেট ধুয়ে মুছে রাখা ব্যক্তি যেই ৫/১০ টাকা প্রতি ব্যবহারকারী থেকে আদায় করতো, সে ব্যক্তি তার এই ব্যবসা ধরে রাখার জন্য স্থানীয় নেতা বা পাতি নেতাকে ভাগ দিকে হতো।
এই সমস্ত নিকৃষ্ট কীটদের অবস্থা ঠিক সেই তীব্র লালসার নিকৃষ্ট জীবটির মত হয়ে পড়েছিল। ককুরের লোভের জিভটি যেমনভাবে সবসময় ঝুলে থাকে এবং ঝুলন্ত জীভ থেকে অনবরত লালসার লালা টপকে পড়তে থাকে। এদেরও উগ্র লালসার আগুন ও অতুপ্ত কামনার কারণে সাধারণ মানুষ সবসময় চরম যন্ত্রনা পোহাতে হয়েছে। একেবারেই নূন্যতম মানবিক বিবেক যদি থাকতো তাহলে এমনটি হতো না।
কিন্তু নূন্যতম মানবিক সেই মূল্যবোধটুকুও তার উগ্র লালসার কাছে পরাজিত হয়েছে। পেট পূজারী লোভী জীবটির মতো এ সমস্ত লুটেরাগুলো পেটের দৃষ্টি দিয়ে সারা দুনিয়াকে দেখে। তার কাছে মানুষের কষ্ট ও দেশের ধ্বংস একান্তই বৃথা। কারণ এরা লোভ-লালসার প্রতিমূর্তিতে পরিণত হয়। এ জন্য ভালো কি মন্দ, সর্বাবস্থায়, সব জায়গায় এবং সব সময় তারা লুট করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। তার এই অত্যাধিক লোভের কারণে কত শত মানুষ কষ্টের শিকার হলো, কি পরিমাণ সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি হলো এবং দেশের অর্থনীতির ওপর কি পরিমাণ বিরূপ প্রভাব পড়লো এগুলো চিন্তা করা এদের স্বভাব সিদ্ধ নয়। দেশ গোল্লায় গেলেও তাদেরকে লুট করতেই হবে। তারা এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে যে, অনেক শক্তিশালী সরকারকেও তাদের কাছে অসহায়ত্ব বরণ বা আত্মসমর্পণ করতে দেখা যায়। তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস তাদের ছিল না। কারণ এরা ছিল ন্যাড়া ককুরের মতো। ঐ সমস্ত কুকুরদের উচ্ছিট্য এরা ভোগ করতো।
অতিরিক্ত লোভ ও লালসা মানুষকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। এতে আল্লাহর বরকত থাকে না বিধায় সে এক পাহাড় সম্পদেও তুষ্ট হয় না। এক সময় ধ্বংসই তার অনিবার্য পরিণতি হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং অতিরিক্ত লোভ-লালসা পরিহার করে বেশী বেশী তাওবা করুন এবং আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের সীমারেখায় প্রবেশ করুন আপনার সামান্য যা আছে তাতেই বরকত লাভ করবেন। জীবন স্বার্থকতায় ভরে উঠবে।
Posted ১২:২৯ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh