| বৃহস্পতিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে ইতিহাসের অনন্য দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে হয় নানা অনুষ্ঠান-আয়োজন । ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই সংবাদমাধ্যমগুলোও আমাদের ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে নানারকম আয়োজন করে থাকে। একুশের প্রেক্ষাপট অনেক বিস্তৃত ও তাৎপর্যপূর্ণ এবং বাঙালির জাতীয় জীবনে বাঁক পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই রচিত হয় আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের মহান অধ্যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্ব। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর ভাষার দাবিতে এ দেশের মানুষ আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণপরিষদে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব পেশ করেন। গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ। ১১ মার্চ ছাত্র-ছাত্রীরা ধর্মঘট পালন করে। ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভেঙে শিক্ষার্থীরা মিছিল করলে পুলিশ গুলি করে ২১ ফেব্রুয়ারি । এই খবর ছড়িয়ে পড়লে আরও বেশি আন্দোলনমুখী হয়ে পড়ে সর্বস্তরের মানুষ । ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির পর যেসব যে লেখালেখি হলো, তাতে বাঙালির আত্ম-অনুসন্ধানের চেষ্টা ছিল।ভাষা আন্দোলনই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার। কিন্তু যে গণতান্ত্রিক চেতনা এই ঘটনার কেন্দ্রে ছিল, পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র ও সমাজে এর যথাযথ বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। আজকের বাস্তবতায় এ প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবির মূলকথা ছিল রাজভাষা ও রাজসংস্কৃতির স্থলে জনগণের ভাষা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তা কি হয়েছে? এখনও আমরা রাজভাষা ও সংস্কৃতিই অনেক ক্ষেত্রে লালন করে চলেছি। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয় ও ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৯৩ রাষ্ট্রে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলার বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার এটি একটি বড় ধাপ।
ভাষা শুধু সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমই নয়; ইতিহাস ও ঐতিহ্যেরও বাহন। শিল্পকর্মসহ সবক্ষেত্রে অগ্রগতিরও ধারক। আমাদের সরকার ও সমাজ ভাষা আন্দোলনের চেতনার আলোকে অনেক দায়িত্বই পালন করতে পারেনি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত গোলমেলে। কথা ছিল একমুখী শিক্ষা হবে। কিন্তু হলো না আজও। অর্থাৎ একুশকে আমরা মর্মে নিতে পারিনি। আমরা রাষ্ট্র বদল করলাম, কিন্তু সমাজ বদলের কথা ভাবলাম না। পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী বাংলার বিরোধিতা করেছিল বলেই আমরা আন্দোলন করেছিলাম। এখনও সমাজে-রাষ্ট্রে অনিয়ম, দুর্নীতি, অবিচার, বৈষম্য জিইয়ে আছে। অপরাধের বিস্তৃতি ঘটছে। ইতিহাস অনেক কিছুই ধরে রাখে না। ছোটখাটো অনেক কিছুর সেখানে ঠাঁইও হয় না। আমাদের সরকারের নীতিনির্ধারকরা কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা অহরহ বলেন, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
কল্যাণ রাষ্ট্র গড়তে ও সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, বৈষম্য দূরীকরণে এবং একমুখী শিক্ষার বিষয়টিকে অবশ্যই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এসবের বাস্তবায়নে কাজের কাজ হোক। সময় অনেক বয়ে গেছে। বায়ান্ন, একাত্তর পর্বের যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও অঙ্গীকার ছিল, তা যেন আমরা ভুলে না যাই। সময় বদলায়, প্রেক্ষিতে বদল দেখা দেয়; কিন্তু একুশের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় না- এও স্মরণে যেন থাকে। ফেব্রুয়ারি আবার ফিরে এসেছে। অতীতের স্মৃতি হিসেবে নয় কেবল, ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি হিসেবেও। একুশের শিক্ষাটা কি? শিক্ষা এই যে, সমষ্টির পক্ষে কোনো বিজয়ই অসম্ভব নয়। বলাই বাহুল্য, বায়ান্নর আন্দোলনের সূত্র ধরে অবশ্যই শ্রেণি বিভাজন দূর করার যে অতিশয় প্রয়োজনীয় কাজটি এখনও বাকি রয়ে গেছে, সেটিকেই সম্ভব করে তুলতে হবে। শ্রেণিবিভাজন দূর করতে না পারলে অনেক কিছুই অধরা থেকে যাবে। আমরা জাতিরাষ্ট্রের ধারণা নিয়েছি ইউরোপ থেকে। তারা জাতীয় ভাষাকে জীবিকার ভাষা হিসেবে নিয়েছে। এসব বিষয় আমলযোগ্য থাকুক।
Posted ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh