জাফর আহমাদ | বৃহস্পতিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
রজব মাস এলে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল, মসজিদের জু’মার খুৎবায় মিরাজুন নবী সা: আলোচনা চলে। বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকাগুলোতে লিখক, কলামিষ্ট ও শায়খদের প্রবন্ধ নিবন্ধ ও কলাম প্রকাশিত হয়। রজব চলে গেলে এই আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। এই সবগুলো আলোচনার সারমর্ম হলো. মিরাজের বাস্তবতার প্রমাণ পেশ করা, স্বশরীরে না কি স্বপ্নযোগে, চলে যুক্তির পালা, কেউ বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা পেশ করেন, কেউ বৈজ্ঞানিক যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করেন যে মিরাজ স্বশরীরে হয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, পনেরশত বৎসর যদি চলে যায় মিরাজকে প্রমাণ করতেই তাহলে মিরাজের শিক্ষা কখন শুনবো? মিরাজ কি শুধু শুধুই আল্লাহর রাসুল সা: এর জীবনে স্্েরফ একটি মো’যেযাই থেকে যাবে ? কেন আল্লাহ তা’আলা তাঁর নবীকে তাঁর সান্নিধ্যে ডেকে নিয়েছিলেন? সেখান থেকে তিনি উম্মতের জন্য কি ম্যাসেজ নিয়ে এসেছিলেন? সেই ম্যাসেজগুলো কি ধরণের? আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এগুলোর কার্যকারিতা কি? এতগুলোর প্রশ্নের উত্তর আমরা কবে, কখন এবং কিভাবে জানতে পারবো। শুধু মিরাজের যুক্তি-তর্ক শুনতে শুনতেই আমরা পনেরশত বৎসর পার করে দিলাম।
সুপ্রিয় মুসলমান! মিরাজের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার জন্যই মূলত:কোন চক্রান্তকারী আমাদের মধ্যে এই বিতর্ক ঢুকিয়ে দিয়েছে। যার ফলে আমরা মিরাজের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। মিরাজের শিক্ষা শুধু পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নয়। আরো বিস্তুৃত শিক্ষা রয়েছে। নিচে শিক্ষাগুলো সুরা বনী ইসরাঈলের আলোকে পেশ করা হলো।
মিরাজ আল্ল¬াহর রাসুলের (সাঃ) নবুয়তী জীবনের এক অবিস্বরণীয় ঘটনা। তাঁর অসংখ্য মু’যেযার মধ্যে এটি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই করুক মিরাজ স্ব-শরীরেই হয়েছে। কারণ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য প্রাকৃতিক-অপ্রাকৃতিক, সম্ভব-অসম্ভব বলতে কোন কিছুই নেই, কারণ প্রাকৃতিক-অপ্রাকৃতিক, সম্ভব-অসম্ভব সবই তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি প্রত্যেক জিনিসের ওপর শক্তিশালী। তাছাড়া আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসুল (সাঃ) এর দ্বারা এ ধরনের বহু অপ্রাকৃতিক ঘটনা ঘটিয়েছেন। চন্দ্র দ্বি-খন্ডসহ অনেক মু’জেজাই তাঁর দ্ধারা প্রকাশিত হয়েছে। এ গুলো নবুয়তী জিন্দিগীর একটা বৈশিষ্ট্য। প্রথম মহামানব প্রথম নবী হযরত আদম (আঃ) থেকে নিয়ে শেষ নবী মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সঃ পর্যন্ত প্রায় সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবনেই এ রকম ঘটনা রয়েছে। সুতরাং এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি করা একান্তই বোকামী ও বেহুদা একটা কাজ। বর্তমান বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার যুগে এ তর্ক অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে তর্ক-বিতর্কের ধুম্রজালে ইসলামের কোন ক্ষতি না হলেও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মুসলমান। আমরা যারা রাসুলের মিরাজকে স¤পূর্ণভাবে বিশ্বাস করি, তারা মিরাজের সঠিক শিক্ষা থেকে অনেক দুরে অবস্থান করছি। আমাদের বিশ্বাসীদের অনেকেই সুললিত কন্ঠে ঘন্টার পর ঘন্টা মিরাজের ঘটনা অনেকটা ট্রেডিশনাল মুখরোচক কিস্সা বা কল্প-কাহিনীর মতোই বর্ণনা করে থাকি। এতে লোকজন সাময়িক পুলকিত হয় বটে। কিন্তু এর প্রকৃত শিক্ষা বর্ণনা করা হয় না বিধায় এটি একটি ট্রেডিশনাল কিস্সা-কাহিনীর মর্যাদা পেতে বসেছে। মিরাজ আল-কুরআনের কোন সুরায় বর্ণিত হয়েছে? আর কেনই বা আল্ল¬াহ রাব্বুল আলামীন মিরাজের একটি মাত্র আয়াত সুরা বণী ইসরাঈলের প্রথম ছত্রেই সন্নিবেশিত করলেন? এ সুরার অন্যান্য আয়াতের সাথে এর কি কোনই সম্পর্ক নেই? এত গুলোর প্রশ্নের উত্তর আমাদের সাধারণ মুসলমান থেকে শুরু করে আল কুরআনের ধারক-বাহক বলে মানুষ যাদেরকে মনে করেন, তাদের মুখেও তেমন একটা শোনা যায় না। ফলে মিরাজের সঠিক শিক্ষা থেকে আমরা যুগ যুগ ধরে বঞ্চিতই হয়ে এসেছি।
মিরাজ অর্থ উর্ধে গমন। মিরাজের আর এক নাম ‘ইসরা’ অর্থাৎ রাতে ভ্রমণ করা। যেহেতু রাসুলের সঃ এ ভ্রমণ উর্ধমুখী হয়েছিল এবং তা রাতেই হয়েছিল, তাই দুটি নামই যুক্তিযুক্ত। যেমন আল্ল¬াহ তা’আলা বলেন: “পবিত্র তিনি যিনি নিয়ে গেছেন এক রাতে নিজের বান্দাকে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্সা পর্যন্ত, যার পরিবেশকে তিনি বরকতময় করেছেন, যাতে তাকে কিছু নিদর্শন দেখান। আসলে তিনিই সব কিছুর শ্রোতা ও দ্রষ্টা।”(বণী ইসরাঈলঃ১) আল কুরআনের এ একটিমাত্র আয়াতে মিরাজের বর্ণনা রয়েছে। বিস্তারিত ঘটনা স্বয়ং রাসুল সঃ জবানীতে বর্ণিত হয়েছে, যা বিভিন্ন সহিহ হাদীস গ্রন্থাবলীতে সন্নিবেশিত আছে।
মিরাজের তাৎপর্য: যেহেতু পৃথিবীর দীর্ঘকাল ব্যাপী চলে আসা বণী ইসরাঈল জাতির নেতৃত্বকে খতম করে রাসুল সঃ এর হাতে নেতৃত্বের ভার তুলে দেয়া হবে এবং যেহেতু সেটি কোন ছোট-খাট ব্যপার ছিল না। সেহেতু নেতৃত্বদানকারী সে ব্যক্তিটিকে তাঁর মুল মালিক, যিনি তাঁরই প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করবেন, তাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া হবে না এবং তাকে নেতৃত্বের কিছু টিপস্ বা পলিসি বলে দেয়া হবে না তা কি করে হয়। তাই সাইয়েদুল কাউনাইন, রাহমাতুল লিল আলামীনকে মহান প্রভুর দরবারে ডেকে পাঠান। এ বিরাট কাজের আঞ্জাম দেয়ার জন্য তাঁর দরকার বিরাট মানের ঈমান ও সুদৃঢ় বিশ্বাস। তাই আখিরাতের বিরাট জীবন তাঁকে প্রত্যক্ষ করানো হয়। সেখান থেকে নিয়ে আসেন বিশ্ব পরিচালনার এক বিশেষ ধরনের শিক্ষা। মনে রাখা প্রয়োজন, বনী ইসরাঈলদের পরিচালনার জন্য তাঁদেরই এক প্রসিদ্ধ নবী হযরত মুসা (আ:) কে আল্ল¬াহ রাব্বুল আলামীন তুর পাহাড়ের পাদদেশে ডেকে নিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনিও নিয়ে এসেছিলেন নেতৃত্বের বিশেষ শিক্ষা। মিরাজের পর মক্কার কাফেররা মুহাম্মদ সঃ এর সাথে যে ধরনের আচরণ করেছিল, সেদিন মুসা আঃ এর সাথে তাঁর জাতির লোকেরা ঠিক একই আচরণ করেছিল। ফলে তাদেরকে আজ নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে উম্মতে মুহাম্মদীর হাতে তা অর্পন করা হলো।
সুরায়ে বণী ইসরাঈলের প্রথম আয়াত পর্যন্ত মনোনিবেশ সহকারে পড়ুন এবং ভালভাবে বুঝার চেষ্টা করুন। তাহলে মিরাজের প্রকৃত তাৎপর্য দিবালোকের মতো আপনার চিন্তা-চেতনায় ভিন্ন মাত্রা যোগ হবে ইনশা’আল্লাহ। সুরা বনী ইসরাঈল বা সুরাতুল ইসরার প্রথম একটিমাত্র আয়াতে মেরাজের ঘটনা বর্ণনা করার পর ইহুদীদের দুস্কৃতি বর্ণিত হয়েছে। মক্কার কুরাইশদের এ হেদায়াত দেয়া হয়েছে যে, তাওহীদের কথা এমন একজন ব্যক্তি বলেছেন যিনি এই মাত্র আল্লাহর বিরাট মহামান্বিত নিদর্শনসমুহ দেখে এসেছেন। এরপর বণী ইসরাঈলের ইতিহাস থেকে এ মর্মে শিক্ষা দেয়া হয় যে, আল্ল¬াহর পক্ষ থেকে কিতাব লাভকারীরা যখন আল্ল¬াহর মোকাবিলায় ময়দানে নেমে পড়ে তখন দেখো তাদের কেমন ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেয়া হয়। এখন আল্ল-াহ তা’আলা এ অভিশপ্ত জাতিকে পৃথিবীর নেতৃত্বের আসন থেকে সরিয়ে তোমাদেরকে সে আসনে বসাতে চান। তোমরাও যদি বণী ইসরাঈলের মতই আচরণ করতে থাকো তবে ইসলামেী নেতৃত্বের প্রভাত সুর্যের ক্ষীণ যে আলোটুকু পূর্বাকাশে দেখা দিচ্ছে, তা আবার ফিরিয়ে নিয়ে আবার অন্ধকার জগতে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। সুতরাং বাঁচতে হলে বিশ্বমানবতার নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলী অর্জন করো। এ সমস্ত গুণাবলী বা মুলনীতি মিরাজের ঘটনার পর এ সুরারই ২৩ থেকে ৩৭ নং আয়াতসমুহে বর্ণিত হয়েছে।
যেমন আল্ল¬াহ তা’আলা বলেন:-
১)“তোমরা কারোর ইবাদাত করো না, একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করো।”
২) “পিতামাতার সাথে ভাল ব্যবহার করো। যদি তোমাদের কাছে তাদের কোন একজন বা উভয় বৃদ্ধ অবস্থায় থাকে, তাহলে তাদেরকে ‘উহ’ পর্যন্তও বলো না এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিয়ো না বরং তাদের সাথে মর্যাদা সহকারে কথা বলো। আর দয়া ও কোমলতা সহকারে তাদের সামনে বিনম্র থাকো এবং দোওয়া করতে থাকো এই বলেঃ হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা দয়া, মায়া, মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন। তোমাদের রব ভালোই জানেন তোমাদের মনে কি আছে। যদি তোমরা সৎকর্মশীল হয়ে জীবন যাপণ করো, তাহলে তিনি এমন লোকদের প্রতি ক্ষমাশীল যারা নিজের ভুলের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে বন্দেগীর নীতি অবলম্বন করার দিকে ফিরে আসে।”
৩)“আত্মীয়কে তার অধিকার দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকেও তাদের অধিকার দাও।”
৪)“ বাজে খরচ করো না। যারা বাজে খরচ করে তারা শয়তানের ভাই আর শয়তান তার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ।”
৫)“যদি তাদের থেকে (অর্থাৎ অভাবী আত্মীয়-স্বজন, মিসকীন ও মুসাফির) তোমাকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয় এ জন্য যে, এখনো তুমি আল্লাহর প্রত্যাশিত রহমতের সন্ধান করে ফিরছো, তাহলে তাদেরকে নরম জবাব দাও।’
৬)“নিজের হাত গলায় বেঁধে রেখো না এবং তাকে একেবারে খোলাও ছেড়ে দিয়ো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অক্ষম হয়ে যাবে।”
৭) “দারিদ্রের আশংকায় নিজেদের সন্তান হত্যা করো না। আমি তাদেরকেও রিযিক দেবো এবং তোমাদেরকেও। আসলে তাদেরকে হত্যা করা একটি মহাপাপ।”
৮) “যিনার কাছেও যেয়ো না, এটা অত্যন্ত খারাপ কাজ এবং খুবই জঘন্য পথ।”
৯)“আল্ল¬াহ যাকে হত্যা করা হারাম করে দিয়েছেন, সত্য ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করো না। আর যে ব্যক্তি মজলুম অবস্থায় নিহত হয়েছে তার অভিভাবককে আমি কিসাস দাবী করার অধিকার দান করেছি। কাজেই হত্যার ব্যাপারে তার সীমা অতিক্রম করা উচিত নয়, তাকে সাহায্য করা হবে।”
১০)“ এতিমের সম্পত্তির ধারে কাছে যেয়ো না, তবে হাঁ সদুপায়ে, যে পর্যন্ত না সে বয়োপ্রাপ্ত হয়ে যায়।”
১১)“প্রতিশ্রুতি পালন করো, অবশ্যই প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে।”
১২)“মেপে দেয়ার সময় পরিমাপ পাত্র ভরে দাও এবং ওজন করে দেবার সময় সঠিক দাঁড়িপাল্ল¬ায় ওজন করো। এটিই ভালো পদ্ধতি এবং পরিণামের দিক দিয়েও এটিই উত্তম।”
১৩) “এমন জিনিসের পিছনে লেগে যেয়োনা যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই। নিশ্চিতভাবেই চোখ, কান ও দিল সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”
১৪) “যমীনে দম্ভভরে চলো না। তুমি না যমীনকে চিরে ফেলতে পারবে, না পাহাড়ের উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারবে।” (বণী ইসরাঈল ঃ ২৩-৩৭)
এ চৌদ্দটি মুলনীতি মুলত: ইসলামী রাষ্ট্রের মেনিফেষ্টো। এ মূলনীতিগুলোর ওপর ভিত্তি করে ইসলামী রাষ্ট্রের কাঠামো গড়ে তোলার জন্য মেরাজের রাত্রিতে আল্ল¬াহ তা’আলা তাঁর প্রিয় বান্দাহকে দান করেছেন। তাছাড়া রাসুল সঃ যাতে নৈতিকতা সম্পন্ন একদল যোগ্য নেতুত্ব গড়ে তুলতে পারেন সে জন্য আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন পাঁচ ওয়াক্ত সালাতও ফরয করে দিলেন। এ মুলনীতিগুলো গ্রহণ করে আল্ল¬াহর জমীনে আল্লাহরই দেয়া জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মিরাজের সঠিক শিক্ষা আমাদের গ্রহণ করতে হবে।
Posted ১১:২৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh