জাফর আহমাদ : | বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫
আল্লাহর সৃষ্টিকুল নিয়ে চিন্তা-গবেষনা করুন,ইনশা’আল্লাহ আপনার চিন্তা-চেতনার অন্ধকার জগতটি আলোয় ঝলোমলোয় হয়ে উঠবে।আলোকিত সুন্দর এক চিন্তার জগতে প্রবেশ করবেন। আপনার সামনে একটার পর একটা আলোর দ্বার উন্মোচিত বা উন্মুক্ত হতে থাকবে। চিন্তা-ভাবনা বা চিন্তা-গবেষনা করার কুরআনী পরিভাষাগুলো হচ্ছে এক,‘তাফাক্কুর’ অর্থাৎ চিন্তা-ভাবনা করা। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“এভাবে আমি বিশদভাবে নিদর্শনাবলী বর্ণনা করে থাকি তাদের জন্য যারা চিন্তা ভাবনা করে।”(সুরা ইউনুস:২৪) দুই, ‘তাযাক্কুর’ অর্থাৎ স্মরণ করা। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“এরপরও কি তোমরা স্মরণ করবে না।”(সুরা আন’আম:৮০) তিন, ‘তাদাব্বুর’ অর্থাৎ চিন্তা-গবেষনা করা।আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেনি, নাকি তাদের মনের ওপর তালা লাগানো আছে।”(সুরা মুহাম্মদ:২৪)উল্লেখিত তিনটি পরিভাষার অর্থ দেখা যাচ্ছে প্রায় একই।
কিন্তু প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা ভাবার্থ রয়েছে। যেমন তাফাক্কুর ও তাদাব্বুর এর মধ্যে পার্থক্য হলো, তাফাক্কুর মানে সাধারণ চিন্তা-ভাবনা করা আর তাদাব্বুর হলো, গভীরভাবে চিন্তা-গবেষনা করা বা ধীরে-সুস্থে চিন্তা-গবেষনা করে একটি ফলাফল নিশ্চিত করা। তাফাক্কুর মানে মনন বা চিন্তাভাবনা করে জিনিসগুলো উপলব্ধি করা যাকে চিন্তা-ভাবনা, মনন বা দুরদর্শিতা বলে।
আমরা যেই যমীনের ওপর বিচরণ করি এবং মাথার ওপর যেই বিশাল আকাশ রয়েছে এবং এতদুভয়ের মাঝে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান আরো যে অসংখ্য সৃষ্টিকুল বিদ্যমান এগুলোর মধ্যে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। এগুলো মহান সৃষ্টিকর্তা অনর্থক সৃষ্টি করেননি। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“পৃথিবী ও আকাশের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের পালাক্রমে যাওয়া আসার মধ্যে বুদ্ধিমান লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।
যে সমস্ত বুদ্ধিমান লোক উঠতে বসতে ও শয়নে সব অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবীর গঠনাকৃতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে, তাদের জন্য রয়েছে বহুতর নিদর্শন। (তারা আপনা আপনি বলে উঠে) হে আমাদের রব! এসব তুমি অনর্থক ও উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করোনি। বাজে ও নিরর্থক কাজ করা থেকে তুমি পাক-পবিত্র ও মুক্ত।”(সুরা আলে ইমরান:১৯০-১৯১) প্রত্যেক ব্যক্তিই যদি সে উদাসীন অর্থাৎ গাফেল না হয় এবং বিশ্ব-জাহানের নিদর্শনসমূহ বিবেক-বুদ্ধিহীন জন্তু-জানোয়ারের দৃষ্টিতে না দেখে গভীর নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে দেখে ও সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে প্রতিটি নিদর্শনের সাহায্যে অতি সহজে যথার্থ ও চুড়ান্ত সত্যের দ্বারে পৌঁছতে পারে। কেবলমাত্র বোবা, অন্ধ ও বিবেক-বুদ্ধিহীন জন্তুু-জানোয়ারেরা তা নিয়ে সামান্যতম মাথা খাটায় না। ফলে তাদের কাছে সত্য-অসত্য সব সমান। অর্থাৎ সত্যের দ্বার তাদের জন্য উন্মোচিত হয় না।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,“কিন্তু যারা আমার নিদর্শনগুলোকে মিথ্যা বলে তারা বধির ও বোবা, তারা অন্ধকারে ডুবে আছে, আল্লাহ যাকে চান বিপথগামী করেন আবার যাকে চান সত্য সরল পথে পরিচালিত করেন।”(সুরা আন’আম:৩৯) আল্লাহকে জানার জন্য নবী-রাসুল ও আসমানী গ্রন্থের পাশাপাশি আমাদের চারদিকে অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। পৃথিবীর বুকে বিচরণশীল প্রাণীকুল এবং শূন্যে উড়ে চলা পাখিদের কোন একটি শ্রেণীকে নিয়ে তাদের জীবন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করুন, দেখুন কিভাবে তাদেরকে অবস্থা ও পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তাদের আকৃতি নির্মাণ করা হয়েছে। কিভাবে তাদেরকে জীবিকা দানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কিভাবে তাদের জন্য ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কিভাবে একেকটি প্রাণীকে এবং একেকটি ছোট-বড় প্রাণীকে এবং এক একটি ছোট ছোট কীট-পতংগকেও তার নিজের স্থানে সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পথ প্রদর্শন করা হচ্ছে। কিভাবে অতল সমুদ্রের তলদেশে পাথরের ওপর ছোট একটি কীট যা মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা যায় না, অথচ মহান আল্লাহ সামিউম বাছির, তার ডাক তিনি শোনেন এবং তাকে তিনি দেখেন ও তার প্রাত্যহিক খাদ্য তার কাছে পৌঁছে দেন।
তিনি একটি নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যেকটি প্রাণী থেকে তাদের নির্ধারিত কাজ আদায় করে নিচ্ছেন। প্রত্যেককে একটি নিয়ম-শৃংখলার আওতাধীন করে রেখেছেন। কেউ তার নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করে যায় না। তাদের জন্ম,মৃত্যু ও বংশবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা যথা নিয়মে চলছে। কোথাও তার ব্যত্যয় ঘটছে না। বনের হিংশ্র প্রাণীরা বন ছেড়ে লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে না। দিনরাত্রির আবর্তন ঘটছে যথানিয়মে।সূর্য তার নির্ধারিত কক্ষ পথ ছেড়ে অন্য পথে ঢুকে পড়ছে না। সৌরজগতের অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র কেউ কারো সাথে সংঘর্ষ লিপ্ত হচ্ছে না। এদের অসংখ্য গ্রহ পথ আলিম ও আজিজ আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
বিশাল শক্তিশালী সুর্য-চন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করেন এমন এক সত্তা যিনি আজিজ অর্থাৎ মহাপরাক্রমশালী। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এলোমেলো অসংখ্য অজানা গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথ নির্ধারণ করার জ্ঞান রাখেন যেই সত্তা তিনি আলিম অর্থাৎ মহাজ্ঞানী। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“সূর্য, সে তার নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে ধেয়ে চলছে। এটি প্রবল পরাক্রমশালী জ্ঞানী সত্তা কর্তৃক নির্ধারিত বা নিয়ন্ত্রিত।”(সুরা ইয়াসীন:৩৮) শুধু সূর্যই নয় বরং সমস্ত তারকারাজি, যাদেরকে অনঢ় মনে করা হচ্ছে, এরাও নির্ধারিত পথে ছুটে চলছে। তাদের চলার গতি প্রতি সেকেণ্ডে ১০ থেকে ১০০ মাইল বলে অনুমান করা হয়। আর আধুনিক আকাশ বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞগণ সূর্য সম্পর্কে বলেন যে, সে তার সমগ্র সৌরজগত নিয়ে প্রতি সেকেণ্ডে ২০ কিলোমিটার গতিতে এগিয়ে চলছে। এই শক্তিশালী সৃষ্টি সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথ নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করার বর্ণনা পেশ করার সাথে সাথে স্বয়ং আল্লাহর তাঁর বিশেষ দু’টো গুণবাচক নাম ব্যবহার করেছেন। তথা আজিজ ও আলিম অর্থ প্রবল পরাক্রান্ত ও মহাজ্ঞানী।
আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শনের মধ্য থেকে যদি কেবলমাত্র এ একটি নিদর্শন সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করা হয় তাহলে প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তি জানতে পারবে যে, আল্লাহর একত্ব এবং তাঁর গুণাবলীর ধারণা তাদের সামনে পেশ করা হয়েছে এবং সে ধারণা অনুযায়ী দুনিয়ার জীবন যাপন করার জন্য যে কর্মনীতি অবলম্বন করার দিকে তাদেরকে আহবান জানানো হচ্ছে তা-ই যথার্থ ও প্রকৃত সত্য। কিন্তু যারা চোখ মেলে এগুলো দেখেও না আর কেউ বুঝাতে এলে তার কথা মেনেও নেয় না। এরা মূর্খতার নিকষ অন্ধকারে পড়ে আছে।
সত্যিকারার্থে এ ধরণের মূর্খতা ও অজ্ঞতাপ্রিয় ব্যক্তিদের আল্লাহর নিদর্শন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষনা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে উদ্ভট চিন্তা-চেতনা তার মাথা থেকে বের হতে থাকে, যা প্রকৃতির সাথেও যায় না এবং সাধারণ মানুষও তা গ্রহণ করে না। পক্ষপাতদুষ্ট, বিদ্বেষী ও সত্যবিরোধী জ্ঞানান্বেষী কখনো আল্লাহর নিদর্শন পর্যপেক্ষণ করলেও সত্যকে সে গোপণ করে বা সত্যের পক্ষে কথা বলে না। সত্যের পক্ষে পৌঁছার নিশানীগুলো তার দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায় এবং সে বিভ্রান্তির অক্টোপাসে জড়িয়ে ফেলার মতো জিনিসগুলো তাকে সত্য থেকে দুরে টেনে যেতে থাকে। অপরদিকে একজন সত্যান্বেষী ব্যক্তি জ্ঞানের উপকরণসমূহ থেকে লাভবান হবার সুযোগ লাভ করে এবং আল্লাহর নিদর্শনগুলোর মধ্যে সত্যের লক্ষ্যে পৌঁছার এবং তার ওপর সুদৃঢ় নিশানীগুলো লাভ করে যেতে থাকে।
আমাদের সমাজে এ ধরনের অসংখ্য দৃষ্টান্ত আজকাল প্রায়ই দেখা যায়। এমন বহু লোক আছে যাদের সামনে পৃথিবীর এমন অসংখ্য বস্তুনিচয় ও প্রাণীকূলের মধ্যে অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে, যা গভীরদৃষ্টিতে নয় বরং হালকাভাবেও চোখটা খুললে আল্লাহকে চেনার ও জানার জন্য যতেষ্ট নিদর্শন পেয়ে যেতো। কিন্তু তারা জন্তু-জানোয়ারের মতো সেগুলো দেখে থাকে এবং সেখান থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করে না। আরেক প্রকার লোক এমন রয়েছে যারা প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, জীববিদ্যা, ভূতত্ব, মহাকাশ বিদ্যা, শরীর বিজ্ঞান, শবব্যবচ্ছেদ বিদ্যা এবং বিজ্ঞানের আরো বহু শাখা প্রশাখায় ব্যাপক অধ্যায়ন করেন, ইতিহাস, প্রত্নতত্ব ও সমাজ বিজ্ঞানে গবেষণা করেন এবং এমন সব নিদর্শন তাদের সামনে আসে যেগুলো হৃদয়কে ঈমানের আলোয় ভরে দেয়।
কিন্তু যেহেতু তারা বিদ্বেষ ও পক্ষপাতদুষ্ট মানসিকতা নিয়ে অধ্যায়নের সূচনা করেন এবং তাদের সামনে বৈষয়িক লাভ ছাড়া আর কিছুই থাকে না, তাই এ অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণকালে তারা সত্যের দোরগোড়ায় পৌঁছেও সত্যের সন্ধান পায় না। বরং তাদের সামনে যে নিদর্শনটিই উপস্থিত হয় সেটিই তাদের নাস্তিকতা, আল্লাহ বিমূখীতা, বস্তুবাদিতা ও প্রকৃতিবাদিতার দিকে টেনে নেয় যায়। তৃতীয় প্রকারের লোকও কম নহে, যারা সচেতন বুদ্ধি বিবেকের সাথে চোখ মেলে বিশ্ব প্রকৃতির এ সুবিশাল কর্মক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করেন এবং বলে উঠেন,“হে আমাদের রব! এসব তুমি অনর্থক ও উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করোনি। বাজে ও নিরর্থক কাজ করা থেকে তুমি পাক-পবিত্র ও মুক্ত।”(সুরা আলে ইমরান:১৯১) কবি বলেন,“সচেতন দৃষ্টি সম্মুখে গাছের প্রতিটি সবুজ পাতা,একেকটি গ্রন্থ যেন স্রষ্টা-সন্ধানের এনেছে বারতা।”
এ তৃতীয় প্রকারের লোক সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন,“অবশ্যই দিন ও রাতের পরিবর্তন এবং আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তাতে নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা (ভুল দেখা ও ভুল আচরণ থেকে) আত্মরক্ষা করতে চায়।”(সুরা ইউনুস:৬) এরা নিজেদের চোখের সামনে সৃষ্টি জগতের এ বিশাল কারখানাটি দেখে সুনিশ্চিত হয় যে, এটি অমনি অমনি তৈয়ার হয়ে যায়নি এবং কোন শিশুর মত নিছক খেলা করার জন্য এসব কিছু তৈরী করা হয়নি আবার খেলা করে মন ভরে যাওয়ার পর এসব কিছু ভেঙে চুরে ফেলে দেবে না। বরং তারা স্পষ্ট দেখতে পায়, সব কাজে রয়েছে শৃংখলা, বিচক্ষণতা নৈপুণ্য ও কলা কৌশল। প্রতিটি অণুপরমাণু সৃষ্টির পেছনে তারা দেখতে পায় একটি লক্ষ্যভিসারী উদ্যেগ।
ফলে তারা আল্লাহ অত্যন্ত বিজ্ঞজনোচিত পদ্ধতিতে জীবনের নিদর্শনাবলীর মধ্যে চতুরদিকে এমন সব চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন যা ঔ নিদর্শনগুলোর পেছনে আত্মগোপন করে থাকা সত্যগুলোকে পরিস্কারভাবে চিহ্নিত করতে পারে। কারণ প্রথমত: তারা মূর্খতা ও অজ্ঞতাপ্রসূত একগুয়েমী বিদ্বেষ ও স্বার্থপ্রীতি থেকে মুক্ত হয়ে জ্ঞান অর্জন করার এমন মাধ্যম ব্যবহার করে যেগুলো আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত: তারা ভুল থেকে আত্মরক্ষা ও সঠিক পথ অবলম্বন করার ইচ্ছা নিজেদের অন্তরে পোষণ করে।
Posted ১১:৫১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh