বাংলাদেশ ডেস্ক | বুধবার, ২৪ জানুয়ারি ২০২৪
নতুন কারিকুলামে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা অধ্যায়ের ‘শরীফার গল্প’ শিরোনামে গল্প নিয়ে এ মুহূর্তে আলোচনা-সমালোচনা চলছে দেশজুড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি আরও গভীরভাবে পর্যালোচনা করে এনিসিটিবিকে সহায়তা করার জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বুধবার মন্ত্রণালয়ের গঠিত এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আব্দুর রশীদকে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর মুফতি মাওলানা কফিল উদ্দীন সরকার, এনসিটিবির সদস্য মশিউজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের পরিচালক এবং ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ। এর আগে পাঠ্যবইয়ে ‘শরীফা’ গল্পটির উপস্থাপনে যদি কোনো বিতর্ক বা বিভ্রান্তি হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
তবে দেশে ধর্মকে ব্যবহার করে একটি গোষ্ঠীর অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রবণতা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ‘শরীফা’ গল্পটি নিয়ে গতবারও বিতর্ক উঠেছিল, এ প্রসঙ্গে গত মঙ্গলবার মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সেটা এনসিটিবির সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করব। যদি গল্পটির মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া হয়, কেন হচ্ছে সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।’ ‘ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সে শিক্ষকের বিষয়টি ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব’- এমনটা বলে মহিবুল হাসান আরও বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে জানব ঘটনা কী ঘটেছিল।সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা একটি ভিডিও দেখেছি।’
কী আছে আলোচিত শরীফার গল্পে
ক’দিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের একটি অধ্যায়ে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কিত একটি পাঠ নিয়ে তুমুল ব্তির্ক। বিতর্কের মূলে রয়েছে একটি শব্দ ‘ট্রান্সজেন্ডার’। বইয়ের ওই পরিচ্ছেদে ‘শরীফার গল্প’ শিরোনামে সামাজিক সুবিধাবঞ্চিত হিজড়া জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার কথা উঠে আসে। পুরুষ হয়ে জন্ম হওয়া শরীফ একটা সময় বুঝতে পারে সে পুরুষ নয়। সে নিজেকে নারী ভাবে। একসময় সে জানতে পারে তার মতো মানুষদের থার্ডজেন্ডার বলা হয়। তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ও অবহেলিত হয়ে বসবাস করে।
‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ বিষয়ক অধ্যায়ের ওই গল্পে শরীফার বয়ানে বলা হয়, ‘‘ছোটবেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলত। কিন্তু আমি নিজে একসময় বুঝলাম, আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে। আমি মেয়েদের মতো পোশাক পরতে ভালোবাসতাম। কিন্তু বাড়ির কেউ আমাকে পছন্দের পোশাক কিনে দিতে রাজি হতো না। বোনদের সাজবার জিনিস দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সাজতাম। ধরা পড়লে বকাঝকা, এমনকি মারও জুটত কপালে। মেয়েদের সঙ্গে খেলতেই আমার বেশি ইচ্ছে করত। কিন্তু মেয়েরা আমাকে খেলায় নিতে চাইত না। ছেলেদের সঙ্গে খেলতে গেলেও তারা আমার কথাবার্তা, চাল-চলন নিয়ে হাসাহাসি করত। স্কুলের সবাই, পাড়াপড়শি—এমনকি বাড়ির লোকজনও আমাকে ভীষণ অবহেলা করত। আমি কেন এ রকম, এ কথা ভেবে আমার নিজেরও খুব কষ্ট হতো, নিজেকে ভীষণ একা লাগত।
একদিন এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো, যাকে সমাজের সবাই মেয়ে বলে; কিন্তু সে নিজেকে ছেলে বলেই মনে করে। আমার মনে হলো, এই মানুষটাও আমার মতন। সে আমাকে বলল, আমরা নারী বা পুরুষ নই, আমরা হলাম তৃতীয় লিঙ্গ (থার্ড জেন্ডার)। সেই মানুষটা আমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল, যেখানে নারী-পুরুষের বাইরে আরও নানা রকমের মানুষ আছেন। তাঁদের বলা হয় ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠী। তাঁদের সবাইকে দেখেশুনে রাখেন তাঁদের ‘গুরু মা’। আমার সেখানে গিয়ে নিজেকে আর একলা লাগল না, মনে হলো না যে আমি সবার চেয়ে আলাদা। সেই মানুষগুলোর কাছেই থেকে গেলাম। এখানকার নিয়মকানুন, ভাষা, রীতিনীতি আমাদের বাড়ির চেয়ে অনেক আলাদা। আমরা সবার সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়ে একটা পরিবারের মতনই থাকি। বাড়ির লোকজনের জন্যও খুব মন খারাপ হয়। তাই মাঝে মাঝে বাড়িতেও যাই।
আজ থেকে ২০ বছর আগে বাড়ি ছেড়েছি। সেই থেকে আমি আমার নতুন বাড়ির লোকদের সঙ্গে শহরের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে, নতুন শিশু আর নতুন বর-বউকে দোয়া-আশীর্বাদ করে পয়সা রোজগার করি। কখনো কখনো লোকের কাছে চেয়ে টাকা সংগ্রহ করি। আমাদেরও ইচ্ছে করে সমাজের আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন কাটাতে, পড়াশোনা, চাকরি-ব্যবসা করতে। এখনো বেশির ভাগ মানুষ আমাদের সঙ্গে মিশতে চায় না, যোগ্যতা থাকলেও কাজ দিতে চায় না। তবে আজকাল অনেক মানুষ আমাদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। ইদানীং আমাদের মতো অনেক মানুষ নিজ বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করছে। আমাদের মতো মানুষ পৃথিবীর সব দেশেই আছে। অনেক দেশেই তারা সমাজের বাকি মানুষের মতনই জীবন কাটায়। তবে আমাদের দেশের অবস্থারও বদল হচ্ছে। ২০১৩ সালে সরকার আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমাদের জন্য কাজ করছে। শিক্ষার ব্যবস্থা করছে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর প্রচেষ্টা নিচ্ছে। নজরুল ইসলাম ঋতু, শাম্মী রানী চৌধুরী, বিপুল বর্মণের মতো বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষ সমাজজীবনে এবং পেশাগত জীবনে সাফল্য পেয়েছেন।’’
বইয়ের শরীফার এই গল্পের শেষে কর্মক্ষেত্রে সফল কয়েকজন হিজড়ার ছবি দেওয়া হয়েছে। শরীফা তার পুরনো স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিজের গল্প শেয়ার করেন। শরীফার গল্প বলার পর বলা হয়েছে, ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা এত দিন জানত, মানুষ ছেলে হয় অথবা মেয়ে হয়। এখানেও যে বৈচিত্র্য থাকতে পারে, সে কথা ওরা কখনো শোনেনি, ভাবেওনি। কিন্তু শরীফা আলাদা রকম বলে সবাই তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, এমনকি তার পরিবারের লোকেরাও! শরীফার জীবনকাহিনি শুনে সবার মন এমন বিষাদে ভরে গেল যে তাকে আর বেশি প্রশ্ন করতেও ইচ্ছে করল না।
মূলত এই গল্পে গতবছরের বইয়ে থার্ডজেন্ডারের পরিবর্তে ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি লেখা হয়েছিল। পরবর্তী নানান আলোচনা সমালোচনার পর এ বছর সেটা সংশোধন করে থার্ডজেন্ডার লেখা হয়েছে। তবে এরপরও এই গল্প নিয়ে বিতর্ক থামেনি। গল্প বলার ঢং নিয়ে উঠছে আপত্তি। তাছাড়া সরকারি ওয়েবসাইটে থাকা পাঠ্য বইয়ের অনলাইন ভার্সনে এখনো ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি রয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় শিক্ষক ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত এক সেমিনারে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ মাহতাব এ নিয়ে বক্তব্য দেন। এক পর্যায়ের পাঠ্য বইয়ের আলোচিত শরীফার গল্পে ট্রান্সজেন্ডারের আলোচনা আছে দাবি করে গল্পের অংশের পাতা ছিড়ে ফেলেন। পরবর্তী তার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনার পর রবিবার রাতে (২১ জানুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাকে আনঅফিসিয়ালি অব্যহতি প্রদানের কথা জানানো হয়। তবে কোনো ধরনের কারণ দর্শানো বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে আসিফ মাহতাবকে অব্যাহতির কারণে সমালোচনা তৈরি হয়। তাকে স্বপদে বহালের দাবি জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করে জাতীয় শিক্ষক ফোরাম। আসিফ মাহতাবকে অব্যাহতির প্রতিবাদে মঙ্গলবার বিক্ষোভ করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়।
Posted ৯:১৫ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২৪ জানুয়ারি ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh