মাওলানা রফিকুল ইসলাম : | শুক্রবার, ২৩ আগস্ট ২০২৪
মহান আল্লাহ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তার সব সৃষ্টির মধ্যে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তিনি মানুষকে অত্যন্ত ভালোবেসে সৃষ্টি করেছেন। সত্য ও ন্যায়ের পথে মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য তিনি যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। তারা এসে মানুষকে কল্যাণের পথে আহ্বান করেছেন। আমরা সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত। তিনি আমাদের জীবন পরিচালনা করার জন্য দুটি জিনিস রেখে গেছেন, তা হলো কোরআন ও হাদিস। যদি জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আমরা এ দুটির অনুসরণ করে চলতে পারি, তাহলে আমাদের দুনিয়ার জীবন হবে কল্যাণকর এবং পরকালে পাব চিরমুক্তি। কোরআন-হাদিসের আলোকে এমন ১০টি আমল উল্লেখ করছি, যেগুলোর দ্বারা আমরা মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে পারব। আর আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে পারলে আমরা উভয় জগতে সফলতা অর্জন করতে পারব।
আল্লাহর দাসত্ব করা : মানুষ আল্লাহর গোলাম। সে হিসেবে মানুষের কাজ হচ্ছে সর্বদা প্রভুর আদেশ-নিষেধের অনুগত থাকা। প্রভুর সামনে গোলামের আশা-আকাক্সক্ষা কিংবা ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলতে কিছু থাকে না। তার সবকিছু প্রভুর মর্জির ওপর নির্ভরশীল। যে আল্লাহর প্রকৃতপক্ষে বান্দা হওয়ার যোগ্য, সে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, অভিরুচি সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছাধীন সম্পাদন করে থাকে এবং সর্বদা আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে অবনত মস্তকে পালন করে। এজন্যই ইসলাম শব্দের অর্থ হচ্ছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ। আল্লাহর সব হুকুম বিনা দ্বিধায় এবং কোনোরকম যুক্তিতর্ক ছাড়াই মেনে নেওয়া। এজন্য একজন খাঁটি মুমিনের প্রথম পরিচয় হবে আল্লাহর বিধিবিধান সর্বতোভাবে ও অকুণ্ঠচিত্তে মেনে চলা।
বিনয়ী হওয়া : মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর বান্দা হলো তারা, যারা জমিনে বিনীতভাবে চলাফেরা করে।’ (সুরা ফুরকান ৬৩)। অর্থাৎ তাদের চালচলনে বিনয়-স্থিরতা ও নিরহংকার প্রকাশ পায়। আত্মগরিমা, শঠতা ও দাম্ভিকতা দেখা যায় না। তাদের দৃষ্টি নিম্নগামী হয় এবং তারা দৃঢ় পদক্ষপে পথ চলে। আল্লাহভীতির কারণে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সদা নমনীয় থাকে এবং যত্রতত্র সেগুলোর ব্যবহার থেকে তারা বেঁচে থাকে। প্রকৃতপক্ষে তারা দুর্বল-ভীরু কিংবা অক্ষম নয়। বরং আল্লাহভীতি ও আখেরাতের চিন্তা তাদের সজ্জন, সহনশীল, নমনীয় ও স্বল্পভাষী করে রাখে।
ঝগড়া পরিহার করা : মহান আল্লাহ বলেন, ‘মূর্খরা যখন তাদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা করে তখন তারা বলে, তোমাদের ওপর সালাম বা শান্তি বর্ষিত হোক।’ (সুরা ফুরকান ৬৩)। এখানে সালামের অর্থ মুসলমানরা পরস্পর দেখা-সাক্ষাতে অভিবাদন জানানোর ধর্মীয় মাধ্যম সালাম নয়। বরং ওই অজ্ঞের শান্তি-সুখ ও নিরাপত্তা কামনা করা এবং বুঝিয়ে দেওয়া যে, তোমার অজ্ঞতাপ্রসূত আচরণের জবাব আমি মূর্খতা দিয়ে দেব না। তোমার সঙ্গে ঝগড়াও করব না। বরং তোমার শান্তি-সমৃদ্ধি ও মঙ্গল হোক, সেটাই আমি কামনা করি।
রাত জেগে ইবাদত করা : মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা তাদের রবের ইবাদতে সেজদা ও দণ্ডায়মান অবস্থায় রাত্রিজাগরণ করে।’ (সুরা ফুরকান ৬৪)। যারা ইবাদতের জন্য নিদ্রা ও শয্যা ত্যাগ করে রাত্রিজাগরণ করে, তারা নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রিয় বান্দা। শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা সব নেক বান্দার অভ্যাস। এ নামাজ মুমিনের মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করে। সর্বদা তারা ইলেম অর্জন-বিতরণ, দাওয়াত-তাবলিগ ও আপন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে এবং নৈশপ্রহরে আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভে ব্রতী হয়। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের পাশর্^দেশ শয্যা থেকে পৃথক থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে আশা ও আশঙ্কায় ডেকে থাকে।’ (সুরা সিজদা ১৬)
অপচয় ও কৃপণতা না করা : আল্লাহর বান্দাদের আরেকটি গুণ হলো, তারা যখন খরচ করে তখন তারা অযথা ব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না। বরং মধ্যপন্থা অবলম্বন করে। (সুরা ফুরকান ৬৭)। শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে খরচ করাকে অপব্যয় বলে। যদিও তা অতি সামান্য হোক। আলোচ্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা অপব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না। কোরআনের অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’ (সুরা বনি ইসরাঈল ২৭)।
শিরক থেকে বেঁচে থাকা : আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্যতম একটি গুণ হলো, ‘আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে ডাকে না।’ (সুরা ফুরকান ৬৮)। শিরক করা বা কোনো কিছুকে মহান আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা সবচেয়ে মারাত্মক গুনাহ। মহান আল্লাহ সব গুনাহ মাফ করলেও শিরকের গুনাহ মাফ করবেন না। হজরত লোকমান (আ.) তার ছেলেকে উপদেশ দিয়েছেন, ‘হে পুত্র! তুমি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করো না। নিশ্চয়ই শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ।’ (সুরা লোকমান ১৩)
অন্যায় হত্যাকাণ্ডে না জড়ানো : আল্লাহর প্রিয় বান্দারা কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করে না এবং পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সংগত কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না।’ (সুরা ফুরকান ৬৮)
ব্যভিচারে লিপ্ত না হওয়া : আল্লাহর প্রিয় বান্দারা ব্যভিচার ও অশ্লীল কার্যকলাপে জড়িত হয় না। এমনকি তারা ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হয় না। তা থেকে যোজন যোজন দূরত্ব বজায় রাখে। অশ্লীল দৃশ্য, অবাধ মেলামেশা এসব পাপাচার ও গর্হিত কাজ মানুষকে ক্রমান্বয়ে ছোট-বড় ব্যভিচারে লিপ্ত করে। আল্লাহর প্রিয় মানুষরা এসবের ধারেকাছেও যায় না। প্রসঙ্গত, যারা উপর্যুক্ত গুনাহ করবে, তাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘যে তা করবে, সে শাস্তি ভোগ করবে। কেয়ামতের দিবসে তার শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে এবং তাকে জাহান্নামে চিরস্থায়ী করে দেওয়া হবে।’ (সুরা ফুরকান ৬৮-৬৯)
মিথ্যা কাজে যোগদান না করা : আল্লাহর প্রিয় বান্দারা মিথ্যাকথন, মিথ্যা আলোচনা, মিথ্যাচর্চার আসর ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করে না। অনৈতিক ক্রিয়ালাপ-পরনিন্দা ও মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান থেকেও বেঁচে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা মিথ্যা কিছুতে উপস্থিত হয় না।’ (সুরা ফুরকান ৭২)। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়াকে কবিরা গুনাহ আখ্যা দিয়েছেন। তাছাড়া মিথ্যা কথা বলাও কবিরা গুনাহ।’
অনর্থক কাজ পরিহার করা : তারা যদি দৈবচক্রে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনর্থক ও বাজে আসর কিংবা কাজের মুখোমুখি হয়, তাহলে কৌশলে ও ভদ্রভাবে তা এড়িয়ে যায়। গাম্ভীর্য ও শালীনতা বজায় রেখে সেখান থেকে সরে যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন অনর্থক কিছুর পাশ দিয়ে যায়, তখন ভদ্রভাবে চলে যায়।’ (সুরা ফুরকান ৭২)। উল্লিখিত দশটি গুণে যারা গুণান্বিত হবে, আশা করা যায় মহান আল্লাহ দুনিয়াতে তাদের অসংখ্য কল্যাণ দান করবেন। আর পরকালে এর বিনিময় হিসেবে দেবেন কাক্সিক্ষত জান্নাত।
দেশ রূপান্তর
Posted ১১:১১ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৩ আগস্ট ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh