বুধবার, ৮ মে ২০২৪ | ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

Weekly Bangladesh নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত

নিসফে শাবানের রাত: প্রেক্ষাপট উপমহাদেশ

জাফর আহমাদ   |   বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

নিসফে শাবানের রাত: প্রেক্ষাপট উপমহাদেশ

লাইলাতুল বারা’আত বা শবেবরাত না বলে ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শা’বান’ বলা রাসুলুল্লাহ সা: এর সুন্নাহ। এ ব্যাপারে প্রফেসর ড: মাওলানা খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহি: এর বক্তব্য থেকে অনুলিখন করেছেন সাইফুল্লাহ হিমেল। তিনি বলেন,“শবে বরাত বা নিসফে শাবানকে ঘিরে তিনটি বিষয় আমাদের বোঝা দরকার। প্রথম কথা হলো, শাবান মাসের এই বিশেষ রজনীকে ‘শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত’ বলে ডাকা সুন্নত নয়। আমরা সুন্নাতকে জানবো, মানবো, মর্যাদার স্থানে রাখবো। সুন্নাতকে পালন করার সময় অন্য কিছুকে মানদণ্ড হিসেবে রাখবো না। সমাজে আমরা সবাই সুন্নাতকে পালন করার সময় অন্য কিছুকে মানদণ্ড হিসেবে রাখব না। সমাজে আমরা সবাই সুন্নাতের দাবীদার। তারপরও অনেকে বিশেষ করে যারা সালাত, সাওম পালন করি তারাও অনেক সময় সুন্নাতকে দেখেও মুখ আটকে রাখি।’
তিনি আরো বলেন,‘ একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, তাহলো-আমরা দ্বীনি পোশাককে শ্রদ্ধা করি। তাই আমাদের কাছে ঈমানের চোর পাগড়ি পড়ে, জুব্বা গায়ে, টুপি মাথায় দিয়েই আসবে। সে আমাদের এই পছন্দের পোশাক পরিধান করেই আমাদের ধোঁকা দিতে আসবে। অনেক মানুষ দেখবেন সমাজে আছে টুপি, পাগড়ি মাথায় দিয়ে আসছে, নিজের জামা-টুপি সুন্নাতি বলে দাবি করছে। তারা কুরআন-হাদীস ঘেটে সুন্নাতি টুপি-জুব্বা বানিয়েছে কিন্তু কুরআন হাদীস ঘেটে সুন্নাতি ইবাদাত তারা বানাতে পারেনি। এদের কথায় মনে হয়,‘ রাসুল সা: আমাদের দর্জির কাজ তথা শুধু পোশাকের ধরন শেখাতে দুনিয়ায় এসেছেন। আর ইবাদাত বন্দেগী পীর সাহেব-হুজুরদের কাছ থেকে আমাদের শিখতে হবে।’নাউজুবিল্লাহ। এটা মুলত: পোশাকধারীদের সুন্নাতের নামে প্রতারণা-ধোঁকা। রাসুল সা: এর সুন্নাত আমাদের কাছে প্রতিটাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। পোশাকের সুন্নাত রাসুল সা: যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন সেভাবে মানবো। আবার ইবাদাতের বিষয়ে রাসুল সা: যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন সেভাবে মানবো। আমরা রাসুল সা: এর মতো পাগড়ি মাথায় দিবো আর পীর সাহেবের মতো মিলাদ পড়বো এটা ধোঁকাবাজি। আমার সব কিছু হবে রাসুল সা: এর মতো। প্রতিটি কাজ আমরা রাসুল সা: ও সাহাবাদের অনুসরণ করেই করবো। এখানে অন্য কাউকে অনুসরন করতে আমরা রাজি নই।’
তিনি আরো বলেন,‘ সুতরাং শবেবরাত বা লাইলাতুল বারায়াত’ শব্দ দুটি সুন্নাত নয়। কুরআনে এই রাতের নাম কোথাও নেই। হাদীসে এই রাতের নাম ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শা’বান’ অর্থ মধ্য শা’বানের রাত। আমরা রাসুল সা: এর ব্যবহৃত এই শব্দটাই এই রাতের জন্য ব্যবহার করবো। কারণ রাসুল সা: ও সাহাবিরা এই রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শা’বান’ বলেই আখ্যায়িত করেছেন। তাছাড়া তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী, চার ইমামসহ ইসলামের প্রথম চার-পাঁচ শত বছরের মধ্যে ‘শবে বরাত’ বা লাইলাতুল বারায়াত’ শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়নি।’
বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ প্রফেসর ড: মাওলানা খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহি: আরো বলেন,‘ সব মাসের (চন্দ্র মাস) ১৩,১৪,১৫ তারিখে সওম রাখা রাসুল সা: এর সুন্নাত। লাইলাতুল নিসফ বা শবেবরাত কেন্দ্রিক সওম রাখার বিষয়ে কোন সহিহ হাদিস নেই। এ বিষয়ে কোন দুর্বল হাদিসও নেই বললে চলে। ইবনে মাজার একটা হাদীসে নিসফে শা’বানের পরের দিন সওম রাখার কথা বলা হয়েছে তবে হাদিসটি খুবই দুর্বল, সনদটিও জাল পর্যায়ের। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহি: এই হাদিসের রাবিকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। তবে যে কোন চন্দ্র্র মাসের ১৩,১৪,১৫ এই তিন দিন সাওম পালন করা সুন্নাত। কাজেই অন্য মাসের মতো শা’বান মাসেও এই তিনদিন সওম রাখবেন। অনেকে বলবেন হুজুর, অন্য মাসে তো এই সুন্নাত সওম রাখি না। এতে কোনো সমস্যা নেই। আপনি অন্য মাসে না রাখলেও এই মাসে রাখতে পারবেন। কারণ শা’বান মাসে সওম রাখতে রাসুল সা: বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। কাজেই অন্য মাসের এই তিন দিন যারা সওম রাখতে পারেন না বা রাখেন নাই তারাও শা’বান মাসের এই তিন দিন সাওম রাখতে পারেন। এটা অনেক বরকতময় সুন্নাত সওম।
সমস্যা হলো, আমাদের দেশে ইবাদাতের ক্ষেত্রে পরিভাষাগত এমন কতগুলো শব্দ প্রচলিত হয়েছে, যা নিয়ে অত্যন্ত বেশী করে তর্কে-বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। তার মধ্যে একটি হলো,‘শবে বরাত’, এটি একটি ফারসী শব্দ, শব মানে রাত্রি আর বরাত অর্থ ভাগ্য অর্থাৎ ভাগ্য রজনী। এই উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং ইরানসহ কয়েকটি দেশে শবেবরাত পালনের ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়। সৌদি আরবে শবে বরাতের কোন অস্তিত্ব নেই। ইরানে শবে বরাত শিয়া মাজহাবের দ্বাদশ ইমাম হযরত ইমাম মাহদির জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়। এই রাতে ইরানের সর্বত্র আলোক সজ্জা করা হয় ও বিশেষ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। হাদিস জগতের সবচেয়ে বিশুদ্ধতম গ্রন্থ বুখারী ও মুসলিমে লাইলাতুল নিসফে মিন শা’বান নিয়ে কোন হাদিস পাওয়া যায় না। তবে সিহাহ সিত্তার অন্যান্য গ্রন্থে এ সম্পর্কে একাধিক হাদিস পাওয়া যায়। তাও সেটি ‘লাইলাতুল নিসফে মিন শা’বান’ নামে, অবশ্যই ‘শবে বরাত’ নয়। যেমন ইবনে মাজাহর ১৩৮৮ নম্বর হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, যখন মধ্য শা’বানের রজনী আসে, তখন তোমরা রাতে দণ্ডায়মান থাকো এবং দিবসে সিয়াম পালন করো। কারণ, ঐ দিন সুর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো। কোন রিযিক তালাশকারী আছে কি? আমি তাকে রিযিক প্রদান করবো। কোন দুর্দশাগ্রস্থ ব্যক্তি আছে কি? আমি তাকে মুক্ত করবো। এভাবে সুবহে সাদিক উদয় পর্যন্ত চলতে থাকে। হাদিসের ইমামদের মত অনুযায়ী, এই হাদিস অত্যন্ত দুর্বল।
কিন্তু বুখারী-মুসলিম-এ এসেছে রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, আমাদের প্রতিপালক প্রতি রাতের শেষ এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন, আমাকে ডাকার কেউ আছে কি? আমি তার ডাকে সাড়া দিবো। আমার কাছে চাওয়ার কেউ আছে কি? আমি তাকে তা প্রদান করবো। আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কেউ আছে কি? আমি ক্ষমা করবো। বুখারী-মুসলিমের এই সহিহ হাদিস দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, মু’মিনের প্রতি রাতই ফজিলতপূর্ণ। অনুরূপভাবে সিহাহ সিত্তার অন্যতম হাদিস গ্রন্থ তিরমিযিতে উল্লেখ রয়েছে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একরাতে আমি রাসুলুল্লাহ সা: কে খুঁজে পেলাম না। তখন বের হয়ে দেখি তিনি বা’কী কবরস্থানে আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে রয়েছেন। তিনি বললেন, তুমি কি আশঙ্কা করছিলে যে আল্লাহ ও তার রাসুল তোমার ওপর অবিচার করবেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল সা: আমি ধারণা করেছিলাম যে আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রী নিকট গমন করেছেন। অতপর তিনি বলেন, নিশ্চয়ই মহিমান্বিত পরাক্রান্ত আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। অতপর তিনি কালব গোত্রের মেষপালের পশমের অধিক সংখ্যককে ক্ষমা করেন।’ ইমাম বুখারী রহ: ঐ হাদিসটিকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ রাতের বিষয়ে ইমামের ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। ইমাম মালেক রহ: ও তার অনুসারী ফকিহ ও ইমামগণ ঐ রাতের বিশেষ ইবাদাত পালন করতে নিষেধ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী রহ: এর মতে এ রাতে বক্তিগতভাবে একাকী নিজ গৃহের মধ্যে ইবাদাত ও দু’আ মোনাজাতে থাকা মুস্তাহাব। ইমাম আবু হানিফা রহ: ইমাম আহমাদ রহ: এ বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট মত ব্যক্ত করেননি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, শবেবরাত বলে ৪০০ হিজরীর আগে কিছুু ছিল না। প্রখ্যাত আলেমদের মতে, রাসুলুল্লাহ সা: এর দীর্ঘ ২৩ বছরের নবুওয়াতী জীবনে, এমনকি সাহাবীদের যুগেও এ ধরনের কোন দিবস পালনের কথা ইসলামের ইতিহাসে নেই। শবেবরাত সর্বপ্রথম চালু হয়েছিল ৪৪৮ হিজরীতে বাইতুল মুকাদ্দাসে। সেখানকার ইমামগণ বাদশাহর কাছে নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করার জন্য শাবানের রাতে মসজিদে উপস্থিত লোকদের মাঝে বহু ফযিলাতের ওয়াজ ও নামাযের অশেষ নেকী পাওয়ার বানোয়াট বিবরণ পেশ করতেন। যে ইমাম শবেবরাতের যত বেশী বানোয়াট ওয়াজ ও তাফসীর করতে পারতেন সে মসজিদে তত বেশী লোক জমা হতো। ইমামদের এই ভিড় বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ছিল বাদশার নিকট তাদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করা। বাদশা গদির স্বার্থে জনপ্রিয় লোকদের হাতে রাখতে চাইতো। তাই ইমামদের মধ্যে জনপ্রিয়তার লড়াইয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে এই শবেবরাতকে নির্বাচিত করেছিল। জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ইমামদের মর্যাদা বিচার করতো বাদশা। সে সময় বাদশা ছিলেন ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন। বাদশার সমর্থন থাকায় শবেবরাত উদযাপন আরো জাঁকজমক ও জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তবে সে সময়ের হকপন্থি আলেমগণ এ নতুন আবিস্কৃত ইবাদাত পালনের বিরুদ্ধে নিজেদের সাধ্যানুযায়ী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু সমাজের কিছু লোকেরা হকপন্থি আলেমদের কথা শ্রবণ না করে বিদ’আতের অনুসরণ করতে থাকে।
শধুমাত্র ‘লাইলাতুল নিসফে মিন শা’বান বা শবে বরাতে নয় বরং প্রতি রাতেই আল্লাহ তা’আলা প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং তাঁর বান্দাদের ডাকতে থাকেন। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসুল সা: বলেছেন,“মহামহিম আল্লাহ তা’আলা প্রতি রাতে রাতের শেষ তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষনা করতে থাকেন: কে আছে এমন যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিবো। কে আছে এমন যে আমার নিকট চাইবে, আমি তাকে তা দিবো। কে আছে এমন আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করবো।”(বুখারী: ১১৪৫. ৬৩২১, ৭৪৯৪, কিতাবুত তাহাজ্জুদ, বাবুদ দু’আ ফি…….., মুসলিম:৭৫৮, আহমাদ: ৭৫৯৫, আ:প্র:১০৭৪, ইফা: ১০৭৯)


Posted ১১:১৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

Weekly Bangladesh |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

রমজান ও জাকাত
রমজান ও জাকাত

(685 বার পঠিত)

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
Dr. Mohammed Wazed A Khan, President & Editor
Anwar Hossain Manju, Advisor, Editorial Board
Corporate Office

85-59 168 Street, Jamaica, NY 11432

Tel: 718-523-6299 Fax: 718-206-2579

E-mail: [email protected]

Web: weeklybangladeshusa.com

Facebook: fb/weeklybangladeshusa.com

Mohammed Dinaj Khan,
Vice President
Florida Office

1610 NW 3rd Street
Deerfield Beach, FL 33442

Jackson Heights Office

37-55, 72 Street, Jackson Heights, NY 11372, Tel: 718-255-1158

Published by News Bangladesh Inc.