জাফর আহমাদ | শুক্রবার, ০১ জুলাই ২০২২
আশা নবীদের বৈশিষ্ট্য, হতাশা বা নিরাশা শয়তানের বৈশিষ্টৗ। আশা আল্লাহর রহমত, নিরাশা ধ্বংস ডেকে আনে। আশাবাদী আল্লাহর রহমত প্রত্যাশী কিন্তু নিরাশা বা হতাশাবাদী ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। তাই মু’মিন কখনো হতাশ হয় না। আশাবাদী প্রবলভাবে আল্লাহ নির্ভরশীল। আশাবাদী আল্লাহর রাহিম, আল্লাহ রাহমান, আল্লাহ কারীম, আল্লাহ রাউফুম বিল ইবাদ নামগুলোর প্রতি গভীর বিশ্বাস স্থাপন করে বলেই সে আশাবাদী হয়ে উঠে। এ জন্য আশাবাদীকে আল্লাহ ভালবাসেন। পক্ষান্তরে হতাশা শয়তানের বৈশিষ্ট্য। ইবলিশ মানে হতাশ। হতাশা মানুষের অর্গানগুলোকে দূর্বল ও অকেজো করে দেয়। ফলে সে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়ার সাথে সাথে শারীরিকভাবেও বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আল কুরআনে যেখানে ক্ষতিগ্রস্থ শব্দটি এসেছে সেটিই ধ্বংস।
আল্লাহ তা’আলা মানুষ সৃষ্টি করলেন। তাদের আকৃতি দান করলেন। এরপর ফেরেশতাদের বললেন, আদমকে সিজদা করো। সকলেই সেই নির্দেশ পালন করলেন কিন্তু ইবলিস সেই নির্দেশ পালন করেনি। সে উত্তর দিল আমি আদম থেকে শ্রেষ্ট, আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে আর আদম মাটির তৈরী। আল্লাহ বললেন, তুমি এখান থেকে বেরিয়ে যা, এখানে অহংকার করার অধিকার তোর নেই।
তার যুক্তি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর এই নির্দেশ অমান্য করে শয়তান কয়েকটি ভুল করেছে। এক, আল্লাহ আলিম, তিনি যে-ই সিদ্ধান্তই দেন জেনে বুঝেই দেন. তিনি হাকিম অর্থাৎ তিনি যেই ফয়সালা দেন বিজ্ঞতার সাথেই দেন। আল্লাহ মুতাকাব্বির, অহংকার এককভাবে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। কোন সৃষ্টির অহংকার করার অধিকার নাই। আল্লাহ ছাড়া যদি কেউ অহংকার করে তাহলে সে আল্লাহর সাথে শিরকে লিপ্ত হয়। শয়তান আল্লাহর এ গুণগুলোকে অবমূল্যায়ণ করে বর্ণবাদী অহংকারে লিপ্ত হয়। যার কারণে আল্লাহ তাকে অবাঞ্চিত ঘোষনা করেন। ফলে সে হতাশায় লিপ্ত হয় এবং ধ্বংসশীলদের অন্তর্ভুক্ত হয়। ইবলিশ মানে হতাশ।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আমি তোমাদের সৃষ্টির সূচনা করলাম তারপর তোমাদের আকৃতি দান করলাম অতপর ফেরেশতাদের বললাম, আদমকে সিজদা করো। এ নির্দেশ অনুযায়ী সবাই সিজদা করলো। কিন্তু ইবলিশ সিজদাকারীদের অন্তর্ভৃক্ত হলো না। আল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, “আমি যখন তোকে হুকুম দিয়েছিলাম তখন সিজদা করতে তোকে বাধা দিয়েছিল কিসে? সে জবাব দিল: “আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ। আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছো এবং ওকে সৃষ্টি করেছো মাটি থেকে। তিনি বললেন, ঠিক আছে তুই এখান থেকে নীচে নেমে যা। এখানে অহংকার করার অধিকার তোর নেই। বের হয়ে যা। আসলে তুই এমন লোকদের অন্তর্ভুক্ত যারা নিজেরাই নিজেদেরকে লাঞ্জিত করতে চায়।”(সুরা আরাফ ১১-১৩)
পক্ষান্তরে প্রথম মহামানব হযরত আদম আ: আল্লাহর নির্দেশ ধরে রাখতে না পেরে তিনি নিরাশ বা হতাশ হননি। শয়তান তাঁকে লোভ দেখালো তখন তার লোভ দেখানোর মোকাবেলায় তিনি নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারলেন না। তাঁর পা পিছলে গেলো। তৎক্ষণাত তিনি তা বুঝতে পারলেন এবং আল্লাহর রহমতের আশায় উভয়েই বলে উঠলো “বাব্বানা জলামনা আনফুসিনা ওয়া ইল্লাম তাগফির লানা ওয়া তারাহামনা লানা কুনা মিনাজ জালিমিন।” অর্থাৎ হে আল্লাহ আমরা তো নিজের ওপর জুলুম করে ফেলেছি, তুমি যদি আমাদেরকে মাফ না করো এবং আমাদের করুণা না করো তাহলে তো আমরা নি:সন্দেহে ধ্বংস হয়ে যাবো।”(সুরা আরাফ ২৩) তিনি আল্লাহ গাফুর, আল্লাহ রাহিম, আল্লাহ কারীম-এর প্রতি এতটাই আশাবাদী ছিলেন যে, মহান রব শুধু তাঁকে মাফই করে দেননি বরং তিনি করুণা করে তাঁকে বিশ্ব জাহানের শ্রেষ্ট মানবদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অর্থাৎ তাকে নবী হিসাবে মনোনীত করেন। আল্লাহ বলেন,“ তারপর তার রব তাকে নির্বাচিত করলেন, তার তাওবা কবুল করলেন এবং তাকে পথ নির্দেশনা দান করলেন।”(সুরা তা-হা: ১২২)
হযরত ইউনুস আ: সমুদ্রের অতলান্তে অন্ধকার মাছের পেট থেকে আল্লাহকে ডেকে উঠলেন। আল্লাহ তাঁর ডাকে সাড়া দিলেন এবং মাছের পেট থেকে উদ্ধার করলেন। হতাশ ও নিরাশ হলে এমন কঠিণ পরিস্থিতি থেকে বেঁচে আসা বড়ই অসম্ভবের ব্যাপার ছিল। কতটুকু আশাবাদী ছিলেন যে, আমার প্রভু আমাকে রহম করবেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর মাছওয়ালাকেও আমি অনুগ্রহভাজন করেছিলাম। স্মরণ করো যখন সে রাগান্বিত হয়ে চলে গিয়েছিল এবং মনে করেছিল আমি তাকে পাকড়াও করবো না। শেষে সে অন্ধকারের মধ্য থেকে ডেকে উঠলো“তুমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, পবিত্র তোমার সত্তা, অবশ্যই আমি অপরাধ করেছি।” তখন আমি তার দু’আ কবুল করেছিলাম এবং দু:খ থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছিলাম, আর এভাবেই আমি মু’মিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি।”(সুরা আম্বিয়া:৮৭-৮৮)
হযরত ্ইয়াকুব আ: প্রাণাধিক পুত্রদ্বয় ইউসুফ ও বিন ইয়ামীনকে হারিয়ে বলেছিলেন আমি ‘সবরে জামিল” ধারণ করলাম। আমার আল্লাহ এদেরকে আমার সাথে মিলিয়ে দিবেন। আল্লাহ তাঁর এই ধৈর্যের ফলে তাঁর দু’সন্তানকে শুধু মিলিয়েই দিলেন না। সাথে সাথে শান-শওকত ও অত্যধিক সম্মানের সহিত তাঁদেরকে ফিরিয়ে দিলেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ঠিক আছে, এ ব্যাপারেও আমি সবর করবো এবং ভালো করেই সবর করবো। আল্লাহ এদের সবাইকে এনে আমার সাথে মিলিয়ে দেবেন। তিনি সবকিছু জানেন এবং তিনি জ্ঞানের ভিত্তিতে সমস্ত করেন।”(সুরা ইউসুফ:৮৩)
ইউসুফ আ: মিশরের রাজ প্রসাদের কঠিণ ষড়যন্ত্রের কবলে পড়েন। তখন তিনি প্রভুর আশ্রয় প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তাঁকে শুধু দোষমুক্তই করেননি বরং তাঁকে মিশরের রাজ ক্ষমতা প্রদান করে সম্মানিত করেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ইউসুফ বললো,“হে আমার রব! এরা আমাকে দিয়ে যে কাজ করাতে চাচ্ছে তার চাইতে কারাগারই আমার কাছে প্রিয়। আর তুমি এদের চক্রান্ত থেকে আমাকে না বাঁচাও তাহলে আমি এদের ফাঁদে আটকে যাবো এবং অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হবো। তার রব তার দু’আ কবুল করেন এবং তাদের অপকৌশল থেকে তাকে রক্ষা করলেন। অবশ্যিই তিনি সবার কথা শোনেন এবং সবকিছু জানেন।”(সুরা ইউসুফ: ৩৩-৩৪)
আশার মধ্যেই মানুষ বেঁচে থাকে। আশার কারণে মানুষ কাজ করে, কথা বলে, পথ চলে। আশা মানুষের শারীরিক ও মানসিক শক্তির চাকাকে সচল রাখে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে আশা না থাকলে মানুষ অসামাজিক এক আজব জীবে পরিণত হয়। আশা সফলতার মূল চাবিকাঠি। মনে রাখা প্রয়োজন, আশা ঈমানের সাথেও সংশ্লিষ্ট। তাওয়াক্কুলের প্রবল বিশ্বাস ছাড়া মানুষ আশা করতে পারে না। অর্থাৎ আশা তাওয়াক্কুল থেকে আর তাওয়াক্কুল মজবুত ঈমান থেকে জাগে।
হতাশা বা নিরাশা এমন এক ক্ষতিকর বদগুণ যা মানুষের সকল প্রকার যোগ্যতাকে সমূলে বিনষ্ট করে দেয়। মানুষের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক শক্তিকে এমনভাবে দূর্বল করে দেয় যে, এই সকলক্ষেত্রে সে একজন অযোগ্য ও অকর্মণ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়। হতাশাগ্রস্থ এই ব্যক্তিটি পরিবারের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে যেমনভাবে বিনষ্ট করে, তেমনি সমাজ ও পেশাগত জীবনে একজন অযোগ্য,অকর্মণ্য দায় হিসাবে চিহ্নিত হয়। হতাশা এমনভাবে ঘিরে ধরে যে ঢিলেমী তাকে সামনে চলার সকল পথকে রুদ্ধ করে দেয়। হতাশার আর একটি বড় প্রভাব হলো, হতাশাগ্রস্থ ব্যক্তি সকল কাজে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে। নেতিবাচক অভিব্যক্তি তার অভ্যাসে পরিণত হয়। ইতিবাচকতা তার আজন্মের শুত্রুতে পরিণত হয়। এ ধরণের ব্যক্তিরা নেতিবাচক মনোভাব প্রচ্ছন্ন ও অপ্রচ্ছন্ন দুভাবে প্রকাশ করে। একটি ভাল কাজের প্রতি সকলেই ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে, কিন্তু ঐ ব্যক্তি যে হতাশা রোগে আক্রান্ত, সে তার মনোভাব এমনভাবে প্রকাশ করবে, প্রাথমিকভাবে বুঝা যাবে না সে নেতিবাচক না কি ইতিবাচক। কিন্তু একটু ভালভাবে লক্ষ্য দেখা যাবে যে, প্রচ্ছন্নভাবে সে নেতিবাচক মনোভাবই প্রকাশ করেছে। এ ধরণের ব্যক্তিরা নিজেরা তো সফলতার মুখ দেখতে পা-ই না, অধিকন্ত তারা অন্যের সফলতাকে সহ্য করতে পারে না।
সুতরাং কোন মু’মিন কখনো হতাশ হতে পারবে না। হতাশ হওয়ার সাথে সাথে তিনি ইবলিশ হিসাবে চিহ্নিত হবেন এবং খুব দ্রুত তাকে তাওবা করে আল্লাহর রহমতের ছায়া তলে শামিল হতে হবে। পূর্ণ আশা নিয়ে আল্লাহর রাহিম, আল্লাহ রাহমান, আল্লাহ গাফুর, আল্লাহ রাউফুম বিল ইবাদ, আল্লাহ কারীম, আল্লাহ আফুয়ুসহ তাঁর দয়া ও করুণায় পরিপূর্ণ তাঁর গুণাবলীর সীমায় প্রবেশ করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “(হে নবী!) বলে দাও, হে আমার বান্দারা যারা নিজের আত্মার ওপর জুলুম করেছো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।”(সুরা যুমার:৫৩)
সুতরাং মু’মিন ভাই ও বোনেরা কখনো হতাশ হবেন না। হতাশা ঈমানের বিপরীতমুখী একটি বিষয়। মনে রাখবেন, আশা নবী রাসুল ও আল্লাহর নিয়ামতপ্রাপ্তদের গুণ আর নিরাশা বা হতাশা ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসশীলেেদর বৈশিষ্ট্য।
Posted ২:২৬ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ০১ জুলাই ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh