জাফর আহমাদ | বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
আল্লাহ তা’আলা ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন, কথা বলার শক্তি দান করেছেন, যাতে সৎ, ন্যায্য ও ভালো কথা বলি এবং অসৎ, অশালীন ও মন্দ কথা পরিহার করি। কথা বলার শক্তি দেয়া হয়েছে, তাই বলে অবলীলাক্রমে অশালীন, অশ্লীল ও অন্যায় কথা বলবেন না। মনে রাখতে হবে, আল্লাহর এই বিশেষ দানের কৃতজ্ঞতা আমরা এমন ভাবে পালন করবো যে, ন্যায় ও কল্যাণের কথা বলে বলে মৃত্যু বরণ করবো। ভাষার মাসে বাংলা ভাষা-ভাষিসহ পৃথিবীর সকল ভাষার লোকেরদের কাছে আবেদন, ভালো বলুন এবং আল্লাহর এই বিশেষ নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা এভাবেই আদায় করতে থাকুন। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “পরম দয়ালু (আল্লাহ) এ কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাকে কথা বলা শিখিয়েছেন।”(সুরা রাহমান ঃ ১-৪) মানুষ তার মতামত, চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি ইত্যাদি ভাষার সাহায্যে মৌখিক অথবা কাগজে-কলমে লিখিত আকারে প্রকাশ করে। আর এ সবই ‘আল্লামাহুল বায়ান’ এর অর্ন্তভুক্ত। তাছাড়া বিভিন্ন দেশ-জাতি ও ভুখণ্ড বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে থাকে এটিও আল্লাহ তা’আলার এ শিক্ষারই অর্ন্তভূক্ত। যেমন প্রথম মহামানব আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “এবং তিনি আদমকে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীর নাম শিক্ষা দিলেন।”(সুরা বাকারাঃ ৩১) এখানে পৃথিবীর সকল ভাষাও অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহর অসংখ্য দান ও করুণায় আমরা ডুবে আছি। তাঁর দান সমূহের মধ্যে ভাষা একটি বিশেষ ও সেরা দান। তাঁর প্রথম করুণা হলো, ‘তিনি আমাদেরকে মানুষ হিসাবে সৃষ্টি করেছেন’ তাঁর দ্বিতীয় করুণা ‘তিনি মনের ভাব, নিজের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করার জন্য এবং ভাল ও মন্দ, কল্যাণ ও অকল্যাণের মধ্য পার্থক্য নিরুপণ করার জন্য ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন’। তাঁর প্রতিটি দানই স্ব-স্ব স্থানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথাপি মানুষের বাকশক্তি এমন একটি বিশিষ্ট নিয়ামত ও গুণ যা মানুষকে জীবজন্তু ও পৃথিবীর অন্যান্য সৃষ্টিকুল থেকে আলাদা করে রেখেছে। এটি আল্লাহ তা’আলার কত বড় নিয়ামত তা কল্পনা করা যায় না। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সারা জীবন ভাষার ব্যবহারে পরিপূর্ণ। মানব শিশু ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর তার ক্রন্দনরোল এ পৃথিবীতে তার আগমনী বার্তা ঘোষনা করে তাও একধরনের ভাষা। এ মানব শিশু বড় হয়ে তার কৈশোর, যৌবন ও কর্মময় জীবনের প্রতিটি স্তরে তার অভিব্যাক্তি প্রকাশের বাহন হিসাবে ভাষার ব্যবহার করে থাকে।
আল্লাহ তা’আলা যে বাকশক্তি দান করেছেন এটি শুধু বাকশক্তিই নয় বরং এর পিছনে জ্ঞান ও বুদ্ধি, ধারনা ও অনুভূতি, বিবেক ও সংকল্প এবং অন্যান্য মানসিক শক্তি কার্যকর থাকে যে গুলো ছাড়া মানুষের বাকশক্তি কাজ করতে পারে না। এ গুলোর জন্য বই-পুস্তক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রচার-প্রোপাগান্ডা ও ধর্মীয় শিক্ষা, লেখা, বক্তৃতা বিতর্ক ও যুক্তি প্রমানের মত উপায় উপকরণকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে স্বীকার করে। শুধুমাত্র জন্মগত লব্ধ জ্ঞানকেই যতেষ্ট মনে করা হয় না। ভাষা ব্যবহারের যথার্থতা থাকতে হবে। যে কথা বা ভাষা নিজের জন্য বা দেশের জন্য কোন উপকারে আসে না সেটি ভাষা হতে পারে না। উল্লেখিত আয়াতে মানুষ সৃষ্টি ও ভাষা শিক্ষাদান করার আগেই কুরআনের কথা বলা হয়েছে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ক্রমানুসারে প্রথমেই মানুষ সৃষ্টি, দ্বিতীয়তঃ ভাষা জ্ঞান শিক্ষা এর পর কুরআন শিক্ষা দেয়ার কথা আসতে পারে। কিন্তু এ ক্রমধারা বজায় না রেখে প্রথমেই কুরআনের কথা বলে এ ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে যে, মানব সৃষ্টির আসল লক্ষ্যই হচ্ছে কুরআন শিক্ষা এবং কুরআন নির্দেশিত পথে চলা ও কুরআনের ভাষায় কথা বলা। যিনি মানুষ সৃষ্টি করলেন এবং তাকে কথা বলাও শিখালেন অথচ তার কথা বলার ধরণ কি হবে তা তিনি দেখাবেন না, এটা হতে পারে না। সৃষ্টি যার শিক্ষাও হবে তার। সৃষ্টি যেমন, শিক্ষাও হবে তেমন। সুতরাং যে সৃষ্টিকে ভাষা শেখানো হয়েছে তার জন্য ‘কুরআনই হতে পারে শিক্ষার উপযুক্ত মাধ্যম। মানুষ যদি আল-কুরআনকে বাদ দিয়ে অন্য কিছু শিখে তবে তাদের অবস্থা ঐ সৃষ্টিকুলের মতই হবে অথবা তাদের চেয়ে নিম্নতর হবে, যে সৃষ্টিকুলকে ভাষা জ্ঞান দেয়া হয়নি। সত্যিই তখন এ দুয়ের পার্থক্য নিরুপণ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ তখন নৈতিক জীবের যোগ্যতা ও মর্যাদা হারায়।
এ আয়াতগুলোর পরপরই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “সুর্য ও চন্দ্র একটি হিসেবের অনুসরণ করছে এবং তারকারাজি ও গাছপালা সব সিজদাবনত।”(সুরা রাহমান ঃ ৫-৬) মানুষ ছাড়া আল্লাহর সৃষ্টি লোকে সৌরজগত, জড়, জীব ও মৌলিক পদার্থ তথা যত সৃষ্টি রয়েছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রত্যেকের জন্য এক একটি নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন। মানুষ ছাড়া আর সকলের জন্য তিনি এ নিয়ম মানতে বাধ্যও করেছেন। অর্থাৎ সকলেই জন্মগত মুসলিম। আকাশ বাতাস, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, কীট-পতঙ্গ, গাছ-গাছালী, দিন-রাত্রি ও নদী-নালা তথা তাবত সৃষ্টি অবিরত তার সৃষ্টি কর্তার দেয়া নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলছে। এ সবের মধ্যে যদি ভারসাম্যতা প্রতিষ্ঠিত করা না হত অথবা মানুষের মত তার আপন ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হত, তাহলে এ বিশাল সৃষ্টি কারখানাটি এক মুহুর্তের তরেও চলতে পারত না। এক মুহুর্তের জন্য বিন্দু পরিমানও উচ্ছৃংখলতার অনুপ্রবেশ ঘটত তবে পৃথিবীতে জীবনের চিহ্ন মাত্র অবশিষ্ট থাকত না। সকলেই জন্মগত মুসলিম বিধায় আল্লাহ তাদের জন্য স্বতন্ত্রভাবে ভাষা ও জ্ঞান, বুদ্ধি, ধারনা, অনুভূতি, বিবেক ,সংকল্প এবং অন্যান্য মানসিক শক্তির প্রয়োজন নাই বিধায় দান করেন নি। কিন্তু মানুষ জাতিকে আল্লাহ রাব্বুল সুদৃঢ় ও কঠিন বন্ধনে আবদ্ব না করে তাদেরকে স্বাধীন বিবেক দান করেছেন। ভাল মন্দ যাচাই করার ক্ষমতা সম্পন্ন এ বিবেকের সামনে পেশ করা হয়েছে হেদায়াত। তারও আগে সৃষ্টির সূচনালগ্নে শিখানো হয়েছে ভাষা।
আল্লাহ তা’আলা মানুষকে ভাষা শিক্ষা দেয়ার মুল উদ্দেশ্য হলো, এর মাধ্যমে নিজের স্বাধীন বিবেককে আল্লাহর হিদায়াত তথা আল-কুরআনের আলোকে গড়ে তুলবে। উল্লেখিত সৃষ্টি জগতে আল্লাহর নিয়ম পুর্ণমাত্রায় বহাল থাকায় কোথাও যেমন বিশৃংখলার লেশমাত্র নাই, তেমনি মানুষ যদি তার সুস্থ বিবেকের সাহায্যে আল্লাহর দেয়া হিদায়াত তথা ইসলামী জীবন ব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পন করে, তবে অবশ্যই মনুষ্য জগতে শান্তি আর শৃংখলা প্রতিষ্ঠা হতে বাধ্য। মানুষের বিবেককে শক্তিশালী ও জাগ্রত করে অন্যান্য জগতের ন্যায় পরিপূর্ণ মুসলিম হিসাবে গড়ে তোলার জন্য আল-কুরআন দান করেছেন।
কিন্তু আপসোস ও দূর্ভাগ্য সে সমস্ত ভাষাবিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও লিখকগণের, যাদের দান করা হয়েছে সুন্দর করে লিখা ও কথা বলার শক্তি। যারা পৃথিবীর বিভিন্ন সৃষ্টির ওপর তাঁদের রচনাকৌশল ব্যবহার করে, মনের মাধুর্য ও রং মিশিয়ে কারুকাজ সম্বলিত সুন্দর সুন্দর গান-কবিতা ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করে থাকেন। কিন্তু যিনি তাকে ভাষা ব্যবহারের যোগ্যতা দান করলেন, তাঁকেই চিনতে কষ্টবোধ হয়। যে সমস্ত সৃষ্টিকে কেন্দ্র করে অনুপম রচনাশৈলী তৈয়ার করেন, সে সৃষ্টিটির মহান শিল্পীকেই তারা চিনতে পারে না। এদের সম্পর্কেই বলা হয়েছে যে, এরা শুধু পশুই নয়, বরং ক্ষেত্র-বিশেষ পশুর চেয়েও অধম। ভাষাহীন সত্তেও পশুটি তার প্রভুভক্ত হয়ে থাকে। অথচ এ সব ভাষাজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবি মানুষেরা আল্লাহর সৃষ্টিরই স্তুতি গায়, অথচ সে সুষ্টির স্রষ্টাকেই চিনতে পারে না। প্রজাপতির সুন্দর পাঁখার রংয়ের মেলায় এরা হারিয়ে যায় অথচ যিনি এত সুন্দর করে একে সাজালেন, সেই অনুপম মহান শিল্পী প্রকৌশলী যে কত সুন্দর, তা এদের লিখায় স্থান পায় না।
আল-কুরআন হলো সাহিত্যের সুউচ্চ মিনার। কুরআন মাজিদের প্রতিটি আয়াতে মানুষের অন্তর্র্নিহিত সৌন্দর্য চেতনার সাথে সাথে রয়েছে সাহিত্যের কারিশমা। সেখানে পশুত্বকে খতম করে মনুষত্বকে জাগ্রত করার অনুপম শিক্ষা নিহিত রয়েছে। আল-কুরআনের আলোকে গড়ে উঠা সাহিত্য ও সংস্কৃতি উন্নত জীবনবোধ ও আল্লাহর পথের ঠিকানা বলে দেয়। এ সাহিত্য এতটাই উন্নত যে, পৃথিবীর যে অধ্যায়ে সাহিত্যের চরম উৎকর্ষ ও উন্মেষ ঘটেছিল সে যুগের সাহিত্যিকগণও আল-কুরআনের ভাষা ও শিল্পশৈলীর কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল। সুতরাং আল-কুরআনের আলোকে নিজের প্রতিভাকে গড়ে তুলুন। আল কুরআন অনুযায়ী কথা বলুন এবং আল কুরআন অনুযায়ী লিখুন। দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত কল্যাণ আপনার জীবনকে ফুলে-ফলে সুশোভিত করে দিবে।
আল কুরআন হলো কালিমা তাইয়্যেবা বা পবিত্র কথা। প্রকৃতপক্ষে ভালো লিখা, ভালো বলা কালিমা তাইয়্যেবা বা পবিত্র কথারই অংশ। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “তুমি কি দেখছো না আল্লাহ কালিমা তাইয়েবার উপমা দিয়েছেন কোন জিনিষের সাহায্যে ? এর উপমা হচ্ছে যেমন একটি ভালো জাতের গাছ, যার শিকড় মাটির গভীরে প্রোথিত এবং শাখা-প্রশাখা আকাশে পৌঁছে গেছে। প্রতি মহুর্তে নিজের রবের হুকুমে সে ফলদান করে। এ উপমা আল্লাহ তা’আলা এ জন্য দেন যাতে লোকেরা এর সাহায্যে শিক্ষা লাভ করতে পারে। (সুরা ইবরাহিমঃ ২৪৫) একজন ম’ুমিন লিখক কালিমা তাইয়েবার ভিত্তিতে নিজের জীবন ব্যবস্থাকে গড়ে তুলেন। ফলে তার চিন্তাধারায় পরিচ্ছন্নতা, স্বভাবে প্রশান্তি, মেজাজে ভারসাম্য, চরিত্রে পবিত্রতা, আচরণে মাধুর্যতা, ব্যবহারে নম্রতা, লেনদেনে সততা, কথাবার্তায় সত্যবাদিতা, ওয়াদা ও অংগীকারে দৃঢ়তা, সামাজিক জীবন যাপনে সদাচার, কথা-বার্তায় চিন্তার ছাপ, চেহেরায় পবিত্রতার ভাব, বেশ-ভুষণে ও চেহেরায় পরিশীলিত ভাব ফুটে উঠার সাথে সাথে আল্লাহ অপার সৌন্দর্যের মহিমাও তার লেখায় উদ্ভাসিত হয়। যে জীবনধারার কোথাও কোন অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হবে না। এ ধরনের লেখক কখনো এলোকেশে, এলোমেলো ও এলোপাতাড়ি হতে পারে না। এ ধরনের ব্যক্তির মুখ থেকে সর্বদা মধু বাক্য ঝড়বে, অন্যের কান যেটিকে শ্রুতিমধু বা মধুরবাণী হিসাবে গ্রহণ করবে। তার লিখায় বা বলায় কখনো অশ্লীলতা, তিরস্কার, ব্যঙ্গোক্তি, অবজ্ঞা, দাম্ভিকতা, গর্ব-অহংকার, কটুক্তি, দম্ভোক্তি, কুৎসা রটনা, হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা ও তুচ্ছজ্ঞান স্থান পাবে না। কারণ এ গুলো কালিমা তাইয়েবার সম্পুর্ণ বিপরীতমুখী। এ গুলোকে আল্লাহ ‘কালিমাতুল খাবীসা’ বা অসৎ বাক্যের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। “অন্যদিকে অসৎ বাক্যের উপমা হচ্ছে, একটি মন্দ গাছ, যাকে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপড়ে দূরে নিক্ষেপ করা হয়, যার কোন স্থায়িত্ব নেই।”(সুরা ইবরাহিমঃ ২৫) সুতরাং কালিমা তাইয়্যেবার ভিত্তিতে আপনার প্রতিটি লেখাকে গড়ে তুলুন। আর জীবনের মুল্যবোধের ঠিকানা বা স্বাধ পেতে পেতে হলে আল্লাহর ভাষাতেই কথা বলতে হবে এবং তাঁর ভাষাতেই লিখতে হবে। এতে আপনার চার পাশ যেমন মোহিত হবে, তেমনি আপনার ব্যক্তিত্বও চারদিকে শোভা ছড়াবে।
Posted ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh