বাংলাদেশ অনলাইন : | শনিবার, ১৬ আগস্ট ২০২৫
ছবি : সংগৃহীত
এখনকার মতো হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিল না, ইন্টারনেট ব্যবহার সহজ ছিল না। টেলিভিশন যেন এক জাদুর বাকসো, সাদা-কালো সেই বাকসো আবার সবার ঘরেও শোভা পেতো না। তবে সবার মুখেই ছিল একটা নাম ‘ম্যারাডোনা।’
বাংলাদেশ থেকে আর্জেন্টিনার দূরত্ব প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কিলোমিটার; কিন্তু এতদূরে থেকেও সেই দেশের দিয়াগো ম্যারাডোনা ঠিকই ঠাঁই করে নিয়েছিলেন দেশটার কোটি মানুষের হৃদয় কোঠায়।
শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের বিস্ময় ছিলেন ম্যারাডোনা। ফুটবল পায়ে যিনি বিশ্ব জয় করেছেন, শূন্য থেকে উঠেছেন সোপানে।’
অথচ জন্ম নিয়েছিলেন এক দরিদ্র পরিবারে, বুয়েন্স আইরোসের একটা জীর্ণ শহরের ছোট্ট কুঠুরিতে। সংসারের হাল যেন ’নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।’ জীবনের শুরুটা কেটেছে অর্ধাহারে-অনাহারেই।
ম্যারাডোনার আত্মজীবনীতে তাদের সেই সময়কার অবস্থা বর্ণনা করে লিখেন যে, খাবারের অভাব এতো তীব্র ছিল যে তার মা খাবারই খেতেন না। অসুস্থ থাকার ভান করতেন, যাতে ৮ সন্তানকে খাওয়াতে পারেন!
ম্যারাডোনার আত্মজীবনী ‘এল ডিয়েগো’ ও সার্বিয়ান সংবাদপত্র পলিটিকায় দেওয়া ম্যারাডোনার সাক্ষাৎকার অবলম্বনে তার জীবনের কিছু গল্প আজ শোনা যাক। যা অনুপ্রেরণা হতে পারে আমাদেরও।
ম্যারাডোনার ভাষ্যে- ‘আমার বেড়ে উঠা বুয়েনস এইরেসের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত অংশ ফ্যাবেল ফিওরিটোতে৷ সেখানে আমরা খুব ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকতাম৷ ছাদ দিয়ে বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকে যেত৷’
আমি সব সময় আমার বাবার কথা মনে আনি৷ বাবা যখন কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতেন, আমরা তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম৷ আট সন্তানের জন্য তিনি বেশি কিছু আয়ও করতে পারতেন না৷ আমরা চুপ করে বাড়িতে বসে থাকতাম৷ আমাদের কোনো খাবার থাকত না৷
বাবা সব সময় ভারী ব্যাগ বহন করতেন৷ বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ঘাড়ে ব্যাগ টানতেন৷ বাবা যখন বাড়ি ফিরতেন, তার পিঠ আর ঘাড়ে বরফের ব্যাগ রেখে দিতেন মা৷ আমরা ভাইবোনেরা অবাক হয়ে তা দেখতাম৷
‘আমার বোন কম খেত, যেন আমি রাতের বেলায় বেশি খেতে পারি৷ আমার মা পেটব্যথার ভান ধরে কিছু খেতেন না৷ তিনি সেই খাবার তার সন্তানদের জন্য রেখে দিতেন৷ পাত্রের শেষ দানাটুকু পর্যন্ত তিনি আমাদের দিয়ে দিতেন৷ এই কষ্ট নিয়েই আমার বেড়ে ওঠা৷ কেউ কল্পকাহিনি বলে উড়িয়ে দিতে পারে৷ কিন্তু আমার কাছে দারিদ্র্যই সত্য, বাস্তবতা৷ আমাদের কষ্ট কেউ বুঝবে না৷ আপনি যদি ক্ষুধার্ত না হন, তাহলে আমার কষ্ট বুঝতে পারবেন না৷ আমি সে সময়ের কথা ভুলিনি৷ আমি যে ভুলতে পারব না।’
আমি ছোটবেলায় কখনো জন্মদিন উদ্যাপন করতে পারতাম না৷ আমাদের কখনোই টাকাপয়সা হাতে থাকত না৷ জন্মদিনে আমার পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন আমার গালে চুমু দিত৷ সেই চুমুই ছিল আমার জন্য বড় উপহার৷
দারিদ্রতা অবশ্য ম্যারাডোনার সাফল্যের প্রতিবন্ধক ছিল না। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের সাথেই বেড়ে ওঠা তার। চাচাতো ভাই তার তৃতীয় জন্মদিনে তাকে ফুটবল উপহার দিয়েছিলেন। চুরির ভয়ে সেই বল জামার ভেতর রেখেই ঘুমাতেন।
ম্যারাডোনা বলেন, ‘আমার বয়স যখন তিন, তখন আমার এক কাজিন আমাকে একটা চামড়ার বল উপহার দেয়৷ সেটাই ছিল আমার প্রথম বল৷ আমি সেই বলটিকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাতাম।
আমার বাড়ির পেছনেই ছিল চতুর্থ লিগের এক ফুটবল দলের স্টেডিয়াম৷ আমি সারা দিন ফুটবল খেলতাম৷ সন্ধ্যায় অন্য সবাই বাড়ি ফিরে গেলেও আমি খেলতাম৷ অন্ধকার হওয়ার ঘণ্টা দুয়েক পরও আমার পায়ে ফুটবল থাকত৷
অন্ধকারে আমি চোখে কিছুই দেখতাম না৷ সে জন্য আমি শুধু সামনের দিকে বল কিক করে যেতাম৷ আমি দুটি কাঠি দিয়ে গোলপোস্ট বানাতাম৷ অন্ধকারে সেই গোলপোস্টের অদৃশ্য জালে কিকের পর কিক করে যেতাম৷
দশ বছর পর যখন আমি প্রথম ক্লাব জুনিয়র্সের হয়ে চুক্তি করি, তখন বুঝেছিলাম অন্ধকারে সেই ফুটবলচর্চা আমার কত কাজে লেগেছে৷ আমার প্রথম আয় করা টাকা দিয়ে আমি এক জোড়া ট্রাউজার কিনেছিলাম৷’
অন্য খেলোয়াড়দের তুলনায় তিনি ছিলেন খর্বকায়, মাত্র ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি লম্বা। তার শরীরের গঠনও অন্য সবার মতো ছিল না। কিন্তু তার বল কন্ট্রোল, ড্রিবলিং, দক্ষতা এত মসৃণ ছিল যে তার সেসব অসম্পূর্ণতা তাতে চাপা পড়ে যেত।
১০ বছর বয়সে এস্ত্রেয়া রোজার হয়ে খেলার সময় ফ্রান্সেসকো কোরনেহো নামের এক ফুটবল স্কাউটের চোখে পড়েন ম্যারাডোনা। সেখান থেকেই তিনি প্রথম যোগদান করেন বুয়েন্স আয়ার্সের জুনিয়র টিম ‘লস সেবোলিটিয়াসে’। এই দলের হয়ে টানা ১৩৬ ম্যাচে খেলেন তিনি।
১৯৭৬ সালের ২০ অক্টোবর, নিজের ষোলতম জন্মদিনের দশ দিন আগে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে ম্যারাডোনার অভিষেক হয়। সেখানে তিনি ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ছিলেন এবং ১৬৭ খেলায় ১১৫টি গোল করেন।
এর ঠিক এক বছর যেতে না যেতেই আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলার সুযোগ পায় ম্যারাডোনা। ১৯৭৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মাত্র ১৬ বছর বয়সে হাঙ্গেরির বিপক্ষে অভিষেক হয় তার।
অভিষেক হওয়ার পরের বছর ১৯৭৮ সালে ঘরের মাঠে ফিফা বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়। তবে ফর্ম তুঙ্গে থাকা ম্যারাডোনার বিশ্বকাপে জায়গা হয়নি।
জাতীয় দলের হয়ে না পারলেও, ১৯৭৯ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে অনুর্ধ-২০ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেন। সেবার সোভিয়েত ইউনিয়নকে ৩–১ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা।
তারপর পুরো বিশ্বকাপে অসাধারণ খেলা প্রদর্শন করে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ‘গোল্ডেন বল’ জেতেন তিনি।
এরপর এক মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে আর্জেন্টাইন ক্লাব বোকা জুনিয়র্সে যোগ দেন ম্যারাডোনা। এরপর ১৯৮২ সালে প্রথম লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেন তিনি।
এদিকে সময় গুনতে গুনতে আবারো চলে আসে ১৯৮২ বিশ্বকাপ। আর্জেন্টিনা ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হওয়া সত্ত্বেও ভালো করতে পারেনি,দ্বিতীয় পর্বে গিয়ে ব্রাজিলের কাছে পরাজিত হয়ে বিশ্বকাপ স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় আলবাসিলেস্তদের।
বিশ্বকাপ শেষ করে, আরেক দফা ক্লাব পরিবর্তন করেন ম্যারাডোনা। ১৯৮২ সালে রেকর্ড ৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বার্সেলোনায় যোগ দেন এই তারকা। বার্সায় আসার পরই, জ্বলে উঠেন তিনি।
দুই সিজনে ৫৮ ম্যাচে ৩৮ গোল করেন। ১৯৮৩ সালে বার্সার হয়ে কোপা দেল রে ও স্প্যানিশ সুপার কাপ ছিল বার্সার হয়ে তার অর্জন।
উল্লেখ্য, লেখার শুরুটা হয়েছিল বাংলাদেশে ম্যারাডোনা প্রেম নিয়ে। তবে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে আসার কথা থাকলেও কখনো পা রাখা হয়নি তার। যদিও ম্যারাডোনার ফেসবুকের টাইমলাইনে আছে বাংলাদেশ।
২০১৮ সালের ১৫ মার্চে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করা বাংলাদেশ ইউনিফাইড ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের সাথে একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন ম্যারাডোনা।
Posted ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১৬ আগস্ট ২০২৫
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh