জাফর আহমাদ | বৃহস্পতিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৪
“তুমি আমাদের সোজা পথ দেখাও।”(সুরা ফাতিহা:৫) অর্থাৎ জীবনের প্রত্যেকটি শাখা প্রশাখায় এবং বিভাগে, চিন্তা, কর্ম ও আচরণের এমন বিধি-ব্যবস্থা আমাদের শেখাও, যা হবে একেবারেই নির্ভুল, যেখানে ভুল দেখা, ভুল কাজ করা ও অশুভ পরিণামের আশংকা নেই, যে পথে চলে আমরা সাফল্য ও সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারি। হে আমাদের রব! হে রহমান ও রহিম! হে আমাদের মালিক!তুমি আমাদের পথ দেখাও। কল্পিত দর্শনের গোলকধাঁধাঁর মধ্য থেকে যথার্থ সত্যকে উন্মুক্ত করে আমাদের সামনে তুলে ধর। বিভিন্ন নৈতিক চিন্তা-দর্শনের মধ্য থেকে যথার্থ ও নির্ভূল নৈতিক চিন্তা-দর্শন আমাদের সামনে উপস্থাপিত করো। জীবনের অসংখ্য পথের মধ্য থেকে চিন্তা ও কর্মের সরল ও আলোকিত সুস্পষ্ট রাজপথটি আমাদের দেখাও।
এই পথটি পরিপুর্ণ একটি রাজপথ, এ পথ মানুষের সামগ্রীক জীবন ব্যবস্থাকে শামিল করে। এ পথে আছে মানুষের ইবাদত, বন্দেগী, অর্থনীতি,সমাজনীতি,রাষ্ট্রব্যবস্থা,পারস্পরিক আচার,আচরণ,পারস্পরিক অধিকারের সীমারোখা,আইন-আদালত,ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আরো যতগুলো বিষয় মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সেই সবগুলো। এ পথে যারা চলেছেন তারা আল্লাহর প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়েছেন। সেই নির্ভুল রাজপথে অতি প্রাচীনকাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত যে ব্যক্তি ও যে দলটিই তার ওপর চলেছে সে মহান আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করেছে এবং তাঁর দানে তার জীবন পাত্র পরিপূর্ণ হয়েছে। আর এ অনুগ্রহ বলতে তাঁর পার্থিব অনুগ্রহ নয় বরং এ অনুগ্রহ হলো, যারা আল্লাহর গযব ও শাস্তির সম্মুখীন হয়েছে, যারা সাফল্য ও সৌভাগ্যের পথ হারিয়ে ফেলেছে তাদের বিপরীতে তারা সঠিক ও সরল পথ পেয়েছে এবং তারা আল্লাহর সন্তোষ লাভ করেছে, সেটি তাদের জন্য আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। এটি এমন অনুগ্রহ নয়, যা ইতিপূর্বে ফেরাউন, নমরূদ ও কারুনরা লাভ করেছিল এবং আজো আমাদের চোখের সামনে বড় বড় জালিম, স্বৈরচারী, দুস্কৃতিকারী ও পথভ্রষ্টরা যেগুলো লাভ করে চলেছে। ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ধনদৌলত ও ঐশ^র্য শুধু আল্লাহর অনুগ্রহই নয় বরং এগুলো ছিল অনেকের জন্য গোমরাহী বা পথভ্রষ্টের আসবাপত্র। সত্যিকারের অনুগ্রহ হলো, সুপথ, রাজপথ ও সরল পথের সন্ধান। যেই পথটিতে আল্লাহর প্রিয়জনেরা চলেছেন। এই রাজপথটি যেদিক দিয়ে বয়ে গেছে সেখানটায় অন্ধকার দূরীভূত করে তার উজ্জল আলোয় চারপাশটা আলোকিত করে গেছে।
পক্ষান্তরে যারা সাফল্য ও সৌভাগ্যের পথ হারিয়ে ফেলেছে তাদের জন্য শয়তান জীবনের সকল শাখা-প্রশাখা ও বিভাগকে তার নিজস্ব চিন্তা,কর্ম ও আচরণ দ্বারা সুশেভিত করে দিয়েছে। প্রতিটি বিষয়ের জন্য রাজপথের পাশে সে অসংখ্য গলি পথ তৈয়ার করে দিয়েছে। মানুষ এ সব কল্পিত গলিপথকে রাজপথ মনে করে গোলকধাঁধাঁয় পড়েছে এবংসরল রাজপথ হারিয়ে তারা অসংখ্য চিবাগলির অন্ধকারে দিক বেদিক ছুটোছুটি করতে থাকে। ভুল চিন্তা ও ভুল কাজই তাদের কাছে সঠিক মনে হয়। তারা কোণাকুণি বা বাইপাস অসংখ্য পথ তৈরী করেছে। এই সবগুলো পথ সোজা চলে গেছে অত্যন্ত নিকৃষ্টতম স্থান দোজখে।
তরীক অর্থ পথ, সিরাত অর্থ পথ, সাবিল অর্থ পথ ও সুন্নাহ অর্থ পথ বা নিয়ম বা পদ্ধতি। যে নামই বলেন, সেই পথ ও পদ্ধতি হলো একটিই। তাহলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ ও পদ্ধতি। তিনি যেই পথ ও পদ্ধতি দেখিয়ে গেছেন সেই পথই হলো প্রকৃত পথ। যার নাম ইসলাম। যাকে আমরা সুন্নাতে রাসুলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে থাকি। এটি ইসলামের রাজপথ। আল কুরআনের পরিভাষায় যাকে সিরাতুল মুস্তাকিম বলা হয়। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ছাড়াও অসংখ্যবার সুরা ফাতিহায় এই বাক্যটি আমরা দো’আ আকারে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি “আমাদেরকে সহজ সরল পথে পরিচালিত করো”। যে পথটি হেরা পর্বত থেকে নেমে এসেছিল। যাকে বাস্তবরূপ দানের জন্য আল্লাহর অসংখ্য প্রিয়জনেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন। অনেক চড়াই উতড়াই এর পর মদীনায় তা পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সোজা ও সরল পথ, কন্টকাকির্নহীন আর বন্দুরহীন ঝলমল আলোকিত পথ। কে সেই দু:সাহসী অপরিণামদর্শী বিকেহীন পথের মাঝে নতুন নতুন আরো কতগুলো পথ সৃষ্টি করলো। পথের মাঝে পথ হারিয়ে মানুষ এখন হাবডুবু খেতে হচ্ছে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে। অথচ আলোকিত এই রাজপথ ধরে চলে গেছেন আল্লাহর কত নিয়ামতপ্রাপ্ত প্রিয়জনেরা। এই আলোকিত পথে চলতে চলতে মানুষ বাঁধা বিপত্তিহীন দ্বিধাহীন চিত্তে মঞ্জিলে মাকসুদে পৌঁছে যেতে পারতো। রাস্তার দিক নির্দেশনা তো রাজপথের কারিগরই দিয়ে গেছেন। গাইড হিসেবে রেখে গেছেন আল কুরআন আরো অধিক ব্যাখ্যা সম্বলিত আল হাদীস বা সুন্নাহ।
মনে রাখতে হবে,আল্লাহর দরবারে পৌঁছার জন্য রাজপথ কেবল একটিই, যাকে আল কুরআনে ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ নামে অবহিত করা হয়েছে। সিরাত অর্থ পথ বা রাস্তা। আর মুস্তাকিম হচ্ছে, সরল সোজা। সে হিসাবে সিরাতুল মুস্তাকিম হচ্ছে, এমন পথ, যা একেবারে সোজা ও ঋজু,প্রশস্ত ও সুগম; যা পথিককে নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থল অতি নিকটবর্তী এবং মনজিলে মাকছুদে পৌঁছার জন্য যা একমাত্র পথ, যে পথ ছাড়া লক্ষ্যে পৌঁছার অন্য কোন পথ হতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ আমারও রব তোমাদেরও রব, অতএব একমাত্র তাঁরই দাস হয়ে থাকো। এটাই হচ্ছে সিরাতুম মুস্তাকিম-সঠিক ও সুদৃঢ় ঋজু পথ।”(সুরা মারইয়াম:৩৬) এই রাজপথ ব্যতীত আর কোন পথ ও মত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম তৈয়ার করে যাননি। আল্লাহর দরবারে পৌঁছার জন্য তিনি কোন কোণাকুণি বা বাইপাস রাস্তার সন্ধানও দিয়ে যাননি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামের পরবর্তি তাঁর সাথীরাও নতুন কোন পথ তৈয়ার করে যাননি। এমনটি কখনো শোনা যায় না যে, তরিকতে সিদ্দিকিয়া ( অর্থাৎ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা: এর তরীকত) বা তরীকতে ফারুকিয়া (অর্থাৎ হযরত উমরে ফারুক রা:এর তরীকত) বা পরবর্তি আয়েম্মায়ে মুজতাহিদিনদের নামানুসারেও কোন তরীকত শোনা যায় না। তাহলে কারা এই রাজপথের মাঝে অসংখ্য আকাঁ বাঁকা সরু তরীকা, শাখা প্রশাখা বা পথ সৃষ্টি করলেন? অননুুমোদিত এই সব অন্ধকার চিবাগল্লির সরু তরীকার মাঝে পড়ে মানুষ রাজপথের সন্ধান করতে পারছে না।
শয়তান ও তার অনুসারীদের পথকে জুলুমাত বা অন্ধকারের পথ বলা হয়। এই পথ হয় অসংখ্য, অনির্ধারিত ও অস্পষ্ট। এ জন্য আল কুরআনে জুলুমাত শব্দটিকে বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। এই পথগুলো হলো, গযবে নিপতিতদের পথ। এগুলো হলো, শয়তানের তৈরী পথ। পথগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন বিধায় সে যে কোন পথে চলতে চলতে যে কোন খন্দকে নিমজ্জিত হতে পারে। সে সুনির্দিষ্ট পথে চলে তার গন্তব্যে কখনো পৌঁছতে পারবে না। তাছাড়া এ অন্ধকার পথে হিংশ্র-শ^াপদ তথা শয়তানের চেলা-চামুন্ডারা ওঁত পেতে আছে। এই পথগুলো জাহান্নামের পথ। দুনিয়ায় যারা পশুর মতো জীবন যাপন করে, নিজেদের কৃতকর্ম সঠিক কি না সে ব্যাপারে কখনো চিন্তাভাবনা করে না, যে দিকে সবাই ছুটে চলছে বা যেদিকে প্রবৃত্তি তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে অথবা যেদিকে মন চায় সেদিকে চলতে যারা অভ্যস্ত, তাদের জন্য এই জাহান্নামের পথই সঠিক মনে হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “কিন্তু যে ব্যক্তি রাসুলের বিরোধীতায় কোমর বাঁধে এবং ঈমানদারদের পথ পরিহার করে অন্য পথে চলে, অথচ তার সামনে সত্য-সঠিক পথ সুস্পষ্ট হয়ে গেছে, তাকে আমি সেদিকেই চালাবো যে দিকে সে চলে গেছে এবং তাকে জাহান্নামে ঠেলে দিবো, যা নিকৃষ্ট আবাস।”(সুরা নিসা:১১৫) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন,“তুমি আল্লাহর সুন্নাতে কখনো কোন পরিবর্তন পাবে না এবং কখনো আল্লাহর বিধানকে তার নির্ধারিত পথ থেকে হটে যেতেও তুমি দেখবে না।” (সুরা ফাতির:৪৩)
এ দু’টো আয়াতের আলোকে বৈচিত্রময়ী বিভিন্ন তরীকা বা পথ তৈরী করা গ্রহণযোগ্য নয়। প্রমমেই বলা হয়েছে যে, তরীকা তো একটিই সেটি হলো, সুন্নাতে রাসুলিল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যেই পথ ও পদ্ধতি দিয়ে আল্লাহ তাঁকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর নির্দেশিত পথ ও পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন সেটিই একমাত্র পথ। সাহাবাতুর রাসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীনসহ আয়েম্মায়ে মুজতাহিদিন কি নিজস্ব কোন তরীকা-পথ পদ্ধতি বা আলাদা কোন সন্নাহ তৈরী করে গেছেন? তাহলে আপনারা কেন এই বাইপাস বা শাখা পথ তৈরী করবেন? কে আপনাকে অনুমতি দিল? আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এ ইসলাম ছাড়া যে ব্যক্তি অন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করতে চায় তার সে পদ্ধতি কখনোই গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ব্যর্থ, আশাহত ও বঞ্চিত।”(সুরা আলে ইমরান:৮৫)
স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও এই পরিবর্তনের অনুমতি দেয়া হয়নি। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে নবী তোমার রবের কিতাবের মধ্য থেকে যা কিছু তোমার ওপর অহী করা হয়েছে তা (হুবহু) শুনিয়ে দাও। তাঁর বক্তব্য পরিবর্তন করার অধিকার কারো নেই তাঁকে ছাড়া তুমি কোন আশ্রয়স্থল পাবে না।”(সুরা কাহফ:২৭) অর্থাৎ যদি কেউ কারো স্বার্থে তার মধ্যে পরিবর্তন করে, তাহলে আল্লাহ তা’আলার আশ্রয় থেকে সে বেরিয়ে যাবে। আর আল্লাহকে ছাড়া কোন আশ্রয়স্থল পাবে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“তাদেরকে পরিস্কার বলে দাও: আমার পথতো এটাই, আমি আল্লাহর দিকে ডাকি, আমি নিজেও পূর্ণ আলোকে নিজের পথ দেখছি এবং আমার সাথীরাও। আর আল্লাহ পাক-পবিত্র এবং শিরককারীদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”(সুরা ইউনুফ:১০৮)
Posted ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh