জাফর আহমাদ | বৃহস্পতিবার, ০৭ মার্চ ২০২৪
ঐ এলো আল্লাহর অবারিত রহমত,বরকত ও মাগফিরাতের বারতা নিয়ে মাহে রমযান। খোশ আমদেদ মাহে রমযান। চারদিকে চলছে মুমেন-মুসলিমের মহা-আনন্দের বিশাল প্রস্তুতি। আর কয়টা দিন পর মু’মিন-মুসলমানের উপর নাযিল হবে আল্লাহর রহমতের বৃষ্টিধারা। মুষলধারে রহমতের এ বৃষ্টিতে প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ের আঙিনায় প্রবাহিত হবে। তাই চলছে জোর মানসিক ও অন্যান্য প্রস্তুতি । আর দু’হাত তুলে দু’আ করছে ‘হে আল্লাহ! রজব ও শা’বানে আমাদের বরকত দাও ও রমযানে আমাদের পৌঁছে দাও।’
অন্যদিকে আর একটি দল অধির আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে অপেক্ষা করছে রমযানের জন্য। তারা হলো, অপ্রতিরোধ্য অবৈধ মজুতদার, মুনাফাখোর ও কালোবাজারী ও খাদ্যে ভেজাল মিশ্রিতকারীরা। তাদের মধ্যেও আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কারণ এ মাস তাদের সারা বৎসরের মুনাফা লুটে নেয়ার মাস। পশুর উদরটিকে ফূর্তি করার এর চেয়ে ভালো সময় সুযোগ, এর চেয়ে সুন্দর মাস আর একটিও নেই। মুমেন-মুসলমানকে জিম্মি বা বোকা বানিয়ে লুটে নেয়ার এটিই তো অত্যন্ত সুসময়। তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতা যেন রাষ্ট্র শক্তিরও নেই। প্রতি বৎসর একই চিত্র আমাদের সামনে ঘুরে আসে। দেশের মিডিয়াগুলোকে তারা খুব কমই পরোয়া করে। সরকার নামকাওয়াস্তে দু-একটি বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। মাঝে মধ্যে এমন খবরও বেরোয় যে, বিবৃতিবাজরা রাতের আধারে এসব মুনাফাখোরদের মাসোয়ারা পেয়ে থাকে। দিনেব বেলায় এরাই জনগণের বন্ধু সেজে মায়াকান্নার ভান ধরে।
আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের ব্যবসায়ী ভাইদের অধিকাংশই মুসলমান। এ-ও বিশ্বাস করি যে, তারা রমযানে আল্লাহর রহমত, বরকত ও মাগফিরাত কামনা করেন। তাই তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে, রমযান মাসের একটি ফরয ৭০টি ফরযের সমান হয়ে থাকে এবং একটি নফল একটি ফরযের সমান হয়ে থাকে। বুখারী শরীফে ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বাপেক্ষা বেশী দানশীল ছিলেন। তাঁর দানের মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পেতো রমযানে যখন জিবরাইল আমিনের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হতো। জিবরাঈল আ: রমযানের প্রতি রাতে তাঁর সাথে দেখা করে কুরআনের সবক দিতেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কল্যাণ বন্টনে প্রবাহিত বাতাসের চেয়েও বেশী দানশীল তখন তাঁর দানের কোন সীমা-পরিসীমা থাকতো না।” (বুখারী:৩৫৫৪, আ. প্র: ৩২৯০, ই.ফা: ৩২৯৯, কিতাবুল মানাকিব, বাবু সিফাতিন নাবী) । তাহলে এ মাসের ফরয আমল ৭০ গুণ বৃদ্ধি করে ব্যক্তির আমলনামায় জমা করা হয়। আমাদের সস্মানিত ব্যবসায়ী ভাইগণ যদি রোযাদারদের সহযোগীতার কথা চিন্তা করে এগারো মাসের তুলনায় রমযানে দ্রব্যমূল্য কিছুটা কমিয়ে দেন বা একান্তই সম্ভব না হলে অন্তত স্থিতিশীল রাখেন, তবে আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে, যতটুকু লোকসান বা যতটুকু মুনাফা করার সুযোগ ছিল, তা না করার কারণে আল্লাহ তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দুনিয়া ও কাল কিয়ামতের কঠিন দিনে দান করবেন। পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশসমূহে এই কালচার আবহমানকাল থেকে চলে আসছে। সারা বৎসর তারা ব্যবসা করে কিন্তু রমযান এলে তারা তাদের দ্রব্যমূল্যে ছাড় দেয়ার প্রতিযোগীতায় নামে। দুবাই, সৌদি, কাতার, কুয়েত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশে চলছে ‘পণ্যেও মূর্য ছাড় দেয়ার প্রতিযোগীতা। এমন কি কোন কোন অমুসলিম দেশেও রোযাদারদের সম্মানে পণ্য-সামগ্রীর মূল্য ছাড় দিয়ে থাকে। ব্যতিক্রম শুধু আমাদের এই বাংলাদেশ-এ।
ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ¢ যাকাত, এটি যে কোন মাসে হিসাব করে আদায় করা যায়। তথাপি রমযানকে বিশেষভাবে নির্ধারণ করার কারণ হলো ৭০ গুণ অতিরিক্ত ফায়েদা পাওয়া। এমনিভাবে আল্লাহর পথে, আত্মীয় স্বজনদের জন্য, গরীব দু:খীদের জন্য, এতিমদের জন্য অসহায় মানবতার জন্য যতবেশী খরচ করা হবে, ততবেশী তার নিজের উপকারে আসবে। আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে যে, আল্লাহর পথে একটি পয়সা, একটি শস্য, একটি দানার বিনিময়ে কমপক্ষে সাত শত গুণ প্রতিদান দেয়া হবে। এর পর বলা হয়েছে এর চেয়েও অধিক দেয়া হবে। এই প্রেক্ষিতে রমযানের যদি নিত্যপণ্য সামগ্রী মূল্য বৃদ্ধি স্থিতিশীল রাখা হয়, অবশ্যই আল্লাহ তাদের ব্যবসায় বরকত দিবেন।
আমাদের ব্যবসায়ীগণ যদি বিশ্বাস করেন যে, ‘আল্লাহু বাছিরুম বিল ইবাদ’ ও ‘সামিউম বাছির’ অর্থাৎ ‘মহান আল্লাহ বান্দার সবকিছু গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেন, তিনি শুনেন দেখেন’, তাহলে কি করে তারা রমযান এলেই দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেন, কি করে তারা খাদ্যের সাথে ভেজাল মিশ্রিত করেন, কেন রোযাদার মু’মিনকে কষ্ট দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা করেন? তারা যদি রোযাদার হন. তাহলে তাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রোযা আপনাকে কি শিখায় ? আমরা তো জানি, রোযাদার সারা দিনের ক্ষুধা-পিপাসার দু:সহ জ্বালা নিবারণের সুযোগ থাকা সত্বেও আল্লাহ ‘দেখেন’ এ নামের ভয়ে সে সুযোগ গ্রহণ করে না। অবিরত ও ক্রমাগত একটি মাস এ ট্রেনিংয়ের ফলে আল্লাহর অন্যান্য সিফাতি নাম সমুহের কার্যকারিতা এমনভাবে হৃদয়ের গভীরে অঙ্কিত হয় যে বাকি ১১টি মাস সকল প্রকার গুনাহ থেকে বিরত থাকতে পারে। এমনিভাবে একজন মু’মিন আল্লাহর প্রতি এ ঈমান পোষণ করে যে তিনি রাজ্জাক, তিনি যাকে ইচ্ছা অপরিমিত সম্পদ তান করেন। আমাদের মুসলিম ব্যবসায়ীগণও যদি এ ধরণের ঈমান পোষণ করে থাকেন, তবে আমার প্রশ্ন, কেন আপনি রোযাদারকে শোষণ করেন?
তাহলে প্রথমেই আমরা এর উত্তরে বলতে পারি, আপনাদের ঈমানে বহুত গলতি আছে। দ্বিতিয়ত: রোযা পালনসহ অন্যন্যা ইবাদাতগুলো আপনাদের কোনই উপকারে আসেনি। কারণ রিযিকের মালিক আল্লাহর চেয়ে নিজেদের ব্যবসাকেই অধিক শক্তিশালী মনে করেছেন। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সব কিছুর ওপর অধিক শক্তিশালী। (সুরা আল ইমরান:২৬)
রমযানের মূল শিক্ষা তাকওয়া তথা আল্লাহকে ভয় করার গুণটি উজ্জীবিত করা। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা আমাদের শক্তিশালী তিনটি হাতিয়ার যথা: খাদ্য, যৌন ও পরিশ্রমের পর বিশ্রাম প্রবৃত্তিকে ক্রমাগত একটি মাস নিয়ন্ত্রণের দ্ধারা এমন এক শক্তি অর্জন করি যার নাম নাম তাকওয়া, যার মাধ্যমে নিজের দেহমন এবং সময়কে প্রভুর জন্য সোপর্দ করে দেই। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন,সামাজিক আচার-–আচরণ, উঠা-বসা ও কথা-বার্তা প্রতিটি বিষয় নিজের প্রভুর বন্দেগীর জন্য ওয়াকফ করে দেই। এ ধরণের ব্যক্তির সমস্ত ধন-সম্পদ এবং নিয়ামত হোক তা শারীরিক বা আত্মীক সে তা আল্লাহর পথে নিয়োগ করবে। এগুলোই তাকওয়ার গুণাবলীী। আল কুরআনের শুরুতেই এ মুত্তাকীদের কয়েকটি গুণের অন্যতম একটি গুণ হলো: ‘আল্লাহ যে ধন-সম্পদ দান করেছেন তা থেকে খরচ করা’। আর ধন-সম্পদ তারাই দান করতে পারে যারা সহানুভুতিশীল। যে ব্যক্তির ভেতর সহানুভুতি বা ভ্রাতৃত্ববোধ নেই তার ঈমানে ত্রুটি আছে। কারণ ঈমানদারদের একটি সার্টিফিকেট আল্লাহ স্বয়ং কুরআনে পেশ করেছেন। তিনি বলেন,“ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার স্ত্রীলোকেরাই প্রকৃতপক্ষে পরস্পরের দায়িত্বশীল বা সাহায্যকারী বন্ধু। এদের বৈশিষ্ট্য এই যে, এরা নেক কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে আল্লাহ ও রাসুলের বিধান মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে এদের প্রতিই আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন।” (সুরা তাওবা:৭১) আমরা রোযার মাধ্যমে ক্ষুৎ পিপাসায় কষ্ট করছি, তেমনিভাবে বিপুল খরচের মাধ্যমে আমাদের পকেটকেও কষ্ট অনুভব করানোর চেষ্টা করছি। তাই অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসে আমাদের খরচের পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন। আমাদের ব্যবসায়ীবৃন্দকেও খাদ্যে ভেজাল মিশ্রিত না করে এবং দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি না করে স্থিতিশীল রাখার অনুরোধ করছি। আল্লাহ আপনাদের ব্যবসায় অবশ্যই বরকত দান করবেন।
Posted ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৭ মার্চ ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh