জাফর আহমাদ | শুক্রবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৪
আবহমান বাংলার শত শত বৎসরের ঐতিহ্য ওয়াজ মাহফিলগুলো কেমন যেন তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। সেখান থেকে এক সময় মানুষ ইসলামের জীবন ঘনিষ্ট খুঁটি-নাটি বিষয় জেনে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারতো অথবা বিস্মৃত বিষয়গুলো নতুনভাবে জেনে নিজেদের উজ্জেবিত করতে পারতো। ওয়াজ মাহফিলগুলোর প্রভাব সমাজে বহুদিন যাবত বিরাজ করতো। কিন্তু বর্তমানে সেই ওয়াজ মাহফিলগুলো হয়ে উঠেছে গিবত, পরনিন্দা, পরচর্চার কেন্দ্রবিন্দু। যারা মানুষকে সহনশীলতা ও সহাবস্থানের নসিহাত করবেন, তারানিজেরাই আজ অসহনশীল ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন। আত্মকলহে জর্জড়িত কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছেন না। কেউ কাউকে মানতে পারছেন না। এমনকি একজন অন্যজনকে রাস্তার ভাষায় বেফাঁস কথা বলতেও দ্বিধাবোধ করছেন না। ফলে শ্রোতাগণওঅসহনশীল হয়ে উঠেছে। এই অসহনশীলতার বীজ কারা বপণ করেছে? পরিতাপের বিষয়, এই সহজ বিষয়টিও আমাদের ওয়ায়েজীনে কেরাম জানতে বা বুঝতে চান না। তারা এই অসহনশলীতার মাধ্যমে মূলত: কাদের এজেন্ট বাস্তবায়ন করে চলেছেন, তাও তাদের বোধশক্তিকে জাগ্রত করতে পারে না।এই বীজ যারা বপন করেছে, তাদের দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা আজ সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। ফলেশত শত বছরের সামাজিক ঐক্যের এই স্কুলটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির বদৌলতে এই দুষ্টুক্ষত সর্বসাধারণের মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করেছে। ফলে সামাজিক সহাবস্থান ও সহনশীলতাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। মানুষের ঐক্য বিনষ্ট হচ্ছে এবং ঘরোয়া প্রতিযোগীতা, বিভেদ, অসহিষ্ণুতা ও বিচ্ছিন্নতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
অথচ আল্ল¬াহ তা’আলা বলেছেন“ তোমরা আল্ল¬াহর রজ্জুকে (দ্বীনকে) সকলে দলবদ্ধ বা জামায়াতবদ্ধ বা ঐক্যবদ্ধভাবে শক্ত করে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়োনা।”(সুরা আল ইমরান ঃ ১০৩)এ আয়াতে কয়েকটি বিষয় বিষেশভাবে লক্ষ্যণীয় প্রথমতঃ ‘হাবলুন, শব্দটি একবচন, এর অর্থ ‘একটি রশি’ অর্থাৎ দ্বীনের রূপক অর্থ। তার মানে দ্বীন হবে একমাত্র একটি। দ্বিতীয় কোন দ্বীনের অস্থিত্বই থাকবে না। দ্বিতীয়ত ঃ ‘জামিয়া’ অর্থ ‘সকলে মিলে’, ‘ঐক্যবদ্ধভাবে’, ‘দলবদ্ধভাবে’। তার মানে একা একা পথ চলা হবে না। অর্থাৎ এ কথা বলা যাবেনা যে, আমি এ সমস্ত ঝুট-ঝামেলার কাজে নাই, বরং একা একা নামাজ কালাম, আল্ল¬াহর কাজ করে যাচ্ছি এটিই যথেষ্ট। না, তা যথেষ্ট নয়। বরং এটাকে ঝুট-ঝামেলার কথা বলে দ্বিগুণ গুনাহের কাজ করছেন। আল্ল¬াহ “জামেয়া’ শব্দের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতা বা বনে-জঙ্গলে একা একা ইবাদাত করার সুযোগ খতম করে দিয়েছেন। তৃতীয়তঃ ‘ওলা তার্ফারাকু’ (বাবে তাফায়ুল এর শব্দ, যা ‘পরস্পর’ এর অর্থ প্রকাশ করে থাকে) অর্থ ‘পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’। অর্থাৎ নিজেরা বিভিন্ন দলে উপদলে ভাগ হয়ো না আর লোকদেরকে ফতোয়া দিয়ে অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার গান শুনাবার চেষ্টা করো না। তাছাড়া এ আয়াতের শেষের দিকে ইসলাম নামক নিয়ামতের মাধ্যমে একটি নিশ্চিত ধ্বংসের কবল থেকে উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। আল্ল¬াহ সুবহানু তা’আলা বলেন:-“ আল্ল¬াহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখো। তোমরা ছিলে পরস্পরে শুত্রু। তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন। ফলে তার অনুগ্রহ ও মেহেরবানীতে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছো। (তোমাদের অবস্থা এমনটি হয়েছিল যে,) তোমরা একটি অগ্নীকুন্ডের কিনারে দাঁড়িয়ে ছিলে। আল্ল¬াহ সেখান থেকে তোমাদের বাঁচিয়েছেন। এ ভাবে আল্ল¬াহ তাঁর নিদর্শনসমুহ তোমাদের সামনে সুষ্পষ্ট করে তুলেন। হয়ত এ নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে তোমরা নিজেদের কল্যাণের সোজা পথ দেখতে পাবে।”(সুরা ইমরান ঃ ১০৩)
এ আয়াতে আল্ল¬াহ রাব্বুল আলামীন জামায়াতবদ্ধ হওয়াকে ফরজ করেছেন । সুতরাং যে সমস্ত আলেম নিজেদের খেয়াল খুশিমত মুসলমানদের মধ্যে ভাঙনের গান শুনান, তারা অবশ্যই আল্ল¬াহর এ ফরজের লঙ্ঘন করছেন। আল্ল¬াহ তা’আলা বিচ্ছিন্ন হওয়াকে হারাম করেছেন এবং ঐক্যবদ্ধতাকে তিনি পছন্দ করেন। আল্ল¬াহ বলেন“ নিশ্চয় আল্ল¬াহ তাদের ভালবাসেন যারা শৃংখলার সাথে কাতার বন্দী হয়ে আল্ল¬াহর রাস্তায় যুদ্ধ করে, এমন ঐক্যবদ্ধ যেন তা সীসা ঢালা প্রাচীর।”(সুরা আস্ সফ ঃ ৪)
যারা অন্যের দোষ-ত্রুটির সমালোচনা করছেন, তারা নিজেদের দিকে তাকান। আপনি কি পুরোপুরি পরিশুদ্ধ? আপনি কি সাহাবায়ে কেরামের চরিত্রের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন? আপনার তো টার্গেট থাকবে আপনার চরিত্রকে সাহাবায়ে কেরামের কাছাকাছি নিয়ে যাবেন। যেহেতু আপনি এখনো যোজন যোজন দুরে অবস্থান করছেন, তাই আপনাকে নিজের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করা প্রয়োজন। অন্যের দোষ-ত্রুটির দিকে তাকানো বা প্রচার করার সময় কোথায়? নিজের চরিত্র র্সংশোধনের সময়ই তো পাই না। মনে রাখতে আল কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী আমাকে আমার দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। অন্যেও দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না। এটি আল্লাহ প্রদত্ত মানবিক ইখতিয়ার বিধির একটি মূলনীতি। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “প্রত্যেক ব্যক্তি যে নেকী উপার্জন করেছে তার ফল তার নিজেরই জন্য এবং যে গেনাজ সে উপার্জন করেছে তার প্রতিফলও তারই বর্তাবে।”(সুরা বাকারা: ২৮৬) অর্থাৎ ভালো হোক বা মন্দ হোক প্রত্যেক ব্যক্তি নিজে যে কাজ করেছে তার পুরাস্কার বা শাস্তি সে পাবে। একজনের কাজের পুরস্কার বা শাস্তি অন্যজন পাবে, এটা কখনো সম্বভ নয়।
তবে এটা সম্ভব, এক ব্যক্তি কোন সৎকাজের ভিত্তি রাখলো এবং দুনিয়ায় হাজার বছর পর্যন্ত তার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত থাকলো, এ ক্ষেত্রে এগুলো সব তার আমলনামায় লেখা হবে। আবার অন্য এক ব্যক্তি কোন খারাপ কাজের ভিত্তি রাখলো এবং শত শত বছর পর্যন্ত দুনিয়ায় তার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত থাকলো। এ অবস্থায় এ গুলোর গোনাহ ঐ প্রথম জালেমের আমল নামায় লেখা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ভারো বা মন্দ যা কিছু ফল হবে মানুষের প্রচেষ্টা ও সাধনার ফলশ্রতি। মোট কথা যে ভালো বা মন্দ কাজে মানুষের নিজের ইচ্ছা, সংকল্প, প্রচেষ্টা ও সাধনার কোন অংশই নেই, তার শাস্তি বা পুরস্কার সে পাবে, এটা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। কর্মফল হওয়ার মতো জিনিস নয়। সুতরাং ওলামায়ে কেরাম বা ওয়ায়েজিনে কেরাম নিজের দিকে তাকান, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকুন। হাজার হাজার মানুষের সামনে অন্যের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করবেন না। এর মাধ্যমে ইসলামের ক্ষতি ও মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। এছাড়াও নিম্নের কয়েকটি অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে।
এক, অন্যের দোষ-ত্রুটি গোপন করার জন্য আল্লাহর রাসুল সা: নির্দেশ দিয়েছেন। যারা অন্যের দোষ-ত্রুটি গোপন করেন, আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি গোপন করেন। দুই, গিবত, পরনিন্দা, পরচর্চা ইসলামে নিষিদ্ধ। এটিকে ইমাম আয যাহাবী রহ: তার গ্রন্থ “কিতাবুল কাবায়ির” এ কবীরা গুনাহ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা আল কুরআনে ঐক্যের ওপর গুরুত্বারূপ করেছেন। আপনি অন্য একজন ওয়ায়েজীন আলেম-এর দোষ-ত্রুটি সগৌরবে অন্যের সামনে প্রকাশ করে মূলত: আপনি মানুষের মধ্যে অনৈক্যের বীজ বপন করছেন। এটি আল কুরআনের নির্দেশের পরিপন্থী কাজ। সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো, এ ধরণের কাদা ছুড়াছুড়ি ইসলাম, মুসলমান এবং স্বয়ং নিজেকে অমুসলিমদের কাছেহাস্য-রসের পাত্র বানাচ্ছেন। ইসলামকে অন্যের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার কাজ করা মারাত্মক অপরাধ।
মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য বা ভাঙ্গন সৃষ্টি করা প্রকান্তরে ইহুদী, খৃষ্টান ও ব্রাহ্মন্যবাদী ইসলামের চরম দুশমনদের সাথে আপোষকামীতার শামিল। যা আল্লাহর রাসুল সাঃ ও তাঁর সাথীদের বৈশিষ্ট্যের সম্পুর্ণ বিপরীতমুখী। বাইতুল মোর্কারম জাতীয় মসজিদের সাবেক খতিব, দেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব মাওলানা ওবায়েদুল্লাহ রাহি: বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলোর ঐক্যের পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অথচ মারাত্বক ০৫টি অন্তরায়ের কথা উল্লে¬খ করেছিলেন। যথা:- (ক) একে অন্যের বিরুদ্ধে বিদ্রƒপ করা, (খ) নিজের দোষত্রুটির দিকে লক্ষ্য না করে অন্যের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ানো, (গ) প্রতিপক্ষকে গালি দেয়া ও মন্দ উপাধিতে তিরস্কার করা, (ঘ) ধারণাবশতঃ কারো উপর প্রমাণ ব্যতীত অভিযোগ আনা,(ঙ) আত্মগর্ব, অহংকার করা এবং এ ধারণা পোষণ করে যে, আমার মত ও পথই হলো শ্রেষ্ট, যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এর বিরোধীতা করে সে-ই ভ্রান্ত এবং ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমন ও শুত্রু। তিনি সত্যিই আমাদের দেশের ইসলামী দলগুলোর বাস্তব চরিত্র ও আচরণকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। আর এ গুলো ইসলামের দৃষ্টিতে বদ চরিত্রের অন্তর্ভুক্ত। আল-কুরআন ও হাদীসের আলোকে এ সব কটিই নিষিদ্ধ।আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: “হে ঈমানদারগণ, পুরুষরা যেন অপর পুরুষের বিদ্রুপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। আর মহিলারাও যেন অন্য মহিলাদের বিদ্রুপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। তোমরা একে অপরের প্রতি বিদ্রুপ করোনা। এবং পরস্পরকে খারাপ নামে ডেকো না। ঈমান গ্রহনের পর গোনাহের কাজে প্রসিদ্ধি লাভ করা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার। যারা এ আচরণ পরিত্যাগ করেনি তারাই জালেম।”(সুরা হুজরাত ঃ ১১-১২)গর্ব, অহংকার,আত্মভিমান ও নিজের শ্রেষ্টত্বের প্রকাশ ইত্যাদি মানুষের বদ গুণের অর্ন্তভুক্ত। পৃথিবীর নিয়ম হলো, গর্ব ও অহংকার করে কেউ সামনের দিকে এগুতে পারেনা। বেফাঁশ কথা বলে সাময়িক তার বিশাল কর্মী বাহিনীকে উত্তেজিত করতে পারবে ঠিকই। কিন্তু অহংকারের পদঘাতে জমিনটাকে তো ফাটিয়ে ফেলতে পারবে না অথবা ঐ পাহাড়টিকে সরিয়ে ফেলতে পারব না। শ্রেষ্টত্ব ও মর্যাদা জোর করে আদায় করা যায় না। এ গুলো অর্জনের জন্য আল্লাহর দেয়া নিয়মের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। যারা নিজেদের শ্রেষ্টত্ব, জেদ ও আত্মাভিমানের বশবর্তি হয়ে মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও মতানৈক্য সৃষ্টি করে তাদের সম্পর্কে আল্ল¬াহ তা’আলা বলেন, “তোমরা যেন তাদের মত হয়ে যেয়ো না, যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য হিদায়াত পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। যারা এ নীতি (ভাঙ্গন ও মতবিরোধ সৃষ্টির নীতি) অবলম্বন করেছে তারা সেদিন বিশাল শাস্তি পাবে।”(সুরা আল-ইমরান ঃ ১০৫)
Posted ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh