টেনেসি থেকে ফিরে মোহাম্মদ আজাদ : | বৃহস্পতিবার, ০৮ জুলাই ২০২১
টেনেসিতে কেমন আছেন বাংলাদেশীরা
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ-ওয়েষ্টের টেনেসি স্টেটে আমার সফর ছিল নিতান্তই ব্যক্তিগত। আমার স্ত্রী কলি আগে থেকে টিকেটের বুকিং দিয়ে রেখেছিল। আমি প্রথমে মৃদু আপত্তি জানালেও পরে রাজি হয়ে যাই। ভাবলাম রথ দেখা ও কলা বেচা দুটোই যদি একসাথে হয়ে যায় তাহলে মন্দ কী! আমার মেঝ কুটুম হুমায়ুন কবির টেনেসিতে থাকেন। ২৭ জুন সকালে আমি, কলি ও আমাদের দুই সন্তানসহ নিউইয়র্কে লাগর্ডিয়া এয়ারপোর্ট থেকে যাত্র করি সাউথ-ওয়েষ্ট এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করার পর ফ্লাইটে তিল ধারণের ঠাই ছিল না। সবাই সব আসন জুড়ে বসেছে। কোন আসন যাত্রীশূন্য নেই।
ফ্লোরিডার টেম্পায় আমাদের দীর্ঘ যাত্রাবিরতি ছিল কানেকটিং ফল্অইট ধরার জন্য। বিকেল ৪টার পর আমরা মেম্ফিস ইনটারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌছলাম। আগে থেকেই সেখানে হুমায়ুন কবির ভাই তার ছোট মেয়ে আফরিন ও বড় মেয়ে তানসিলাকে নিয়ে অপেক্ষা করছেন আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য। হুমায়ুন ভাই থাকেন বাটলেট নামে এক সিটিতে। মেম্ফিস হচ্ছে ফেডেক্স এর ওয়ার্ল্ড হেডকোয়ার্টার। এয়ারপোর্ট থেকে আমি দেখলাম এটি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন সিটি। রাস্তায় কোন ধরনের যানজট নেই। বাসায় পৌছার পর প্রেমা ভাবী আমাদের আরেক দফা স্বাগত জানালেন। হুমায়ুন ভাইয়ের ছোট মেয়ে আফরিন তাদের ফুফুকে লাল গোলাপ দিয়ে শুভেচ্ছা জানালো। কার কলিসহ এটি আমাদের প্রথম টেনেসি সফর। প্রেমা ভাবীকে শুধু স্মার্ট বললে ভুল হবে। বলা যেতে পারে স্মার্টের উপর ম্মার্ট।
প্রথম রাতেই আমাদের ডিনারের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে পাশের একটি বাসায়। হুমায়ুন ভাইয়ের ছোট বোন বলে কথা। হুমায়ুন ভাই সেখানে জনপ্রিয় ব্যক্তি। পরক্ষণে প্রেমা ভাবী বললেন, কমপক্ষে ৫টি বাসা থেকে আমাদের অগ্রিম দাওয়াত দিয়ে রাখা হয়েছিল। ডিনারের ফাঁকে আমি জানতে চেয়েছিলঅম সেখানকার বাংলাদেশীদের কথা। তারা যে তথ্য দিলেন তাতে আমরা রীতিমত হতাশ হলাম। তারা বললেন, এই বাটলেট সিটিতে বড়জোর একশ বাংলাদেশী থাকতে পারেন। মেম্ফিসে বড়জোর ১ হাজার বাংলাদেশী এবং সব মিলিয়ে মেম্ফিস এলাকাসহ সমগ্র টেনেসিতে এক হাজার থেকে ১২শ’ বাংলাদেশী বাস করেন।
সফরের দ্বিতীয় দিনে প্রেমা ভাবী আমাদের নিয়ে গেলেন নিকটবর্তী একটি শপিং মলে। আমি পুরো শপিং মলে তাকিয়ে দেখলাম; একজন বাংলাদেশীও সেখানে দেখতে পাইনি। আমার গায়ে পলো রাফ লরেন শার্ট দেখে প্রেমা ভাবী আমাকে দুটি রাফ লরেন শার্ট গিফট করতে চান। আমি মানা করলাম। কিন্তু প্রেমা ভাবী আমার আপত্তি শুনতে নারাজ। শেষ পর্যন্ত তিনি আমাকে একটি পলো রাফ লরেন শার্ট গিফট করলেন। দাম দেখলাম ৯৮.৫০ ডলার। নিউইয়র্কের সমান দাম। দ্রব্যমূল্যের উপর বিভিন্ন ষ্টেটে সেলস ট্যাক্স বিভিন্ন রকম। নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যের মূল্য নিউইয়র্কের চেয়ে কিছুটা কম এবং গ্যামের দাম নিউইয়র্কের চেয়ে গ্যালনপ্রতি ১৫-২০ সেন্ট কম দেখা গেল। ট্যাক্সসহ প্রতি প্যাকেট সিগারেটের দাম নিউইয়র্কের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। হুমায়ুন ভাই বাটলেটে বিলাসবহুল যে তিন বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন সেটির ভাড়া মাত্র ১৫০০ ডলার। সেই হাউজিং কমপ্লেক্সে কার পার্কিং ও জিম ব্যবহার ফ্রি। নিউইয়র্কে এ ধরনের একটি অ্যপার্টমেন্টের মাসিক ভাড়া হবে কমপক্ষে ৫ হাজার ডলার।
দ্বিতীয় দিন রাতে আমাদের ডিনারের আমন্ত্রণ ছিল নাসের ফয়জুল্লাহ ভাইয়ের বাসায়। নাসের ভাই বাটলেট থেকে ১১ মাই দূরে জার্মান টাউনে থাকেন। জার্মান টাউন একটি অভিজাত এলাকা। নাসের ভাই যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার পর ভালো চাকুরি করতেন। কিন্তু এক পর্যায়ে তিনি চাকুরি ছেড়ে বিরয়েল এষ্টেট ব্যবসা ও আমেরিকার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে তিনি এত ঘনিষ্টভাবে জড়িত যে স্টেট গভর্নর, সিনেটর, সিটি মেয়র মাঝে মাঝে তার বাসায় আসেন কখনও রাজনৈতিক প্রচারণায়, কখনও শুভেচ্ছা বিনিময় করতে। নাসের ভাইয়ের স্ত্রী শিলা ভাবী আমাদেরকে তার বাসায় স্বাগত জানালেন। ণেশভোজে ডাইনিং টেবিলে বসার পর দেখলাম শিলা ভাবী আমাদের জন্য যে শাহী আয়োজন করেছেন তা হতবাক করার মত। দেশীয় স্টাইলে পোলাও-মাংস বা বিরিয়ানি নয়, তিনি আমাদের জন্য রান্না করেছেন অ্যারাবিয়ান ফুড। রান্নার ভূয়সী প্রশংসা করে আমি বললাম, ভাবী আপনি অ্যারাবিয়ান ফুড রান্না শিললেন কীভাবে? তিনি মৃদু হেসে কোনো উত্তর দেননি।
নাসের ভাইয়ের সাথে আলাপকালে এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন, ‘টেনেসিতে চলে আসুন। আমাদের কমিউনিটিতে লোকসংখ্যা বাড়ুক।’ যে কোন ঈদে নাসের ভাইয়ের বাসায় কমিউনিটির মিলন মেলা হয়। প্রতি ঈদে নাসের ভাইয়ের বাসা পরিণত হয় ওপেন হাউজে। আশপাশের চার-পাঁচটি ছোট ছোট সিটির বাংলাদেশীরা নাসের ভাইয়ের বাসায় ঈদ উৎসব উদযাপন করেন। রাতে বাসায় ফেরার পর আমি টেনেসির মুসলমানদের অবস্থা বোঝার জন্য সেলফোনে গুগলে কাছাকাছি মসজিদ খুঁজতে শুরু করলাম এবং দেখা গেল ৪/৫ মাইলের মধ্যে কিছু মসজিদ আছে। হালাল মাংসের দোকানের অবস্থাও একই রকম। টেনেসির বিভিন্ন সিটিতে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশী পরিবারগুলোতে ধর্মীয় চর্চার অনুশীলন খূব একটা আছে বলে আমার মনে হয়নি। নতুন প্রজন্মের ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে বলে মনে হয়নি। অবশ্য এ নিয়ে আমি কাউকে কোন প্রশ্ন করিনি।
দ্বিতীয় দিন সকালে আমি হুমায়ুন কবীর ভাইকে বললাম, চলুন আমরা যেকোন স্টারবাকসে গিয়ে কফি পান করে আসি। প্রেমা ভাবী বললেন, আমি স্টারবাকসের চেয়ে ভালো কফি বানাতে পারি। কফিশপে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। এরপরও হুমায়ুন ভাই বললেন, চলোম আমরা যাব।’ প্রায় ৮ মাইল ড্রাইভ করে স্টারবাকসে গেলাম কফি পান করতে। কফি কেনা হলো। কিন্তু স্টারবাবসের স্টাফদের কাস্টমার সার্ভিস ছিল নিম্নমানের। নিউইয়র্কের স্টারবাবকস এর কাস্টমার সার্ভিস টেনেসির চেয়ে দুই ধাপ এগিয়ে আছে। অন্য আরেক দিন গেলাম ডানকিন ডোনাটে কফি পান করতে। আমার উদ্দেশ্য ছিল কি ধরনের লোকজন টেনেসির ডানকিন ডোনাটে কাজ করছে তা দেখা। দেখলাম সেখানকার ডানকিন ডোনাটে কাজ করছেন শ্বেতাঙ্গিনী তরুণী ও মহিলারা। ডানকিন ডোনাটের কাস্টমার সার্ভিসও নিম্নমানে। তৃতীয় দিন আমরা যাত্রা করলাম মেম্ফিস থেকে ৪৩৭ মাইল দূরে গিটলিনবার্গ সিটিতে। সেখানে একটি ট্যুরিষ্ট স্পট আছে, যার নাম স্মোকি আইল্যান্ড। গেটলিনবার্গে থাকার সময় আমাদের সাথে যোগ দেন পাপলু ভাই, ভাবী লিটা রহমান ও তার বাচ্চারা। লিটা ভাবী সদা হাসিমুখ থাকতে পছন্দ করেন ও বেশ স্মার্ট বলেই মনে হলো তাকে। পাপলু ভাই অত্যন্ত চমৎকার মানুষ এবং তিনি সারা জীবন ব্যবসায়ী ছিলেন। এখানেও তিনি ব্যবসা করছেন। মাত্র কিছুদিন আগেও তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকতেন এবং সম্প্রতি একটি ব্যবসা ক্রয় করে টেনেসিতে মুভ করেছেন। গেটলিনবার্গ যাওয়ার সময় কলি তার ভাইয়ের সঙ্গে ড্রাইভিং শেয়ার করেছে। হাইওয়ের স্পিড লিমিট লেখা রয়েছে ৭০ মাইল। গেটলিনবার্গে আমরা দু’রাত ছিলাম। সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায় টেনেসির শ্বেতাঙ্গ লোকসংখ্যা ৯০ শতাংশের বেশি। পাপলু ভাই ও লিটা ভাবী আমাদেরকে তার বাসায় নিতে পারেননি আমাদের সময় স্বল্পতার জন্য। তাই পাপলু ভাই আমাদের গেটলিনবার্গে একদিন ডিনার এবং মেম্ফিসে ফিরে আসার সময় লাঞ্চ করিয়েছেন।
টেনিসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশী ছাত্রদের বাংলাদেশ স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন রয়েছে। যেসব বাংলাদেশী ঝুঁকি নিয়ে টেনেসিতে মুভ করেছেন সবাই ভালো আছেন বলে মনে হয়েছে। কেউ ভালো চাকুরি করছেন, এবং অনেকে গ্যাস স্টেশন ও কনভেনিয়েন্স স্টোর ক্রয় করে ব্যবসা করছেন। তবে গ্যাস স্টেনের দাম বর্তমানে প্রায় দুই লাখ ডলারে উঠে গেছে।
Posted ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৮ জুলাই ২০২১
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh