জাফর আহমাদ | বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন ২০২৪
কুরবানি মুসলিম মিল্লাতের ঐতিহাসিক ও অবিস্বরণীয় এক ইবাদাত। এটি হজ্বের একটি অংশ। হজ্ব অনুষ্ঠান ছাড়াও গোটা বিশ্বের মুসলমানগণ ঈদুল আজহা শেষে কুরবানি করে থাকেন। শুধু কুরবানি নয় গোটা হজ্ব অনুষ্ঠানটিই ঐতিহাসিক চেতনা সমৃদ্ধ একটি ইবাদাত। আল্লাহ তায়ালা বলেন,“নিশ্চয়ই ছাপা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমুহের অন্তর্ভুক্ত।”(বাকারা : ১৫৮) মনে রাখা প্রয়োজন কুরবানি ও হজ্বের ঐতিহাসিক চেতনাকে বিস্মৃত রেখে পালন করা হলে এ এক ব্যর্থ কসরত ছাড়া আর কিছু ফায়েদা বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। এ জন্য হজ্বের প্রতিটি হুকুম পালন কালে অবশ্যই এর ঐতিহাসিক চেতনাকে সামনে নিয়ে পালন করতে হবে। অন্যথায় হজ্ব অনুষ্ঠান স্্েরফ একটি অনুষ্ঠানই থেকে যাবে। এটি এমন এক চেতনার নাম যা আল্লাহর ঘরের মেহমান সম্মানিত হজ্ব যাত্রীসহ সারা বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানের জন্য সমভাবে কাজে আসবে।
সম্মানিত হজ্বযাত্রী ও কুরবানিকারীদের অনুরোধ করবো প্রবন্ধটি সামান্য সময়ের জন্য হলেও পড়ে নিবেন এবং শিরক উচ্ছেদে ও ইসলামী আন্দোলনে নিজেদেরকে উদ্দীপ্ত করবেন। আমরা যে পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে প্রতিবছর কুরবানি করি এটি মুলতঃ সবচেয়ে বড় কুরবানি। কিন্তু ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসলে আমরা দেখতে পাই এর আগে আরো কতগুলো কুরবানি রয়ে গেছে। ওই কুরবানিগুলো না দেয়া পর্যন্ত এ শেষ কুরবানি দেয়ার অধিকার কারো নেই। অবশ্য কুরবানি আমরা দিয়ে যেতে পারবো বটে এবং দিয়ে যাচ্ছিও বটে কিন্তু তা আমাদের জীবনকে কতটুকু প্রভাবিত করতে পেরেছে তার বাস্তব ফলাফল তো আমাদের সামনেই আছে। কই কোথাও তো পরিবর্তনের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয় না। বরং এটি একটি ট্রেডিশনাল সংস্কৃতির রূপ ধারণ করে আমাদের মহৎ উদ্যোগ ও উদ্দেশ্যকে সমূলে ধ্বংস করে দিচ্ছে। কুরবানির সার্থকতা পেতে হলে আমাদেরকে প্রথমে কুরবানির ঐতিহাসিক চেতনাকে উপলব্ধি করতে হবে এবং নিজেদেরকে সেই চেতনার আলোকে প্রস্তুত করে নিতে হবে।
হযরত ইব্রাহিম আঃ মুল কুরবানীতে অবতীর্ণ হওয়ার আগে নিজের মধ্যে কতগুলো পরিবর্তন এনে ছিলেন অর্থাৎ নিজের ভেতর লুকায়িত পশুবৎ কতগুলো জানোয়ারের গলায় তিনি আগে ছুরি চালিয়েছিলেন। যা প্রত্যেক কুরবানারীদেরকে অবশ্যই পালন করতে হবে। সেই কুরবানগুলো কি তা অত্র প্রবন্ধের “মুল কুরবানির আগে কতগুলো কুরবানি” নামক আলোচনায় জানা যাবে। পৃথিবীর প্রথম কুরবানি আমরা আল কুরআনে বিবৃত হযরত আদম আঃ এর দু-সন্তানের কুরবানি থেকে জানতে পারি। কিন্তু আমরা যে কুরবানি করি এটি মূলত হযরত ইবরাহিম আ: এর চেতনার প্রেক্ষিতে।
কুরবানি অর্থ : কারব মূল ধাতু থেকে কুরবান উদগত। যার অর্থ নৈকট্য, সান্নিধ্য, কুরবানী, উৎসর্গ ইত্যাদি। আল কুরআনে ‘মানাসিক’ কুরবানি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন,“আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ্ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও।”(সুরা হজ্জ:৩৪) উল্লেখিত আয়াতে তাফসীরকারক মুজাহিদ প্রমুখ ‘মানাসিক’ শব্দের অর্থ কুরবানি গ্রহণ করেছেন। আয়াতের অর্থ হবে এই যে, এই উম্মতকে কুরবানির যে আদেশ দেয়া হয়েছে, তা কোন নতুন আদেশ নয়, পুর্ববর্তী উম্মাতদেরকেও কুরবানির আদেশ দেয়া হয়েছিল। পারিভার্ষিক অর্থে কুরবানী বলা হয় নির্দিষ্ট পশু নির্দিষ্ট তারিখে তথা জিলহজ্জ মাসের ১০,১১ ও ১২ তারিখ আল্লাহর নামে যবেহ করার নাম কুরবানি।
আল কুরআনে কুরবানি: আল্লাহ (বাকি অংশ ৪০ পাতায়)
কুরবানি : ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি
তা’আলা বলেন,“আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আলাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ্ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও।” (সুরা হজ্জ:৩৪) “আর কুরবানির উটগুলোকে তোমাদের জন্য নিদর্শনসমুহের অন্তর্ভুক্ত করেছি।
এতে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় কুরবানি করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর। যখন কুরবানি করা উটগুলো মাটিতে পড়ে নিথর হয়ে যায় তখন তা থেকে তোমরা খাও এবং যারা প্রয়োজনের কথা প্রকাশ করে এবং যারা প্রকাশ করে না তাদেরকেও খাওয়াও।”(সুরা হজ্জ:৩৬) আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর তাদেরকে আদমের দুই ছেলের সঠিক কাহিনীও শুনিয়ে দাও। যখন তারা উভয়েই কিছু কুরবানি করেছিল, তখন তাদের একজনের কুরবানি গৃহিত হয়েছিল এবং অপরজনের গৃহিত হয়নি।
সে বলল: আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। সে বলল:আল্লাহ তো মোাকীদের নাযরানা কবুল করে থাকেন। তুমি আমাকে মেরে ফেলার জন্য হাত উঠালেও, আমি তোমাকে,মেরে ফেলার জন্য হাত উঠাবো না। আমি বিশ্ব জাহানের প্রভু আল্লাহকে ভয় করি। আমি চাই আমার ও তোমার পাপের ভার তুমি একাই বহন করো। এবং তুমি জাহান্নামী হয়ে যাও। জালেমদের জুলুমের এটাই সঠিক প্রতিফল।”( সুরা মায়েদা:২৭-২৯)
আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ইবরাহিম বললেন, আমি আমার প্রতিপালকের মুখাপেক্ষী হচ্ছি। তিনি আমাকে পথ প্রদর্শন করবেন। প্রভু আমাকে নেক সন্তান দান করুন। অত:পর আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলাম। পুত্রটি যখন কৈশোর বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহিম তাকে বলল, হে আমার সন্তান! আমি স্বপ্নে তোমাকে কুরবানি করতে দেখেছি।
এ ব্যাপারে তোমার অভিমত কি? পুত্র বললেন, হে আমার পিতা! আপনাকে যা হুকুম করা হয়েছে তা পালন করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভূক্ত পাবেন। অবশেষে উভয়ই আনুগত্যের মস্তক অবনত করলেন এবং ইবরাহিম তার পুত্রকে উপুর করে শুয়ে দিলেন। এমনি সময় আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম তুমি সত্যিই স্বপ্নকে বাস্তব রূপদান করেছো। নিশ্চয় আমি নেককারদেরকে এভাবেই প্রতিদান প্রদান করি। নিসন্দেহে এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা ছিল। অতপর একটি বিশাল একটি কুরবানির পরিবর্তে তোমার পুত্রকে রক্ষা করলাম।”(সুরা সফফাত:৯৯-১০৭)
কুরবানি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি
মানুষ সামাজিক জীব হিসাবে আনন্দ-উৎসব প্রিয়। পৃথিবীর প্রতিটি জাতি তাদের নিজ নিজ ঐতিহ্য অনুযায়ী তাদের আনন্দ-উৎসব পালণ করে থাকে। এবং এ জন্য তাদের নির্দিষ্ট দিন ধার্য করা আছে। এ সমস্ত অনুষ্ঠানাদি পালনের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। কোন কোন জাতি শুধুমাত্র রং তামাশা ও আমোদ প্রমোদের জন্যই উৎসব পালন করে থাকে।
এর কোন দার্শনিক ও নৈতিক ভিত্বি আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু মুসলমানদের আনন্দ-উৎসবের একটি দার্শনিক ও নৈতিক ভিত্বি রয়েছে। এর মাধ্যমে মুসলিম জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, আকিদাহ-বিশ্বাস এবং নৈতিক প্রান শক্তির প্রতিফলন ঘটে থাকে। ইসলাম অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠী ও সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এক সংস্কৃতিও প্রতিপালন করে থাকে। শুধুমাত্র সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নয়, জীবনের প্রতিটি অঙ্গনেই ইসলামের স্বাতন্ত্রবোধ রয়েছে।
কুরবানি মুসলিম জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। এ পবিত্র অনুষ্ঠানটিকেও বিকৃতি সাধনে আমরা তৎপর রয়েছি। কুরবানির মহৎ উদ্দ্যেশ্যকে ভূলে গিয়ে এটিকে একটি ট্রেডিশনাল উৎসবে পরিণত করেছি। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, সকল শরীয়তে কুরবানি ইবাদাতের একটি অংশ ছিল। কিন্তু কালক্রমে পৃথিবীর জাতিগুলো আল্লাহর হেদায়াত ভুলে গিয়ে অসংখ্য বেহুদা কাজের মধ্যে কুরবানীর বেলায়ও বিকৃতি ঘটিয়েছিল।
যেমনিভাবে তারা আলাহকে বাদ দিয়ে সৃষ্টির সামনে তথা গায়রুল্লাহর সামনে মাথা নত করতো তেমনিভাবে গায়রুল্লাহর সামনে পশু বলিদান করতো। জাহেলী যুগে আরববাসীরা তাদের দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে কুরবানি করতো এবং তা দেবতাদের সামনে উপস্থিত করতো। এমনকি আল্লাহর উদ্দেশ্যে যারা কুরবানি করতো তারাও কুরবানির গোশত, রক্ত ও হাড্ডি কাবা ঘরের সামনে পেশ করতো। তাদের বিশ্বাস ছিল যে যেহেতু কা’বার মালিক আল্লাহ, তাই কুরবানীর গোশত, রক্ত ও হাড্ডি তার সামনে রেখে দিলে তাতে তিনি খুশি হবেন। এ বিশ্বাসের ফলস্বরূপ কেউ কেউ আবার কা’বার দেয়ালে কুরবানির পশুর রক্ত মেখে দিত। কিন্তু আল্লাহর রাসুল স: জানালেন, এগুলো যেভাবে আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে চাচ্ছে তা সঠিক নয়। বরং অন্তরের আবেগ, উপলব্ধি ও আন্তরিকতাই আল্লাহ দেখতে চান। যেমন দেখিয়েছিলেন ইবরাহিম ও ইসমাঈল আ:।
আল কুরআনের দু’টি সুরা তথা সুরা মায়েদা ও সাফফাতে বর্ণিত হযরত আদম আ: এর দু-সন্তান হাবিল-কাবিল ও হযরত ইবরাহিম আ: এর পুত্র ইসমাঈল আ: এর কুরবানি থেকে আমাদের সামনে ইসলামী সংস্কৃতির একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র ভেসে আসে। আদম পুত্র হাবিল এবং ইবরাহিম পুত্র দু’জনের চরিত্র ছিল কুলষমুক্ত।
আল্লাহ তা’আলা কুরবানীর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে বলেন,“যেন তারা এগুলোর কল্যাণসমূহ প্রত্যক্ষ করতে পারে এবং নির্দিষ্ট কয়েকদিন রিযিক হিসাবে দেয়া চতুস্পদ যন্তুসমুহ হতে আল্লাহর নামে যবেহ করতে পারে। তা থেকে তোমরা নিজেরা খাও এবং অভাবগস্ত ও দরিদ্র লোকদের খেতে দাও।” (সুরা হজ্জ:২৮) এ আয়াতে কয়েকটি বিষয় স্মর্তব্য, আল্লাহর নাম স্মরণ করা, নির্দিষ্ট দিনে কুরবানি করা, চতুষ্পদ জানোয়ার কুরবানি করা, কুরবানির গোশত নিজে খাওয়া এবং অভাবগ্রস্থ ও মিসকিনদের খাওয়ানো। নির্দিষ্ট পশু নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহর নামে কুরবানি করে এ গোশত নিজেরা খাবে, আত্মীয়-স্বজন এবং সমাজের গরীব-মিসকিনদেরকেও খাওয়াবে।
বিভিন্ন তাফসীরবিদগণ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা: বরাত দিয়ে বলেছেন, কুরবানীর গোশত একভাগ নিজে খাও, একভাগ পাড়া-প্রতিবেশীকে দাও, একভাগ গরিব-মিসকিনদের দাও। এটিই আমাদের ঐতিহ্য এবং এটি আমাদের সংস্কৃতি হওয়া উচিত।
উল্লেখিত আলোচনার প্রেক্ষিতে সঠিক কুরবানির কাঠগড়ায় আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কুরবানি অবশ্যই একটা ভিন্ন সংস্কৃতির রূপ ধারণ করেছে। ইসলামের অনুসারী বা মুসলিম হিসাবে যা কোনক্রমে কাম্য নয়। আমাদের কুসংস্কৃতিগুলো হলো নিম্নরূপ। তার মধ্যে প্রধানতম রূপ হলো লোক দেখানো বা প্রতিযোগিতামূলক কুরবানি।
ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম যে অমুক ব্যক্তি আমার চেয়ে বেশী দামে বা আমার চেয়ে বড় ধরণের পশু কুরবানি করছে, তা হতে পারে না, বরং আমি তার চেয়েও দামী বা বড় ধরণের কুরবানি দিবো। অথবা প্রতি বছর কুরবানী দিয়ে আসছি, এ বছর কুরবানি না দিলে মানুষ কি বলবে। অথবা কুরবানি না দিলে ছেলে-মেয়েরা অন্যের দিকে থাকিয়ে থাকবে ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এগুলো সুষ্পষ্টভাবে জাহিলিয়াতের যুগের কুরবানি অথবা কাবিলের কুরবানির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে হুবহু মিলে যায়।
Posted ১:৩৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh